উপজেলা একটা মিথ্যা নোশান

Hakikulislam Khokonহাকিকুল ইসলাম খোকন: স্থানীয় ইউনিটগুলির মধ্যে উপজেলা হচ্ছে মধ্যবর্তী ইউনিট। এর উপরে রয়েছে স্থানীয় ইউনিট যেমন জেলা ও বিভাগ, এর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় ইউনিট যেমন ইউনিয়ন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, এবং কোনো কোনো জায়গায় এর পাশে রয়েছে স্থানীয় ইউনিট যেমন সিটি কর্পোরেশন। স্থানীয় ইউনিটগুলির এমনতর এলোমেলো অবস্থা নিরসনকল্পে স্থানীয় সরকারের একটি সমন্বিত স্তরবিন্যাসকরণ গ্রহণ করতে হবে, এবং সেই অনুযায়ী স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট (জেলা কিংবা বিভাগ) এবং সর্বনিম্ন ইউনিটদ্বয় (ইউনিয়ন ও নগর) কার্যকর করতে হবে; তা না করে স্থানীয় ইউনিটগুলির এলোমেলো অবস্থা বজায় রেখে একটি মধ্যবর্তী ইউনিট নিয়ে অতি উৎসাহ ও মহড়া চলে আসছে। এই উপজেলার জন্মলগ্ন থেকে এর প্রতিটি নির্বাচনে কেন এত বেশী আগ্রহ ও সহিংসতা দেখা যায় তার কারণগুলি অবশ্যই ভালভাবে জানা ও বোঝা খুবই জরুরী। প্রকৃতপক্ষে এই মধ্যবর্তী ইউনিটে তেমন কোনো কাজকাম নেই, এতে পরিপূর্ণ স্থানীয় সরকার কাঠামো নেই, এর নিজস্ব আয়ের তেমন কোনো উৎস নেই, নিজস্ব আয়ের উৎস সৃষ্টির সুযোগও খুবই ক্ষীণ, এতে জনগণকে সেবামূলক সার্ভিস দেয়ার তেমন কোনো সুযোগও নেই এবং অন্যসব স্থানীয় ইউনিট ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে এর সম্পর্ক কেমন হবে তা সুনির্দিষ্ট করা নেই। অথচ উপজেলার প্রতিনিধিগণের জন্য গাড়ী, ড্রাইবার, বাসা, বিশাল দাপ্তরিক ভবন, পিয়ন, সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে লোভনীয় পদবী, বেতন-ভাতা, সামাজিক মর্যাদা, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, বিদেশ ভ্রমণ, অপক্ষমতা ও নানাবিধ পরোক্ষ সুযোগ-সুবিধা রয়েছে; এসব সুযোগসুবিধা থাকায় প্রতিযোগীদের মধ্যে একদিকে সাংঘাতিক মোহ ও লোভ তৈরী হয়; অপরদিকে, উপজেলা নির্বাচনে যাঁরা প্রতিযোগীতায় নামে তাঁদের উদ্দেশ্য কিন্তু শুধু উপজেলায় দায়িত্ব পালন করা নয়, তাঁদের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারী সুযোগসুবিধা কাজে লাগিয়ে সংসদ সদস্য হবার জন্য উপজেলাকে মই হিসেবে ব্যবহার করা; তাই, এই উপজেলা নির্বাচনে দলীয় ও নির্দলীয় ব্যক্তিবর্গের এতবেশী আগ্রহ ও সহিংসতা দেখা যায়।
এতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, এই উপজেলার জন্মগত উদ্দেশ্য ও কলংক এখনো একই রয়েছে; অবৈধ শাসক এরশাদ ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করা ও স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় তাঁবেদার গোষ্ঠী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে উপজেলা সৃষ্টি করেন, এবং তিনি বিশেষ ব্যবস্থায়, সবধরণের নিয়মকানুন লংঘন করে রাষ্ট্রীয় অর্থ ও ক্ষমতা বিলিয়ে দিয়ে উপজেলার প্রতি প্রবল লোভ ও একটি তাঁবেদার শ্রেণী তৈরী করতে সক্ষম হন। পাশাপাশি আরো অনেকেই ক্ষমতা ও অর্থ লোভের পাশাপাশি বুঝে না বুঝে উপজেলার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যান। এর সঙ্গে যুক্ত হয় একশ্রেণীর এনজিও ব্যক্তিত্ব, যাঁরা দাতা সংস্থার টাকা পেলে স্থানীয় সরকার নিয়ে সভা-সেমিনার আয়োজন করে; তাতে মূলত উপজেলাকে নিয়েই বেশ মাতামাতি হয়ে থাকে; এদের সঙ্গে যুক্ত থাকে জাতীয়ভাবে পরিচিত কিছু সুবিধাভোগী ব্যক্তি, যাঁরা প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বোঝে না, গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে অথচ গণতন্ত্রায়ন বুঝে না, স্থানীয় সরকারের ¯তরবিন্যাসকরণ, পারস্পরিক সম্পর্ক ও কাঠামো সম্পর্কে জানেনা, স্থানীয় সরকার কাঠামোতে এমপো’র প্রয়োগ চায়না; অথচ তাঁরা নিজেদেরকে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ হিসেবে সবসময় পরিচয় দিয়ে থাকে এবং মাঝেমধ্যে এনজিও আয়োজিত সভা-সেমিনারে অতিথি বক্তা হয়ে স্থানীয় সরকার নিয়ে অসার বক্তব্য বেশ জোর গলায় দিয়ে থাকে; আবার এদেরই সঙ্গে যুক্ত রয়েছে উভয় মিডিয়ার বেশকিছু সংবাদ-উপস্থাপক কর্মকর্তা, যাঁরা এর মাধ্যমে আর্থিক সুযোগসুবিধা পায় এবং স্থানীয় সরকার বিষয় প্রচারে প্রকাশে সহযোগিতার নামে মোড়লি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে থাকে। পাশাপাশি, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক দলও খুঁজে পাওয়া যায়না, যেটির গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় ও তার ক্রমাগত উন্নয়নে উপযুক্ত কর্মসূচী রয়েছে, অথচ রাজনৈতিক দলগুলি সবসময় স্থানীয় সরকারের উন্নয়নে লিপ সার্ভিস দিয়ে থাকে; এসব দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সময়ে সময়ে বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিগণকে ব্যবহার করে থাকে। জাতীয় সংসদীয় নির্বাচনের সময় এসব দলের কিছু চতুর নকলবাজ ব্যক্তি দলীয় ইশতেহারে স্থানীয় সরকার নিয়ে নকলের মহড়া দিয়ে থাকে। এই সব চতুর নকলবাজ ব্যক্তিরা কখনো কারো আইডিয়া ও শোগান, কারো প্রণীত ও প্রস্তাবিত বিষয় ও কর্মসূচী নিয়মনীতি মেনে গ্রহণ করতে চায়না; এরা শুধু নকলেই সিদ্ধহ¯ত, এরা বুদ্ধিবৃত্তিক চোর, অর্থ ও সম্পদ চোর তো বটেই। অথচ এরাই স্ব স্ব দলের কাছে সম্মানীয় বুদ্ধিজীবী! আর জনগণেরও একটা বিরাট অংশ উপজেলা নির্বাচনকালীন সময়ে পাওয়া আদর আপ্যায়নেই তুষ্ট থাকে। নির্বাচনের পরে কি হল তা তাঁদের নজরদারির ও তদারকির বিষয় হিসেবে থাকে না। সর্বোপরি বলা যায়, উপজেলা হচ্ছে একটা মিথ, একটা মিথ্যা নোশান। আর গোটা জাতি এই মিথ্যার বেড়াজালেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
অনুরূপভাবে, গোটা জাতি আরও একটা মিথ, একটা মিথ্যা নোশানের বেড়াজালে ঘুরপাক খেয়ে আসছে, তা হল, ইউনিয়নের মধ্যে প্রতিটি গ্রামে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন সময়ে অপ্রয়োজনীয় ইউনিট যেমন স্বনির্ভর গ্রাম সরকার, পলী পরিষদ, গ্রাম সভা, গ্রাম পরিষদ, গ্রাম সরকার ও ওয়ার্ড সভা গঠন করা নিয়ে অহেতুক মাতামাতি। ইউনিয়ন হচ্ছে স্থানীয় সরকারের মৌলিক গ্রামীণ ইউনিট; অথচ তার গণতন্ত্রায়ন ও প্রকৃত উন্নয়নে মনোযোগী না হয়ে নতুন দল গঠন করার জন্য ও কেবল দলগত স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে ইউনিয়নের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় এসব ইউনিট গড়তে জাতীয় অর্থ ও সময়ের বিপুল অপচয় করা হয়। এসবের সঙ্গে যুক্ত থেকে যেসব ব্যক্তি নানাবিধ ফায়দা লুঠেছে, বই-পু¯তক লিখেছে, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ সেজেছে, দাতা সংস্থার টাকায় সভা-সেমিনার করেছে, নতুন নতুন এনজিও গঠন করেছে, তারা এখনো মাঝেমধ্যে ওইসব অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের পক্ষে আড়ালে-আবড়ালে সাফাই গাইতে দেখা যায়। তবে ইউনিয়নের মধ্যে ওইসব প্রতিষ্ঠান গঠনের অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে সিডিএলজি’র লাগাতার ক্যাম্পেইন এর কারণে এসব ব্যক্তির জোরগলা বেশ ক্ষীণ ও দূর্বল হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, স্থানীয় সরকার নিয়ে এসব মিথ এর মূলে কুঠারাঘাতের শুরু হয় ১৯৯৭ সালের ১৩ জানুয়ারী থেকে। কারণ ওই দিনই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা’ উপস্থাপিত করা হয়, এবং সে থেকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন সূচিত হয়; আর এই আন্দোলনই স্থানীয় সরকার সম্পর্কে যত রকমের মিথ, মিথ্যা নোশান, আনফাউন্ডেড নোশান রয়েছে তা আ¯েত আ¯েত দূরীভূত করে আসছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, কার্যকর ও স্থায়ী না হওয়া পর্যšত সিডিএলজি’র এই বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন অবশ্যই চলতে থাকবে।
সে যাই হোক, বাংলাদেশের প্রয়োজন হচ্ছে দ্বি¯তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার; একটি কার্যকরী গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পেতে হলে দুই ¯তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকারই স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে; দুইয়ের চেয়ে বেশী স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার থাকলে তা হবে মধ্যবর্তী ইউনিট; আর তার অস্তিত্ব হবে কেবলই সাময়িক। ২০২০ সাল ও ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ও বিশ্ব প্রেক্ষিতে পরিবর্তনশীল বিষয়গুলি বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় সরকার ও গণতন্ত্রায়ন বিষয়ক গবেষক আবু তালেব স্থানীয় সরকারের ¯তরবিন্যাসকরণ (১) ও (২) প্রণয়ন করেছেন। উক্ত স্তরবিন্যাসকরণদ্বয়ে মধ্যবর্তী ইউনিট হিসেবে উপজেলা কীভাবে আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাবে তা রেখাচিত্রের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে; ওই প্র¯তাবিত ¯তরবিন্যাসকরণদ্বয়ে গোটা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কীভাবে দুই ¯তরবিশিষ্ট হয়ে যাবে তা গ্রাফ এর মাধ্যমে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে; এতে ২০৫০ সাল নাগাদ একটি পরিপূর্ণ নগরীয় বাংলাদেশ ও তখনকার কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার একটি কল্পিতরূপ রেখাচিত্রের মাধ্যমে দৃশ্যমান ও বোধগম্য করা হয়েছে। এখানে জানিয়ে দেয়া উচিত হবে যে, ২০২০ সাল ও ২০৫০ সাল ভিত্তিক বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা সাজানোর জন্য এটি হচ্ছে প্রথম প্রস্তাবিত পরিকল্পনা, প্রথম দৃষ্টান্ত, যেটি প্রতিনিয়ত দেশের অন্যসব ক্ষেত্রের জন্য ২০২০ সাল ও ২০৫০ সাল ভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়নে সবাইকে অনুপ্রাণিত করে আসছে। আজকে যারা ২০২০ সাল ও ২০৫০ সালের কথা বলছে, তার উৎস ও অনুপ্রেরণা হচ্ছে ওই রূপরেখা ও ওই ¯তরবিন্যাসকরণ। তাই, জাতীয় নীতিনির্ধারকদের প্রতি অনুরোধ রইল, প্রস্তাবিত ¯তরবিন্যাসকরণদ্বয় আরো ভালভাবে জানুন এবং তা আরো গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করুন। আমরা তো সবসময় বলে আসছি, আগে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট ও সর্বনিম্ন ইউনিটদ্বয় প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করুন। স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট বিভাগ না জেলা তা আজ অবধি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত হয়নি; বিভাগ স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট হলে উপজেলার পাশাপাশি জেলাও হয়ে যাবে মধ্যবর্তী ইউনিট; আর জেলা স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট হলে বিভাগকে অবশ্যই বিলুপ্ত করতে হবে। এই কঠিন কাজটি করার দায়িত্ব কোনো সরকারই নিতে চায় না। সর্বোচ্চ ইউনিট ও সর্বনিম্ন ইউনিটদ্বয় নির্ধারিত না হলে ক্ষমতা ও দায়িত্ব ঠিকঠাক হবেই বা কেমন করে? সর্বোচ্চ ইউনিট এবং সর্বনিম্ন ইউনিটদ্বয়ে ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রদান করার পর মধ্যবর্তী ইউনিট তথা উপজেলায় ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেয়ার মত কিছু থাকলেই তো দেয়া যাবে। স্থানীয় সরকারের এসব জটিল ও কঠিন বিষয়গুলির একটি সুনির্দিষ্ট সমন্বিত সমাধান “গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা”য় সর্বপ্রথম ১৯৯৭ সালের ১৩ জানুয়ারী ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠিত এক জাতীয় সেমিনারে হাজির করেছেন স্থানীয় সরকার ও গণতন্ত্রায়ন বিষয়ক গবেষক আবু তালেব। এই রূপরেখার অনেক জনপ্রিয় বিষয় চতুর নকলবাজরা নকল, কাটছাট ও বিকৃত করার পরও এর সমন্বিত রূপের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব একটুও খাটো হয়নি। বরং এই রূপরেখার কালজয়ী উপযোগীতা বেড়েই চলেছে। তাই, সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ রইল, আর কাল বিলম্ব না করে এই রূপরেখার প্রতিটি বিষয় স্থাপন ও কার্যকর করার প্রকৃত উদ্যোগ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ (নকল নয়) করুন, এবং এর বা¯তবায়ন প্রক্রিয়ায়, প্রয়োজন হলে, সিডিএলজি’র সহায়তা গ্রহণ করুন। বাপসনিউজ।

হাকিকুল ইসলাম খোকন:
লেখক,সাংবাদিক,রাজনীতিক,সদস্য ও মুখপাএ সিঊিএলজি :ইঊএসএ
৯১৭-৮৩৭-৪৭০০