রাজনীতির শেষ গন্তব্যে হাসিনা, দল হয়ত হয়ে যাবে গন্তব্যহীন

Hasinaমাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে ১৯৮১ সালের ২০ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের ভয়াবহ ট্রাজেডির দিন থেকে দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত তিনি জীবনের সবচেয়ে কষ্টের ও কঠিনতম দিনগুলো অতিবাহিত করেছেন। এরপর দেশে ফিরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসাবে দলকে সংগঠিত ও রাষ্ট্রক্ষমতায় অধীষ্টিত করবার জন্য এগিয়ে যেতে থাকেন। এক দিকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে মোকাবেলা এবং অন্যদিকে ‘শত্রুর শত্রু’ জেনারেল এরশাদের সঙ্গে হিসাব নিকাষের রাজনীতির ছকে সাজিয়ে ফেলেন ঘঁুিটগুলো সব। বিএনপিকে টার্গেট করেই তিনি এক একটা চাল দিতে থাকেন। এরুপ এক চালে এরশাদ জীবন ফিরে পায় ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে। বিএনপিকে ‘টার্গেট’ করা সে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ কিছু না পেলেও এরশাদ টিকে যায় ’৯০ সাল পর্যন্ত।
তবে শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি খান এরশাদ পতন পরবর্তী ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম সংসদ নির্বাচনে। সে নির্বাচনে প্রায় নয় বছর ধরে বিভিন্নভাবে আক্রান্ত ও পর্যদুস্ত বিএনপির কাছে আওয়ামী লীগের পরাজয় নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ কল্পনা করেনি। খুব বেশি হতাশ হয়ে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। দলে শুরু হয় গৃহদাহ। কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হন ড. কামাল হোসেন। অনেক নাটকীয়তার পর শেখ হাসিনা তার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন। বিএনপি সরকারকে একদিনও শান্তিতে না থাকতে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে তিনি আবার রাজনীতিতে ও রাজপথে সক্রিয় হন। এরপর বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করলে হাসিনা জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথের আন্দোলনে সফলতা অর্জন করেন।
১৯৯৬ সালে আন্দোলন পরবর্তী ১২ জুনের নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি ও জাসদের সমর্থনে আওয়ামী লীগ ঐক্যমতের সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। ২৩ জুন নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের পর ২৪ জুন সকল পত্রিকায় লাল হরফে ব্যানার হেডলাইন হয় ‘হাসিনা প্রধানমন্ত্রী’। ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ এর পর এটাই ছিল আওয়ামী লীগের স্বপ্নপূরণ ও শেখ হাসিনার রাজনীতির সর্বোচ্চ সফলতা। এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেখ হাসিনা মেয়াদ পূর্ণ করেন। তার শাসনামলের শেষ বছরে দেশ প্রথম বারের মত দুর্নীতিতে প্রথম হয়। নির্বাচনের কয়েকমাস আগে টিআইবি’র এ রিপোর্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। এ ছাড়া সামাজিকভাবে সন্ত্রাস বেড়ে যায় এবং সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের পৃষ্টপোষকতার অভিযোগ আসে। এসব কারণে ২০০১ এর সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয় এবং ২১ বছর পর ক্ষমতাসীন হওয়া আওয়ামী লীগ আবার বিরোধী দল হয়ে যায়।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকেন্দ্রিক বিতর্কে ২০০৬ এর শেষে দেশে অরাজকতা তৈরি হয়। এ সুযোগে সেনাসমর্থিত মইনুদ্দিন -ফকরুদ্দিন এর দুই বছরের জরুরি শাসন শেষে ২০০৮ এর নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয় এবং আওয়ামী লীগ আবারও রাষ্ট্র ক্ষমতায় যায়। কিন্ত ২০১০ সালের ১৯ জুন চট্রগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং ২০১১ সালে সারাদেশে অনুষ্টিত পৌরসভা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ক্রম হ্রাসমান জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। জনগণের ভোটে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসা আওয়ামী লীগের জন্য অনিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্ত এবার আর শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেত্রী হয়ে রাজনীতিতে থাকতে চান না। প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম মেয়াদে শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন যে ৬০ বছর বয়স হলে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন। পরবর্তীতে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। তবে তিনি আর কখনোই বিরোধী দলের রাজনীতি করবেন না। যতদিন রাজনীতিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী হয়েই থাকবেন।
রাজনীতির বাকি দিনগুলো প্রধানমন্ত্রী থাকার ইচ্ছা থেকেই শেখ হাসিনা অনেকগুলো সফল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংসদীয় কমিটির সাথে মতামত প্রদানে মাত্র একজন বাদে সকলেই এবং সকল পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। প্রতিটি জনমত জরিপ এবং এদেশের প্রায় সকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে থাকলেও তা অগ্রাহ্য করা হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই। পঞ্চদশ সংশোধনী এ পরিকল্পনারই মাষ্টার প্লান। যতদিন বর্তমান সংবিধান এবং প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচন হবে ততদিন প্রধানমন্ত্রীকে বিরোধী দলীয় নেত্রী হতে হবে না এটা এখন নিশ্চিত হয়েছে। ২০১৩ সালের অক্টোবরে শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে বর্তমান সংবিধান থেকে তিনি একচুলও নড়বেন না। তিনি কথা রেখেছেন। রাজনীতির বাকি দিনগুলোতেও তিনি বর্তমান সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পরিবর্তনের বিপক্ষে অবিচল থাকবেন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। প্রধানমন্ত্রীত্বের বাইরে তিনি আর কোনো রাজনৈতিক পদবী গ্রহণ করবেন না।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনীতির এ শেষ গন্তব্যে পৌঁছানের কারণে এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ভোট ও বিরোধী দল দুটোই এখন নির্মূল হওয়ার পথে। নির্বাচন ছাড়াই সরকার গঠন সম্ভব হয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকার হওয়ার সাথে এবং সরকারে টিকে থাকার সাথে জনগণের প্রয়োজন এবং সম্পর্ক কোনোটাই নেই। আবার উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে আগামীতে সকল নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এরুপ বিজয় অব্যাহত থাকবে।
যেদিন থেকে শেখ হাসিনা বিরোধী দলে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করেছেন সেদিন থেকেই এদেশের রাজনীতির সংস্কৃতি পাল্টে গেছে। হাসিনা সরকার আর কখনোই বিরোধী দলে যাবেনা কারণ তিনি এ দেশে বিরোধী দলের জন্য কোনো রাজনীতি রাখেননি। আবার বিরোধী দলকে তিনি যে পরিণতির সম্মুখীন করেছেন সে পরিণতিও তিনি রাজনৈতিক জীবদ্দশায় ভোগ করবেন না। তাই তিনি যতদিন রাজনীতি করবেন গণভবনে থেকেই করবেন। রাজনৈতিক জীবনে এখান থেকে হয়ত বঙ্গভবনে যাবেন, মিন্টোরোডে কখনোই নয়। তবে আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ গন্তব্যের শেষে বাংলাদেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হয়ত হয়ে যাবে গন্তব্যহীন।

লেখক:
সাম্য শরিফ
ই-মেইল: [email protected]