বর্জ্যরে কি আর শেষ আছে? ঃ সব বর্জ্যই বর্জনীয়

MIR ABDUL ALIMমীর আব্দুল আলীমঃ ঈদে গ্রামের বাড়ি এসে ভালোই কাটল সময়টা। গাঁও গ্রামে কোরবানির ঈদে পশু বর্জ্যরে গন্ধ পুর্তি নেই; গ্রামের সহজ সরল মানুষ আর প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়ায় ক’টা দিন বেশ ফুড়ফুড়ে মেজাজেই ছিলাম। একটি খবর কেন যেন নাড়া দিলো মনে। কোরবানির বর্জ্য ফেলা হয়েছে যত্রতত্র। তার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। এমন দুগন্ধময় পরিবেশে ঈদের পর দিন ডাস্টবিনে পাওয়া গেলো এক মানব শিশু; বর্জ্য হিসেবে। খোদ রাজধানীর মীরপুরে জীবিত নয় মৃত হিসাবে এক-দু’দিন বয়সী ফুটফুটে এ ছেলেসন্তানকে ডাস্টিবিন থেকে উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ঈদের রাতে কে বা কারা তাকে উচ্ছিষ্ট হিসাবে ফেলে চলে গেছে। কোরবানির পর যে পশু বর্জ্য পাড়ায় মহল্লায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুগন্ধ ছড়াচ্ছে, সে বর্জ্য সাফ্ হয়নি এখনও, এরই মাঝে এ মানব বর্জ্য ফেললো কোন পাষন্ড? আসলে বর্জ্য উৎপাদনে কতক মানবের যত সুখ! একান্তে বর্জ্য উৎপাদনে হাজার হাজার টাকা খরচ করতেও এসব আদম সন্তানদের কোন দ্বিধা নেই। আর এই সুখ-বর্জ্য জন্ম নিল যে মানব-শিশু তাকে কিনা ফেলে আসে ডাস্টবিনে! এ বর্জ্য বড় লোকের ণিক আনন্দের বর্জ্যই হোক, কোন পাপিষ্ঠ ধর্ষকের সুখ বর্জ হউক আর ছোট লোকদের সস্তা নিশ্চিত বিনোদনের বর্জ্যই হোক, আসলে কাউকে কিছুতেই মা করবে না ডাস্টবিনে পরে থাকা মৃত এ শিশু।
বর্জ্যরে কি আর শেষ আছে? রাজধানীর ধানমণ্ডি ২৭ এর একটি ওভারব্রিজ। সেই ওভারব্রিজের চারপাশ ভর্তি থাকে নষ্ট লোকে সস্তা সুখ-রস বিনিময়ের হাটের বর্জ্য হিসেবে- বর্জ্য রাজা। এতে ধাতব ব্রিজের কোন তি হয় না। যা তি হয় কমলমতি শিশু আর উঠতি বয়সের যুবক-যুবতী যারা ওভারব্রিজের উপর দিয়ে চলতে গিয়ে দেখে ওসব; তখন তাদের কচি মনের নিউরনে চাপ পড়ে। যারা এসব গোপন বর্জ্য গোপনস্থানে না ফেলে যত্রতত্র ফেলে তাদের মনের ভেতরকার বর্জ্যও দুর হওয়া দরকার। কোরবনির বর্জ্যরে সাথে তাদের মনের বর্জ্যর পরিস্কার করে নেয়া চাইই চাই।
বর্জ্যতো বর্জ্যই; সেটা যে বর্জ্যই হোক। হতে পারে তা মনের ভেতরকার কুৎসিত কুলসিত বর্জ্য, রাস্তা ঘাটে, ডাষ্টবিনে পরে থাকা উচ্ছিষ্ট বর্জ্য। মনের বর্জ্য, ঘরের বর্জ্য, পথে-ঘাটের বর্জ্য এসব কেবল বর্জই। সব বর্জ্যই বর্জনীয়। বর্জ্য ফেলে দেয়া না হলে বিষ বর্জ্যে মন কুলষিত হয়, ঘর দুর্গন্ধে ভরে যায়, রাস্তাঘাটে চলা দায় হয়ে পড়ে। বর্জ্যে মিশ্রিত পরিবেশ আর মন বর্জ্যরে কারনে আমরা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছি। এসব বর্জ্য মানুষকে দিনদিন দুষিত করে তুলছে। তবুও কতক মানুষ এসব বর্জ্যকে থোরায় কেয়ার করছে। মনের ভেতরে নষ্টামির বর্জ্য, কুটনীতি আর দুর্নীতির বর্জ্য গোটা জাতিকে বিষাক্ত করে তুলছে। এসব বর্জ্যে বিপর্যসত্ম হয়ে পরেছে গোটা দেশ ও সমাজ।
ঈদ আসে অন্দনেব্দর বার্তা নিয়ে। ঈদ আসে সকল গ্লানি, রাগ ক্রোধ ধুয়ে মুছে দিতে। এমন আনন্দ ক্ষণে পশু বজের্র সাথে আমাদের মনের এ নষ্ট বর্জ্যও ধুঁয়ে মুছে ফেলতে হয় এটাই ইসলামের বিধান। পশুর বর্জ্য ধুয়ে মুছে সাফ্ করা গেলে পরিবেশ রা, স্বাস্থ্য রা হবে, আর মনের ময়লা আবজর্না দুর হলে সমাজে অন্যায়, অনাচার-অবিচার, হানাহানী দুর হবে। কোরবানির পশুর আবজর্না আমরা নিজেরাই সাফ্ করতে পারি, সুইপার কিংবা বদলি লোক দিয়েও তা সাফ্ করা যায় কিন্তু মানুষের মনের বর্জ্য দুর করতে পারে এমন সাধ্য কার? নিজেই নিজের মনের ভেতরকার বর্জ্য দুর করতে হয়। এ জন্য ইচ্ছা শক্তি লাগে। মনের বর্জ্য দুর করা গেলে পরিচ্ছন্ন মানুষ পরিচ্ছন সমাজ পাবে। মনে রাখতে হবে মনের ময়লা সাফ্ হলে অন্তর পবিত্র হয়। একটি হারিকেনের চিমনিতে প্রতিদিন ময়লা পড়ে পড়ে এমনভাবে কালো হয়ে যায় যে, ভেতরের আলো পর্যন্ত দেখা যায় না। কিন্তু প্রতিদিন যদি একবার যথাযথ প্রক্রিয়ায় ওই চিমনিটি পরিষ্কার করে ফেলা হয় তবে আর আলো আড়াল হয় না। এইতো দেখেছি ছোট বেলায়। অনুরূপভাবে মানুষের দিল-মনও প্রতি মুহূর্তে পাপ-কালিমা দ্বারা কালো হতে থাকে। তাই যদি এসব পাপরাশি পরিষ্কার হয়ে যায় তাহলে মানুষের অন্তরচু খুলে যায়, সাথে অন্তকরণও জাগ্রত থাকে।
কোরবানির বর্জ্য নিয়ে লিখছি কিন্তু কিসব ছাইপাস বর্জ্য নিয়েই সময় পার করে দিলাম। গত ৬ অক্টোবর ত্যাগের মহিমায় পালিত হয়েছে পবিত্র ঈদুল আজহা। ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী পশু কোরবানির মাধ্যমে এই ঈদ পালন করেন মোসলমানরা। কিন্তু কোরবানির পর অনেকেই যেখানে-সেখানে বর্জ্য ফেলে রাখেন। কোরবািনর পশুর রক্ত বজর্র আবজর্না এখনো কোথাও কোথাও দুরগন্ধ ছড়াচ্ছে। পরিবেশ রায় এসব ধুঁয়ে মুছে সাফ্ করা দররকার। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ। আমরা ধর্মীয় বিধান কোরবানি পালনে আমরা অনেক আগ্রহী হলেও কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণে সচেতন নই। যত্রতত্র কোরবানির বর্জ্য ফেলার দু’দিন পরই সারা দেশে পূতি-দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। অনেক রোগব্যাধিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায় এগুলো। কোরবানি মানি, কিন্তু বর্জ্য অপসারণ ইসলামের ইমানের অঙ্গ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি মানি না। ফলে দেশে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো বর্জ্য অপসারণ ও ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খায়। জনগনের অসহযোগীতার কারনে কোরবানির সময় প্রায় ১ কোটি পশুর বর্জ্য হাইজেনিকভাবে তাদের একার পে অপসারণ করা সম্ভব নয়। যত্রতত্র বর্জ্য পড়ে থাকার কারণে প্রধান সড়কগুলোতেও যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন যারা কোরবানি দিয়েছেন তারা নিজেরাও। যখন এ লেখাটি লিখছি কোরবানির তৃতীয় দিন অতিবাহিত হলেও বর্জ্য অপসারণে ব্যর্থ হয়েছে ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহীসহ সকল সিটি করপোরেশন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে প্রশাসন। রাজধানীর অলি-গলিতে এখনও কোরবানির পশুর রক্ত ও বর্জ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এসব বর্জ্যে দুর্গন্ধে ক্রমশই ভারি হয়ে উঠছে রাজধানীর বাতাস। রাজধানীর মূল সড়কগুলো থেকে বর্জ্য অপসারণ করা হলেও অপসারিত হয়নি রাজধানীর অলিগলির বর্জ্য। নগরীর বিভিন্ন এলাকার মূল সড়কগুলো আবর্জনামুক্ত হলেও পাড়া-মহল্লার ভিতরে আবর্জনার স্তূপ পড়ে রয়েছে। এ অবস্থা কোরবানি বর্জ্য নিয়ে শঙ্কায় আছে পরিবেশবাদীরা। অনেক সময় পশুর রক্ত ও বর্জ্য পদার্থ যথাস্থানে ফেলা নিয়ে অবহেলা করা হয়। অনেক সময়ই খোলা স্থানে পড়ে থাকতে দেখা যায়। অথচ এসব বর্জ্য ও উচ্ছিষ্ট থেকে ছড়াতে পারে নানা রোগব্যাধি। সৃষ্টি হতে পারে বিষাক্ত ও অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি। তাই কোরবানির পর নিজেরা সুস্থ থাকতে সবারই এ বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কোরবানির বর্জ্য মাটিতে পুঁতে রাখাই ভালো। কিন্তু যারা শহরে থাকেন, তাদের পে কোরবানির বর্জ্য মাটিতে পুঁতেফেলা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এসব বর্জ্য তারা একটি নিদৃষ্ট স্থানে না রেখে বর্জ্যগুলো যত্রতত্র ফেলে রাখে। গ্রামের মানুষের পশু বর্জ্য মাটিতে পুতে রাখার সুযোগ থাকলেও অলসতার কারনে অনেকেই তা কনে না। ফলে গ্রামেরও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
বর্জ্য কেন পরিবেশ দুষন করবে? আমরাতো উল্টো বর্জ্য থেকে দেশ শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। অর্থ অর্জন নয়, এখন বর্জ আমাদের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যহানী ঘটাচ্ছে। আমরা অনেকেই জানি না পশুর বর্জ্য কী এবং এসব বর্জ্য আমাদেও কী কী কাজে লাগে। মূলত পশুর বর্জ্য হলো গরুর চামড়া, হাড় শিং, নাড়ি, ভুড়ি, প্যানিস, মুত্র থলি, রক্ত, চর্বি পিত্ত বা চামড়ার ওয়েষ্টেজ অংশ। এসব বর্জ্যের সবই শতভাগ রফতানিযোগ্য। সাধারণ মানুষ এই রফতানিযোগ্য বর্জ্য সম্পর্কে জানে না। এ ব্যাপারে সচেতন না থাকার কারণে শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশ হারাচ্ছে রফতানি বাজার। পশুর চামড়া থেকে তৈরি হয় জুতা, জ্যাকেট, বেল্ট, ব্যাগ ও অন্যান্য সামগ্রী। এছাড়াও বিভিন্ন ঔষধ তৈরিতে ব্যবহার হয় পশুর হাড়। তাই চামড়ার কাট, ছাট, লেকসাট, ফেকাট ও পশুর হাড়ের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে মাংস শ্রমিকদের প্রশিণের আওতায় আনতে হবে। অভিযোগ আছে রফতানিযোগ্য পশুর বর্জ্য রার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বার বার আবেদন করা হয়েছে কিন্তু তাতে কোনো সাড়া নেই। পশুর বর্জ্য ও তার কার্যকারিতা সম্পর্কে আমদের জানতে হবে। এ বিষয়ে মিডিয়া ও সরকার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারে। ভাবাকি যায় এ পশু বর্জ্যইে তৈরি হয় জীবন রক্ষাকারী কেপসুলের কভার। তাই জীবন বাঁচাতে জীবন সাজাতে পশুর বর্জ্য অপরিহার্য। তাই আসুন যথা সময়ে পশু বর্জ্য অপসারন করি এবং এগুলোকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে সহায়তা করি। সাথে মনের বর্জ্যও অপসারন করে সমাজ তথা দেশকে সাজাতে, দেশকে জাগাতে এগিয়ে আসি।
লেখক : মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট, [email protected] )