৬৮ বছরের প্রতীক্ষা : মধ্যরাতে মুছে যাচ্ছে ছিটমহল
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ শুক্রবার ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহল ইতিহাসের যবনিকা ঘটছে। এ দিনটির জন্য ছিটবাসীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ৬৮ বছর। আজ এ দিনটিকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্মরণে রাখবে বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরের ১৬২টি ছিটমহলের ৫৬ হাজারেরও বেশি অধিবাসী। এক দেশের নাগরিক হয়ে আরেক দেশে অবস্থান করার নাগরিকত্বহীনতার অবসান হচ্ছে আজ। এ খুশির আনন্দে ভাসছে ছিটমহলের বাসিন্দারা। মাস নয়, সপ্তাহ নয়, শুধুমাত্র আর কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা।
ছিটমহলের অবসানের দিনটি ঘিরে কয়েকদিন ধরেই চলছে ব্যাপক আয়োজনের প্রস্তুতি। সারাদিন বিভিন্ন খেলাধুলা শেষে সন্ধ্যার পরই আলোতে ডুববে গোটা ছিটমহল। বাড়ি বাড়ি জ্বলবে মোমবাতি আর প্রদীপ। আতশবাজী ফুটিয়ে আর আলো জ্বালিয়ে আনন্দ প্রকাশ করবে ছিটবাসীরা।
২০১১ সালের যৌথ হেড কাউন্টিং বা জনগণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিটমহলে মোট জনসংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার ৩৬৪ জন। আর ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে ছিল ১৪ হাজার ২২৫ জন। চলতি মাসে যৌথ জনগণনায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহলে জনসংখ্যা ৩ হাজার ৭১৮ জন বেড়ে হয়েছে ৪১ হাজার ৪৪৯ জন। আর ভারতের অভ্যন্তরের বাংলাদেশি ছিটহলের জনসংখ্যা ৬৩১ জন বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৮৫৬ জন। উভয় দেশের মধ্যকার ১৬২টি ছিটমহলের বর্তমান জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৩০৫ জন।
ভারতের অভ্যন্তরের বাংলাদেশি ছিটমহল থেকে কোনো নাগরিক বাংলাদেশে আসার জন্য ফরম পূরণ করেনি। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ছিটমহল থেকে ৯৭৯ জন ভারতে যাওয়ার জন্য চূড়ান্তভাবে নিবন্ধিত হয়েছেন। এর মধ্যে পঞ্চগড়ের ৩৬টি ছিটমহল থেকে ৪৮৩ জন, লালমনিরহাটের ৫৯টি ছিটমহলের ১৯৫ জন এবং কুড়িগ্রামের ১২টি ছিটমহল থেকে ৩০১ জন। যদিও নীলফামারীর ৪টি ছিটমহল থেকে কেউ ভারতে যাওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেনি।
বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এসব নাগরিকদের থাকার জন্য আপাতত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার এলাকায় অস্থায়ী শিবির নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সেখানে তাদের রেখে পরবর্তিতে তাদের জন্য স্থায়ী আবাসনসহ কাজের ব্যবস্থা করবে রাজ্য সরকার।
পঞ্চগড় জেলা সদরের গারাতি ছিটমহলের শালবাগানের অধিবাসী বয়োবৃদ্ধ আনার আলী (৭০) বলেন, আমার জন্ম বাংলাদেশে হলেও কালক্রমে ছিটমহলের নাগরিক হয়ে গেছি। কিন্তু ছিটমহলের ছোট্ট ভূখণ্ডের চারপাশ বাংলাদেশি এলাকা হওয়ায় বন্দি জীবনযাপন করতাম। চুরি-চামারি করে বাংলাদেশের বাসিন্দা দেখিয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতাম। কিন্তু ছিটমহলের নাগরিক হিসেবে জানাজানি হওয়ায় তাদের লেখাপড়ার ইতি ঘটতোত। দীর্ঘদিনের ঘটনাবহুল ইতিহাসের সফল পরিসমাপ্তির দারপ্রান্তে আমরা। এখন সব দুঃখ ভুলে গেছি। এখন জীবনের শেষ সময়টুকু একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকে দেখে যেতে পারব। খাঁচায় বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে আমরা আসছি আলোয়। এর চেয়ে আর কি আনন্দ হতে পারি।
এ ব্যাপারে ওই ছিটমহলের নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার সভাপতি মফিজার রহমান বলেন, ছিটমহল বিনিময়ের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে আমরা দিনে-রাতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। আজ শুক্রবার আমাদের ছিটমহলে দিনব্যাপী চলবে বিভিন্ন ধরণের খেলাধুলা। বিকেলে ‘চুক্তির মুক্তি’ নামের একটি নাটক মঞ্চস্থ হবে। সূর্যাস্তের পরই প্রতিটি মুসলমান সম্প্রদায়ের বাড়িতে ৬৮টি করে মোমবাতি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে ৬৮টি করে প্রদীপ জ্বালিয়ে সব অন্ধকার দূর করে দেব। আর রাতভর চলবে গান-বাজনা আর আলোর খেলা। রাতে পটকা ফুটিয়ে জানান দেব আমরা আজ থেকে বাংলাদেশি নাগরিক।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ শাখার সহ সভাপতি ও পঞ্চগড় সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট বলেন, ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময়ের পর আমরা উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে গারাতি ছিটমহলে দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করব। ঢাকা থেকে শিল্পী এনে দিনভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করব। সেই সাথে ছিটমহলে শুরু হয়ে যাবে উন্নয়নমুলক কাজ।