বাংলা নববর্ষ ও মুসলিম সংস্কৃতি
সুরমা টাইমস রিপোর্টঃ ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বঙ্গ বিজয় করেন ১০০৩ খ্রিস্টাব্দে। তখন এ দেশে একমাত্র হিজরি সনের প্রচলিত ছিল। এরপর প্রায় ৩৬৩ বছর পর্যন্ত ভারতবর্ষে এ তারিখের প্রচলন বহাল থাকে। সেকালে জমিতে ফসল উৎপাদনের সময়কালকে ভিত্তি করে খাজনা আদায় করা হতো। এ ক্ষেত্রে হিসাব করা হতো হিজরি সনের। কিন্তু হিজরি সন চন্দ্র মাসভিত্তিক হওয়ায় তা কোনো ফসলি মৌসুম মেনে চলত না। তাই খাজনা আদায়ের হিসাব-নিকাশ সংরক্ষণে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হয়।
তখন ছিল মোগল বাদশা সম্রাট আকবরের শাসনামল। তার শাসনামলের ২৯ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এ সমস্যা সমাধানের পন্থা নিয়ে কথা ওঠে। এর আশু সমাধান বের করতে আকবর তার রাজসভার রাজজ্যোতিষ বিজ্ঞ পণ্ডিত ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে নির্দেশ দেন। তিনি সম্রাটের নির্দেশ অনুযায়ী সৌরমাসভিত্তিক ফসলি সন প্রণয়ন করেন। সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ অনুযায়ী ২৮ রবিউস সানি ৯৬৩ হিজরি। সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণের এ স্মৃতিকে চিরভাস্বর করে রাখতে ফতেহউল্লাহ ১৫৫৬ সালের ১১ এপ্রিলকে পহেলা বৈশাখ ধরে ৯৬৩ সনকে মূল ধরে ফসলি সন গণনা শুরু করেন। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে এই ফসলি সন ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ ফসলি সনই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ নাম ধারণ করে।
এখানে বঙ্গাব্দের সঙ্গে হিজরি সনের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। ৯৬৩ হিজরিতে জন্মলাভ করে ৯৬৩ বছর ধরে গণনা শুরু অর্থাৎ জন্ম থেকেই বাংলা সনের বয়স ৯৬৩ বছর। তাই হিজরি সনকে বাংলা সনের ভিত্তি বলা চলে। যেহেতু চন্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষের মধ্যে ১১ দিনের পার্থক্য রয়েছে এজন্য এ দুটির মধ্যে সমতা রাখা সম্ভব হয়নি। এ থেকে স্পষ্ট যে, বাংলা সন মুসলিম সংস্কৃতিরই অঙ্গ।
আমাদের এই ভূখণ্ডটি বহুমাত্রিক সংস্কৃতির চর্চায় যুগ যুগ ধরে বৈচিত্র্যময়। এত সব বিচিত্র সংস্কৃতি পাশাপাশি সহাবস্থান করে চলছে_ এমনটা পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। আর যাই হোক, বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে আমরা গর্বিত জাতি। ভূখণ্ড, ভাষা ও ধর্ম_ এ তিনের উপাদানে সংস্কৃতির যে মূলস্তম্ভ্ভ গড়ে ওঠে তা এখানে বিশেষভাবে কার্যকর। আমাদের সংস্কৃতিতে ভূখণ্ড ও ভাষা_ এ দুটি উপাদানকে ছাপিয়ে গেছে ধর্ম। এজন্য আমাদের সংস্কৃতির পরতে পরতে এ উপাদানটির প্রভাব একটু বেশিই পরিলক্ষিত হয়। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মীয় বোধ ও বিশ্বাসের ধারক। এজন্য তাদের সংস্কৃতিটাও ধর্মীয় আবেশে আবর্তিত হয়েছে। আর যেহেতু ধর্মবিশ্বাসে এ দেশের সিংহভাগই মুসলিম, তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রচ্ছন্নতায় হলেও দেশীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের একটা স্ফুরণ অনুভব করা যায়।
সংস্কৃতি মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সুস্থ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সংস্কৃতির সুষ্ঠু চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে মন ও মননের বিকাশ ঘটে। সংস্কৃতির উৎপত্তি ও বিকাশের ধারায় ধর্মের অবস্থানকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। যে ধর্মের ওপর ভিত্তি করে সংস্কৃতির উৎপত্তি সেটা সে ধর্মেরই সংস্কৃতি। প্রত্যেক ধর্মেরই নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি থাকতে পারে। নিজস্ব সংস্কৃতির মাধ্যমেই সেই ধর্মের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রকাশ ঘটে। এর আবরণেই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় পর্বটাও সম্পন্ন হয়ে যায়। সে হিসেবে বাংলাদেশে বাস করে যারা বাংলায় কথা বলে এবং ইসলামী অনুশাসন মেনে চলে, তাদের সংস্কৃতিকে বাংলাদেশের মুসলিম সংস্কৃতি বলতে হবে।
পয়লা বৈশাখ আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ দিনটিকে শুধু বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে না ধরে বাংলাদেশের মুসলিম সংস্কৃতি বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। কেননা বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন প্রবর্তনের পেছনে অবদান মুসলমানদেরই। মুসলমানদের প্রয়োজনে মুসলিম সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই এর উৎপত্তি। সুতরাং পয়লা বৈশাখ উদযাপন করতে হলে সেটা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বোধ ও বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই পালন করা সমীচীন।