রমযানঃ বিজয়ের মাস
ড.এ এইচ এম সোলায়মান
বিশ্ব মানবতাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে নাযিল হয়েছিল মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। এতে মানব জীবনের প্রতিটি দিকের সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। তাই বলা হয়ে থাকে The holy Quran is the complete code of life.
মানব জাতিকে যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। সেহেতু সৃষ্ট জীব এই পৃথিবীতে কিভাবে তার ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনা করবে তার ব্যবস্থা স্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উপর নাযিল করেন ক্বদরের রাত্রিতে (১ম আকাশে) মহাগ্রন্থ আল কুরআন। উল্লেখ্য যে, সে দিন থেকে পরিপূর্ণ কুরআন নাযিল হতে সময় লাগে দীর্ঘ ২৩ বছর। শুধু তাই নয় অন্যান্য আসমানী কিতাব ও রমযান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। যেমন- ইবনে আব্বাস (রা.) রাসূল (সা.) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, (ক) ইব্রাহীম (আ.)-এর উপর সহীফা সমূহ নাযিল হয়েছে রমযানের প্রথম রাতে। (খ) মূসা (আ.)-এর উপর ইব্রানী ও হিব্রু ভাষায় তাওরাত নাযিল হয়েছে ৬ রমযান (গ) দাউদ (আ.)-এর উপর ইউনানি ভাষায় যাবুর নাযিল হয়েছে- ১২ রমযান (ঘ) ঈসা (আ.)-এর উপর সুরইয়ানি ভাষায় ইঞ্জিল নাযিল হয়েছে- ১৩ রমযান।
আর কুরআনের আলোকে কুরআনী সমাজ গঠনের মাধ্যমে রাসূল (সা.) মাত্র
কয়েক বছরের ব্যবধানে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ উপহার দিয়েছিলেন। সে হিসেবে আজকের এ সমস্যা বিক্ষুব্ধ সমাজকে শান্তির নিবাসে পরিণত করতে কুরআনী সমাজ বিনির্মাণের বিকল্প নেই। এজন্য কুরআনের সমাজ বিনির্মাণের জন্য পবিত্র রমযান মাসকেই কাজে লাগাতে হবে। মনে রাখতে হবে সময় তার আপন গতিতে এগিয়ে চলছে। তবে আমরা মুসলিমরা যেন দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি। বর্তমানে এমন একটি দিন কি আমরা অতিক্রম করেছি যে দিনটিতে অমুসলিমদের বুলেটের আঘাতে কোন মুসলমান প্রাণ হারায়নি? পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমানদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। মায়ের সামনে হত্যা করা হচ্ছে তার ছেলেকে। একজন ইরাকি বাবা তার সন্তানের লাশকে হাতে নিয়ে বলেছিলেন: আজ পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু আমার হাতে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, একজন বাবার কাছে তার সন্তানের লাশ অপেক্ষা ভারি বস্তু আর
কি হতে পারে। প্রায় প্রতিদিনই ইহুদিদের মোকাবেলায় ফিলিস্তিন, আফগান, ইরাকী মুসলমানদের প্রাণ দিতে হচ্ছে। কেন আমাদের এই দুরাবস্থা? কেন আমাদের রক্তের হুলি খেলায় মেতে উঠছে অমুসলিম বিশ্ব? মুসলিম মিল্লাত কেন আজ চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে? আসলে আজ আমরা ইসলামের মূল থেকে আদর্শচ্যুত হয়ে গিয়েছি। আমাদের হৃদয় থেকে উঠে গেছে ঈমানের সঠিক স্পৃহা। আমরা ভুলে গিয়েছি বিজয়ের ইতিহাস। অথচ পবিত্র রমযান মাসেই ইসলামের অনেকগুলো বিজয় সংঘটিত হয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় ১. ২য় হিজরীর ১৭ই রমযান বদর প্রান্তরে সূচিত হয়েছিল ইসলামের প্রথম বিজয়। যেখানে ১০০০ শত্রুর মোকাবেলায় মাত্র ৩১৩ জন মুসলিম সৈন্য বিজয় অর্জন করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন “আর এতো সুনিশ্চিত যে, আল্লাহ বদর যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছিলেন। অথচ তোমরা ছিলে দূর্বল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যেন তোমরা শোকর গুজারী করতে পার। (আল ইমরান- ১২৩)। ২. ৫ম হিজরীর রমযান মাসে মুসলমানরা আহযাব বা খন্দক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ৩. ৮ম হিজরীর ২০শে রমযান মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে ইসলামের চূড়ান্ত বিজয় রচিত হয়েছিল। যেথায় দশ হাজার আত্মোৎসর্গী সৈন্য ও পথিমধ্যে অন্যান্য আরব গোত্র ও মিলিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্বে রক্তপাতহীন মক্কা বিজয় অর্জিত হয়। কাবাঘর থেকে সকল মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়। ৪. ৯ম হিজরীর রমযান মাসে তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) পবিত্র রমযান মাসে অনেকগুলো সারিয়্যা প্রেরণ করেন। (সারিয়্যা হলো সে সমস্ত যুদ্ধ, যাতে রাসূল (সা.) প্রতিনিধি প্রেরণ করেছেন এবং তথায় কালেমার পতাকা ছিল) প্রথম হিজরীতে “সারিয়্যা হামজা”, ২য় হিজরীতে “সারিয়্যা উমায়ের বিন আদী”, ৬ষ্ঠ হিজরীতে “সারিয়্যা উম্মে কারকা”, মিকার বিরুদ্ধে “সারিয়্যা গালিব”, জুহাইনার হুরুকাতের বিরুদ্ধে “সারিয়্যা উসামা”, দশম হিজরীতে ইয়ামনে “সারিয়্যা আলী” প্রেরণ করেন। সবগুলো সারিয়্যাতে মুসলমানগণ জয়লাভ করেন।
৫. ১৫ হিজরীর ১৩ই রমযান দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব (রা.)-এর
হাতে জেরুজালেম বিজয় হয়। ৬. ২০ হিজরীর ২রা রমযান ‘আমর বিন আস’ বাহিনীর হাতে রোমান সাম্রাজ্য পর্যুদস্ত হয়।
৭. ৯২ হিজরীর রমযান মাসে তারেক বিন যিয়াদের হাতে স্পেন বিজয় হয়।
৮. ৯৩ হিজরীর ৯ই রমযান মুসা বিন নুসাইর স্পেনে পরিপূর্ণ জয়লাভের জন্য আক্রমন করেন।
৯. ৯৬ হিজরীর রমযান মাসে মোহাম্মদ বিন কাসিমের হাতে অত্যাচারী সিন্ধু
রাজা পরাজিত হয়। (প্রশ্নোত্তরে রমযানের ত্রিশ শিক্ষা, ডা. জাকির নায়েক, পৃ: ২৫১)
আর ইসলামের বিজয়ের জন্য তাকওয়া অর্জনের বিকল্প নেই। মহান আল্লাহ তা’আলা তাকওয়া অর্জনের জন্য আমাদেরকে দুটি বিষয় একত্রে দিয়েছেন। সিয়াম ও কুরআন। কিন্তু দু:খজনকভাবে আমরা সিয়াম নিয়েছি এবং কুরআন বাদ দিয়েছি। এজন্য প্রকৃত ও পরিপূর্ণ তাকওয়া অর্জন করতে পারছি না। আর কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য হলো যেন মানুষেরা তা বুঝে, চিন্তা করে এবং উপদেশ গ্রহণ করে। এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এক বরকতময় কল্যাণময় গ্রন্থ আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যেন তারা এর আয়াতসমূহ অনুধাবণ করে এবং বোধ শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে।” (ছোয়াদ-২৯) কুরআন হলো সকল বিজ্ঞানের মূল ও মানব জীবনের গাইডবুক। সুতরাং কুরআনকে বুঝতে হবে। কুরআন যত বেশী বুঝার চেষ্টা করা হবে তত বেশি মধু পাওয়া যাবে। মধুর বোতলে মধুর ঘ্রাণ মিলে সত্য। তবে মধুর স্বাদ মিলেনা। তেমনই কুরআন তেলাওয়াত করলে সওয়াব মিলে সত্য। তবে কুরআনের জ্ঞান মিলেনা। আর কুরআনী জ্ঞান আহরণ করা এবং সেই অনুযায়ী আমল করাই কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তারা কি কুরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করেনা। না-তাদের অন্তর তালাবদ্ধ”। (সূরা মুহাম্মদ-২৪)
অতএব কুরআন কেবল তেলাওয়াত করলেই হবে না বরং কুরআন বুঝতে হবে, অধ্যয়ন করতে হবে, আর তেলাওয়াতের প্রকৃত অর্থ হলো ‘পিছে চলা’ বা ‘অনুসরণ করা’। শুধুমাত্র না বুঝে পাঠ করলে তিলাওয়াত হয় না। তিলাওয়াত মানে পাঠের সময় মন পঠিত বিষয়ের পিছে চলবে, এরপর জীবনটাও তার পিছনে চলবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “যাদেরকে আমি কিতাব প্রদান করেছি তাঁরা তা হক্বভাবে তেলাওয়াত করে, তারাই এই কিতাবের উপর ঈমান এনেছে।” (বাক্বারা- ১২১)
পরিশেষে বলা যায় যে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে কুরআনী হুকুম মেনে চলতে হবে, জালিমকে বাধা দিতে হবে, মজলুমকে রক্ষা করতে হবে, দ্বীন প্রতিষ্ঠায় হতে হবে অদম্য। তাই আজ জেগে জেগে ঘুমাবার সুযোগ নেই। আজ প্রয়োজন গতানুগতিক চিন্তাধারার অক্টোপাস থেকে বেরিয়ে কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ও ইসলামের পূর্ণ মর্যাদা রক্ষার্থে খালিদ বিন ওয়ালিদ, তারিক বিন যিয়াদ ও সালাউদ্দিন আয়ুবির মত বিশ্বে সাড়া জাগানো গাজিদের ন্যায় অসীম সাহসের সাথে দ্বীন কায়েমের জন্য এগিয়ে আসা। তাহলেই আমরা ফিরে পাবো হারানো সম্মান, মুক্তি পাবে মজলুম মানবতা, বিজয়ী হবে ইসলাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “বরং আমি সত্যকে মিথ্যার ওপর ছুঁড়ে মারি, অত:পর সে (সত্য) এ (মিথ্যা)-র মগজ বের করে দেয়, (এর ফলে যা মিথ্যা) তা সাথে সাথেই নিশ্চিন্ন হয়ে যায়; দুর্ভোগ তোমাদের, তোমরা যা কিছু উদ্ভাবন করছো (তা থেকে আল্লাহ তা‘আলা অনেক পবিত্র)” (সূরা আম্বিয়া- ১৮)।
ড.এ এইচ এম সোলায়মান
প্রিন্সিপাল, সিলেট ক্যাডেট মাদ্রাসা
লেখক ও গবেষক