আল কুদস দিবস ও আজকের প্রেক্ষাপট

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

পবিত্র রমজানের শেষ শুক্রবারকে বিশ্ব আল কুদ্স দিবস। বিশ্ববাসী বিশেষ করে মুসলমানেরা প্রতি বছর এ দিনটি বিশ্ব আল কুদ্স দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন।
ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ এবং প্রথম কেবলা ‘মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস’ সুপ্রাচীন শহর জেরুসালেমে অবস্থিত। মহানবী সা: মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদুন্নবী ও মসজিদুল আকসার উদ্দেশে সফরকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, যা অন্য কোনো মসজিদ সম্পর্কে করেননি। এর গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী সা: বলেছেন, ‘ঘরে নামাজ পড়লে এক গুণ, মসজিদে ২৫ গুণ, মসজিদে নববী ও আকসায় ৫০ হাজার গুণ, মসজিদে হারামে এক লাখ গুণ সাওয়াব’ (ইবনে মাজাহ)।
হজরত ইবরাহিম আ: কর্তৃক কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর হজরত ইয়াকুব আ: জেরুসালেমে আল-আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন। অতঃপর হজরত সুলায়মান আ: জিনদের মাধ্যমে এই পবিত্র মসজিদের পুনর্র্নিমাণ করেন। ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে পুরো বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকা মুসলমানদের অধীনে আসে। ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা নামধারী মুসলিম শাসকদের সহায়তায় সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। এরপর তারা ১০৯৯ সালের ৭ জুন বাইতুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে এবং ১৫ জুলাই মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গির্জায় পরিণত করে।
১১৬৯ সালের ২৩ মার্চ। ফাতেমি খিলাফতের কেন্দ্রীয় খলিফার নির্দেশে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী র: গভর্নর ও সেনাপ্রধান হয়ে মিসরে আগমন করেন। এরপর ১১৮৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিম বীর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী র: জেরুসালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। অতঃপর ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর শুক্রবার সালাহউদ্দিন আইয়ুবী র: বিজয়ীর বেশে বাইতুল মুকাদ্দাস প্রবেশ করেন। বাইতুল মুকাদ্দাস মুক্ত হওয়ার পর সেখানকার মুসলিমরা প্রায় ৯০ বছর পর ক্রুসেডারদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেয়েছিল।
হিজরতের এক বছর আগে ২৭ রজব মিরাজের রাতে মহানবী সা: প্রথমে তারা বাইতুল আকসায় উপনীত হন। বোরাককে বাইরে বেঁধে মহানবী সা: মসজিদে প্রবেশ করেন এবং সেখানে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। এ প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাঁকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য’ (সূরা বনি ইসরাইল, ১৭:১)। মহানবী সা: মিরাজ শেষে পুনরায় মসজিদুল আকসায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং ইমাম হয়ে নবী-রাসূলদের নিয়ে নামাজ আদায় করেন।
মহানবী সা: মদিনায় হিজরত করার পর প্রায় ১৬ মাস মসজিদুল আকসার দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হিজরি দ্বিতীয় সনের শাবান মাসে মতান্তরে রজব মাসের মাঝামাঝি মহানবী সা: কিছু সাহাবায়ে কিরামসহ মদিনার অদূরে মসজিদে বনু সালামায় জোহর মতান্তরে আসর নামাজ আদায় করেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাকাতের মাঝামাঝি আল্লাহর নির্দেশে মহানবী সা: ও সাহাবায়ে কিরাম চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজের দুই রাকাত কাবা শরিফের দিকে ফিরে আদায় করেছিলেন বিধায় ইসলামের ইতিহাসে মসজিদটি মসজিদে কিবলাতাইন বা দুই কিবলা হিসেবে সুপরিচিত ও সমাদৃত।
আল কুদস হলো মুসলিম উম্মাহর প্রথম কেবলা খ্যাত মসজিদুল আকসা, প্রিয় বায়তুল মোকাদ্দাস। এর অবস্থান ইসরাইল অধ্যুষিত জেরুসালেমে। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আল কুদস সংবলিত পবিত্র শহর জেরুসালেম জায়নবাদী শক্তি ইসরাইলের দখলে চলে যায়। আজো মুসলিম উম্মাহর তৃতীয় মর্যাদাপূর্ণ আল আকসা মসজিদ ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে। পবিত্র এই মসজিদে জায়নবাদীরা আগুন দিয়েছে, বারবার বিব্রত ও উত্ত্যক্ত করেছে, মুসলিমদের জুমার নামাজ আদায়ে বাগড়া দিয়েছে বহুবার।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল একটি বিষফোঁড়া। ইঙ্গো-মার্কিন শক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই কৃত্রিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এটি ভূমিপুত্রদের কোনো স্বাভাবিক রাষ্ট্র নয়। সারা দুনিয়া থেকে ইহুদিদের তুলে এনে ইসরাইলে তাদের বসতি পত্তন করা হয়।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনি রমজানের শেষ জুমাবারে আল কুদস দিবস পালনের ডাক দিয়েছিলেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ব মুসলিম গভীর আবেগ আর ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে দিবসটি পালন করে আসছে।
আল কুদস দিবসের মর্মকথা হলো কুদসের মুক্তি, পবিত্র শহর জেরুসালেমের মুক্তি। কুদসকে মুক্ত করার আকুতি আর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে মরক্কো থেকে তিউনিসিয়া পর্যন্ত কোটি কোটি মুসলিম দিবসটি পালন করে। সত্যি বটে, আল কুদস আজো মুক্ত হয়নি। কিন্তু কুদস মুক্তির চেতনা আরব বসন্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে তিউনিসিয়া, ইয়েমেন ও মিসরে। আপসকামিতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হামাসের নেতৃত্বে জেগে উঠেছে ফিলিস্তিনের অজুত মানুষ। আর দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর হাতে পর্যুদস্ত হয়ে ২০০৬ সালে জায়নবাদীদের ফৌজ প্যাভিলিয়নে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। পরমাণু গবেষণা নিয়ে তুলকালাম কা- বাধালেও দৃঢ়প্রত্যয়ী ইরানকে অবদমিত করা যায়নি। এ সবই তো আল কুদস দিবসের প্রেরণা।
বিশ্বজনমতকে থোড়াই পরোয়া করে ইঙ্গো-মার্কিন শক্তির মদদপুষ্ট জায়নবাদীরা ফিলিস্তিনে ইনতিফাদাকে দমন করার জন্য কম কোশেশ করেনি। ট্যাংকবহরের চাপে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ফিলিস্তিনি বসতি। পাখির মতো গুলিতে ঝাঁজরা করেছে আবালবৃদ্ধবনিতাকে। তাতে আন্দোলন থামেনি। মধ্যপ্রাচ্যে আপসের বড় হোতা হোসনি মোবারকের গদি উল্টে গেছে। মিসরের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল ইসলামি শক্তি। কিন্তু মুরসির জায়নবাদবিরোধী সরকারকে অগণতান্ত্রিক কায়দার হটিয়ে দিয়ে মিসরীয় সেনাবাহিনী পাশ্চাত্যের এক শিখ-ী সরকার বসিয়েছে। জনগণ তা মেনে নেয়নি। এই তো সেদিনের কথা, লেবাননে হিজবুল্লাহর হাতে ২০০৬ সালে ইসরাইলি বাহিনী নাস্তানাবুদ হয়। ফিলিস্তিনেও প্রতিরোধের শক্ত দেয়াল গড়ে তুলেছে হামাস। অদূরে সুসংহত ইরান। পাকিস্তানেও সেকুলার পিপিপিকে পর্যুদস্ত করে সরকার পরিচালনা করেছে নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী ইসলামি শক্তি। লিবিয়ায় নো ফাই জোনের নামে যেভাবে সেখানকার বিমানবন্দর, ভূমিতে অবস্থানরত বিমানবহরে মার্কিন নেতৃত্বধীন বহুজাতিক বাহিনী আঘাত করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে, সিরিয়ায় তা পারেনি। এখানে নো ফাই জোনের নামে এয়ারপোর্ট ও গ্রাউন্ডেড এয়ারক্রাফট ধ্বংসের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়ন করা যায়নি। লিবিয়ার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাশিয়া ও চীন নো ফাই জোনকে শর্তসাপেক্ষে স্যাংশন দেয়। ফলে সিরিয়াকে তামা করা যায়নি। জায়নবাদীদের পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। গোটা মুসলিম জাহানে জায়নবাদী ইঙ্গো-মার্কিন শক্তির পদলেহী শাসকগোষ্ঠী এখন পালাবদলের মুখে। এ অবস্থায় বেচায়েন জায়নবাদী ইসরাইল আর তাদের পৃষ্ঠপোষক ইঙ্গো-মার্কিন শক্তি। তারা ইরাককে গ্রাস করেছে। আফগানিস্তানও তাদের হাতের মুঠোয়। পাকিস্তানকে ড্রোন হামলা দিয়ে চরম অস্বস্তিতে রেখেছে। আর আসাদ-বিরোধীদের অস্ত্রসজ্জিত করে সিরিয়াকে মৃত্যুর উপত্যকায় পরিণত করেছে। আরব বসন্তে মিসর, তিউনিসিয়া ও ইয়েমেনে মোবারক, বেন আলী ও আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানে জনতা একটি বুলেটও খরচ করেনি। শান্তিপূর্ণ গণজাগরণের তোড়ে ভেসে গেছে ক্ষমতার মসনদ। তাহলে সিরিয়ায় কেন এই ভিন্ন পন্থা। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, হিজবুল্লাহর প্রতি সমর্থনই আসাদ ও সিরিয়ার আসল অপরাধ। হিজবুল্লাহর হাতে চরম নাস্তানাবুদ হওয়ার কথা তেলআবিব ভোলেনি। ভোলেনি লন্ডন-ওয়াশিংটনও। তাই তারা সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের অস্ত্রসজ্জিত করে ভয়াবহ রক্তপাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যেখানে গোটা আরবে শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলনের মুখে একের পর এক গণধিকৃত সরকারের পতন হচ্ছে, সেখানে সিরিয়ার জন্য জায়নবাদীদের দোসর পাশ্চাত্য শক্তি বেছে নিয়েছে ভাতৃঘাতী সশস্ত্র সঙ্ঘাতের পথ। এ পথে সিরিয়ার শক্তি ক্ষয় হবে, দেশটি ইরাকের মতো বিপর্যস্ত হবেÑ এই তাদের নীলনকশা। ইয়েমেনেও পাশ্চাত্যের ইন্ধনে আগ্রাসী হামলা অব্যাহত রেখেছে সৌদি আরব।
মিয়ানমারের আরাকানেও একাধারে চলছে রোহিঙ্গা তথা মুসলিম নিধন। নোবেলজয়ী অং সান সুচি ভোট হারানোর ভয়ে মুখে কুলুপ দিয়ে আছেন। শাসক কাউন্সিলের প্রধান আট লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠানোর আভাস দিয়েছেন। প্রতিদিন দলে দলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পুশইন করা হচ্ছে। আমাদের কোস্টগার্ড ও বিজিবি তাদের শুশ্রƒষা ও খাবার দিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশকে তাগিদ দিচ্ছে। কিন্তু সে জন্য কোনো তহবিল সংস্থান করা হচ্ছে না। অতীতে বাংলাদেশ বিপুল রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। তারা এখনো আশ্রয়শিবিরে অবস্থান করছে। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সংখ্যা পাঁচ লাখের কম নয়। এটি একটি বিরাট চাপ। এর ওপর আরো শরণার্থী আশ্রয় দেয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশ রাখে কি না, সেটিও দেখার বিষয়। তা সত্ত্বেও ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে পর্যাপ্ত অর্থায়ন হলে বাংলাদেশ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মিয়ানমার সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছে, কিন্তু রাখাইন রাজ্যে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনীর নির্যাতনমূলক কর্মকা-ের ব্যাপারে গণতন্ত্রপন্থী অং সান সুকির নীরব ভূমিকায় বিশ্ববিবেক হতাশ ও ক্ষুব্ধ। জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ওই রাজ্য থেকে ৮০ হাজার লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। সেখানকার সহিংসতা দমনে পাঠানো নিরাপত্তাবাহিনী উল্টো মুসলমানদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার। রাখাইন মুসলিমদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতন, ভীতিপ্রদর্শন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের নিয়মিত খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের বক্তব্যেও সেনাবাহিনীকে সমর্থনের সুর ফুটে ওঠে। তিনি বলেছেন, আট লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখতে হবে এবং সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে হবে। তার কথার সাথে তেলআবিবের দ-মু-ের কর্তাদের বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়।
রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টির জন্য রোহিঙ্গারাই দায়ী বলে মনে করছে মিয়ানমারের সরকার। সরকারের ধারণা, রাখাইন প্রদেশে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের জন্য রোহিঙ্গারা দায়ী এবং ভবিষ্যতে তারা আঞ্চলিক ক্ষমতা দখল করতে পারে। তাই মিয়ানমার সরকার স্পষ্ট বলে দিয়েছে, তারা রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব কেন নেবে? এরা তো মিয়ানমারের নাগরিক নয়। ১২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে বসবাস করলেও দেশটির সরকার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না; বরং সরকারের মতে, রোহিঙ্গারা সে দেশের আদিবাসী নয়, কয়েক দশক আগে আগত অভিবাসী। রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহারেও তাদের অনীহা। রোহিঙ্গার বদলে ‘বাঙালি মুসিলম’ বলতে বেশি আগ্রহী। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের ভ্রান্ত ধারণা পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া রাখাইন রাজ্যে দুই পক্ষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অসম্ভব। সেখানে রোহিঙ্গাদের জীবন নিরাপত্তাহীন আর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। মাহে রমজানেও উগ্র বৌদ্ধরা রাখাইন (আরাকান) প্রদেশে মসজিদে আগুন দিয়েছে। এ অবস্থায় মুসলিম উম্মাহকে রোহিঙ্গাদের সমর্থনে সোচ্চার হতে হবে।
কেবল সিরিয়া নয়, রক্তের নহর বইছে আমাদের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্য আসামে। আসাম মুসলিমপ্রধান রাজ্য হলেও দেশ বিভাগের সময় তা ভারতের অংশে নেয়া হয়। রাজ্যটি থেকে সিলেট জেলাকে পাকিস্তানে দিয়ে বাদবাকি আসাম ভারতের ভাগে পড়ে। আসামের অর্থনীতিতে মুসলমানেরা সামনের কাতারে। কৃষিজমির অধিকার ও আবাদ, ব্যবসায় ও শিল্পের পরিচালনায় তারাই শীর্ষে। হিন্দুত্ববাদীরা কি তা মেনে নিতে পারে। তাই অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার পর শুরু হলো মুসিলম নিধনের আরেক অধ্যায়।
আসামের দাঙ্গাকে বোড়ো আদিবাসী ও সংখ্যালঘু মুসলিমদের দাঙ্গা বলে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু কার্যত এটি মুসিলমবিরোধী দাঙ্গা। এর পেছনে ভারতের সাম্প্রদায়িক দলগুলোর যেমন ইন্ধন আছে, আছে নিরাপত্তাবাহিনীর পক্ষপাতও। সহিংসতার কেন্দ্রস্থল কোকড়াঝাল জেলায় লাগাতার কারফিউ ও সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র গুলির আদেশ দিয়েও হত্যা-হনন বন্ধ করা যায়নি। পাশের দুই জেলা চিরা ও ধুবড়িতে ও কারফিউ ছিল বেশ কিছুদিন। আশ্রয়শিবিরে বেড়েছে ভয়ার্ত মানুষের ভিড়। আশ্রিত চার লাখের বেশির ভাগই মুসলিম।
আসাম ও রাখাইনের মুসলিমরা আজ নিজ দেশে পরবাসীর মতো। মধ্যপ্রাচ্যে পান থেকে চুন খসে পড়লে যারা গেল গেল বলে শোরগোল তোলেন, এ দু’টি এলাকায় ব্যাপক মুসলিম নিধন ও নির্যাতনে তারা নির্বিকার। তাদের শ্যেনদৃষ্টি এখন সিরিয়ায়। এরা দেশটিকে মধ্যপ্রাচ্যের ভাগাড় বানাতে চায়। এরপর হয়তো টুঁটি চেপে ধরতে চাইবে ইরানকে। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় শান্তি নিয়ে চিন্তিত নয়। আসাদের পতন হলে ২৬ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান হবে, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এক কথা, আসাদকে বিদায় নিতে হবে। অথচ আসাদ সরকার কফি আনান মিশন মেনে নিলেও সশস্ত্র বিদ্রোহীরা আনানের শান্তি পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে। হতাশ কফি আনান ইস্তফা দেন। নতুন জাতিসঙ্ঘ দ্রুত লাখদার ব্রাহিমির দূতিয়ালিও ব্যর্থ হয়। সিরিয়ায় চলমান সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা ও তার মিত্ররা তৃতীয়বারের মতো পরাজিত হতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। আমেরিকা ও ইসরাইল আরেকবার মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের আগুন জ্বেলে দিয়ে এ অঞ্চলে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিল। কিন্তু হিজবুল্লাহর কাছে ৩৩ দিনের যুদ্ধে ও হামাসের কাছে ২২ দিনের যুদ্ধে পরাজয়ের মতো এবারের যুদ্ধেও পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। কেননা সিরিয়ার চলমান যুদ্ধ ওই দুই যুদ্ধেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। উল্লেখ্য, বিশ্বসাম্রাজ্যবাদী ও জায়নবাদী শক্তি ২০০৬ সালে লেবাননের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহকে নির্মূল করার জন্য দক্ষিণ লেবাননে হামলা চালায়। কিন্তু দীর্ঘ ৩৩ দিনের কঠিন, জটিল ও বিভীষিকাময় যুদ্ধের পর ইসরাইলি বাহিনী লেবানন থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর ২০০৯ সালের শেষভাগে জায়নবাদী শক্তি হামলা চালায় গাজা উপত্যকায়। সেখানেও ২২ দিনের যুদ্ধে নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটে ইসরাইল। ওই যুদ্ধে হামাসের বিজয় বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। তাই মুসলিম উম্মাহর ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
লর্ড কার্জনের সেই উদ্ধত উক্তি- ‘আমরা মুসলিমদের মেরুদ- খিলাফতকে ধ্বংস করে দিয়েছি, তারা আর দাঁড়াতে পারবে না। তারা সেই সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কবরে লাথি মেরে বলেছিল, ওঠো সালাহউদ্দিন! তোমরা বাইতুল মুকাদ্দাসকে রক্ষা করো।’… আর আমরা কী করলাম? পেরেছি কি সেই খিলাফতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে? পেরেছি কি সেই বাইতুল মুকাদ্দাসকে রক্ষা করতে? আজ সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাতিলের মোকাবেলার।