‘গোপনে’ সিটি করপোরেশনের বাজেট প্রণয়ন, জানেন না কাউন্সিলররাই!
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে মেয়র বরখাস্ত; আইনি জটিলতায় ভারপ্রাপ্ত মেয়রও কেউ নেই। এ অবস্থায় অভিভাবক শূণ্য সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) চলতি অর্থ বছরের বাজেট প্রণয়নও হলো অনেকটা গোপনে!
অন্যান্য বছর মেয়র ও কাউন্সিলরদের পরিষদ নাগরিকদের বাজেট প্রণয়ন করে সাড়ম্বরে তা প্রকাশ করেন। কিন্তু চলতি বছর অর্থ ও সংস্থাপন কমিটি বাজেট প্রণয়নের পর তা আর করপোরেশনের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। অনেক কাউন্সিলর বাজেট হয়েছে কি-না, তাও জানেন না বলে দাবি করেছেন।
এনিয়ে কাউন্সিলরদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে, রয়েছে হতাশাও। মেয়রের অনুপস্থিতিতে মাসিক সভা হচ্ছে না বলে নিয়ম অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেট অনুমোদন করা হয়নি। শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য বাজেট প্রণয়নের পর তা মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাধারণ নাগরিকের মত সিসিকের সংশ্লিষ্টদের অনেকেও এবারের বাজেট সম্পর্কে কিছু জানেন না! সংশ্লিষ্ট কমিটি চলতি বছরের খসড়া বাজেট প্রণয়ন করলেও তা মাসিক সাধারণ সভায় অনুমোদন করা হয়নি।
কিবরিয়া হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামী হয়ে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী কারাগারে যাওয়ার পর আর কোনো মাসিক সাধারণ সভাই হয়নি। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণের পর আরিফকে মেয়র পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। মেয়রের অনুপস্থিতিতে প্যানেল মেয়রের একজন ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালনের নিয়ম রয়েছে। এক্ষেত্রে মন্ত্রনালয় থেকে ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজাউল হাসান লোদী কয়েসকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়। কিন্তু অন্য কাউন্সিলরদের বাঁধায় তিনিও দায়িত্ব নিতে পারেননি। আরেক প্যানেল মেয়র ও ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে তার আইনি লড়াইয়ের জন্য তাদের কেউ-ই দায়িত্ব নিতে পারছেন না।
এ অবস্থায় মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে সিসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব করপোরেশনের প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্ব পালন করছেন।
চলতি বছরের বাজেট প্রণয়নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, করপোরেশনের অর্থ ও সংস্থাপন কমিটি বাজেট তৈরি করে দিয়েছে এবং তাদের অনুমোদন নিয়েই চলতি অর্থ বছরের বাজেট নিয়মমত মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে।
নগরবাসীর অবগতির জন্য বাজেট উপস্থাপন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাধারণত মেয়র সাহেবরা জাকজমকভাবে প্রতি বছর বাজেট উপস্থাপন করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রাক বাজেট আলোচনাও হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের এখানে মেয়র নেই, ভারপ্রাপ্ত মেয়র নিয়েও জটিলতা রয়েছে। তাই করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কমিটি বাজেট তৈরি ও অনুমোদন করে দেওয়ার পর তা মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সিসিকের অর্থ ও সংস্থাপন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন প্যানেল মেয়র অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদ চৌধুরী। এতে সদস্য হিসেবে আছেন ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ তৌফিকুল হাদী, ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল মুহিত জাবেদ, ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাকবির ইসলাম পিন্টু ও সংরক্ষিত ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বেগম কুহিনুর ইয়াসমিন ঝর্না।
সিটি করপোরেশনের আইন অনুযায়ী অর্থ ও সংস্থাপন কমিটি খসড়া বাজেট প্রণয়ন করার পর পরবর্তিতে তা করপোরেশনের মাসিক সাধারণ সভায় উপস্থাপন করে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। পাশাপাশি নিয়ম রক্ষার জন্য হলেও সাধারণ নাগরিকের মতামত নিয়ে থাকেন করপোরেশনের মেয়ররা। প্রতি বছর নির্বাচিত মেয়ররা বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নাগরিকদের নিয়ে প্রাক-বাজেট আলোচনা করে থাকেন।
এ প্রসঙ্গে সিসিকের অর্থ ও সংস্থাপন কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদ চৌধুরী বলেন, গত জুন মাসের শুরুতেই আমরা খসড়া বাজেট প্রণয়ন করেছি। কিন্তু এখনও মাসিক সাধারণ সভা না হওয়ায় তা অনুমোদন হয়নি। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সাধারণ সভায় বাজেট অনুমোদনের পর তা সুধী সমাবেশে উপস্থাপন করে সকলের পরামর্শ নেওয়া হয়।
সিটি করপোরেশনকে ‘জনপ্রতিনিধি কেন্দ্রীক সেবা প্রতিষ্ঠান’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, মেয়রের অনুপস্থিতিতে নগরীর উন্নয়নে স্থবিরতা নেমে এসেছে। আমলা (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) দিয়ে করপোরেশনের কার্যক্রম চলতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাস্তাঘাটের বেহাল দশাই এর প্রমাণ। করপোরেশনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
সিসিকের ভারপ্রাপ্ত মেয়র পদ নিয়ে তার সঙ্গে আইনি লড়াই করা কাউন্সিলর রেজাউল হাসান লোদী কয়েস বাজেটের ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন। কাউন্সিলর হিসেবে তিনি করপোরেশনের শিক্ষা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান উল্লেখ করে বলেন, কাউন্সিলর হিসেবে আমি বিগত ১২ বছর ধরে বাজেট সম্পর্কে জেনে আসছি। অতীতে বাজেট প্রণয়নের সময়ও আমাদের পরামর্শ নেওয়া হয়। কিন্তু চলতি বছর কেউ তার কোনো পরামর্শ নেয়নি বা বাজেট হয়েছে বলেও তিনি জানেন না বলে দাবি করেন। এভাবে করপোরেশন চলতে পারে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নগরীর ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমেদও জানান, বাজেটের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না।
সিসিক সূত্র জানায়, চলতি অর্থ বছরের জন্য ৩শ ১৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকার বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে; যাতে যথারীতি আয়-ব্যয় সমান ধরা হয়েছে। বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৭৬ কোটি ২৮ লাখ ৫ হাজার এবং রাজস্ব ব্যয় ৩৯ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এতে ব্যয়ের অন্যতম বড় খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে সংস্থাপন, শিক্ষা ও আর্থিক সহায়তা, স্বাস্থ্য ও পয়:প্রনালী, ময়লা নিষ্কাষন, মশা ও কুকুর নিধন, পানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎ বিল এবং রাস্তা ও অবকাঠামো উন্নয়ন। এর মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই সর্বোচ্চ ৪৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে রাস্তা ও অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে। সংস্থাপন খাতে ১৯ কোটি ১৬ লাখ ব্যয়ের তালিকায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এছাড়া পানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎ বিল খাতে ৭ কোটি ৭১ লাখ, স্বাস্থ্য ও পয়:প্রনালী, ময়লা নিষ্কাষন, মশা ও কুকুর নিধন খাতে ৬ কোটি ৮০ লাখ ৭৫ হাজার এবং শিক্ষা ও আর্থিক সহায়তা খাতে ২ কোটি ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
বিশাল এই বাজেটে আয়ের খাতে অর্ধেকেরও বেশি টাকা প্রাপ্তির মূল ভরসা সরকারী এবং বিদেশী সহায়তা। এই খাতে সম্ভাব্য আয় ধরা হয়েছে ১শ ৬৩ কোটি ২৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। পাশাপাশি সরকার প্রদত্ত উন্নয়ন সহায়তা, মঞ্জুরী খাতে আরো ২০ কোটি টাকা আয় ধরা হয়েছে। নিজস্ব খাতের মধ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স থেকে সর্বোচ্চ ৪৭ কোটি ২২ লাখ টাকা আয় হবে বলে বাজেটে উল্লেখ করা হয়। যদিও এক্ষেতে বিগত বছরগুলোতে গড়ে ২৫ শতাংশেরও কম আদায় হয়েছে বলে সিসিক সূত্র জানায়। এছাড়া স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর খাতে ৬ কোটি, ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স বাবদ ৩ কোটি, ইমারত নির্মাণ ও পূন:র্নিমান খাতে ২ কোটি, দরপত্র ও সিডিউল বিক্রি বাবদ ৬ কোটি ২০ লাখ এবং পানির মাসিক বিল ও অন্যান্য খাতে ২ কোটি ৫৫ লাখ ১০ হাজার টাকা আয় ধরা হয়েছে।