মাদকাসক্তি: কারণ, প্রতিকার ও পূনর্বাসন : মোঃ শামীম মিয়া
ভূমিকাঃ ড্রাগের নেশা সর্বনাশা, বেহুলা লখিন্দরের নি:শ্চিদ্র লৌহ বাসরে যে ভাবে কাল নাগ প্রবেশ করে দংশন করেছিলো। তেমনিভাবে সমাজের নিয়মনীতি কড়া পাহাড়া অতিক্রম করেছে এই ভয়ংকর নেশা মাদকাসক্তি। গ্রাস করে ফেলছে এই সমাজ, এই নেশা বা মাদকাসক্তি সমাজকে বিষবাষ্পে ভড়িয়ে তুলছে। যা আমাদের শিক্ষিত-অশিক্ষত, সচেতন-অসচেতন, ধনি-গরিব, নির্বিশেষে সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে এক ভয়াবহ ধ্বংস ও বিপর্যয়ের দ¦ারপ্রান্তে উপনীত করছে। যা ভয়ংঙ্কর আতঙ্কের বিষয়। আজ আমি আমরা সবাই খুব কষ্ট পাই, যে যুবক, যুবতী, তরুন, তরুনী, কিশোর, কিশোরী, সমাজ আমাদের এই দেশটাকে সোনার বাংলাদেশে পরিণত বা গড়বে তাদের হাতে মাদকাসক্তি। বিষাক্ত সাপ এই মাদকাসক্তি বন্ধু রুপে এসেছে, এই মাদকাসক্ত যুবকদের মাঝে। এই মাদকাসক্তি সেই বন্ধু, যে বন্ধু, বন্ধুর জীবন নামে ফুলটিকে ধংস করতে দ্বিধা করে না। এই মাদকাসক্তি সামান্য সুখ, আজীবনের দু:খ দিয়ে চলে যায়। এই মাদকাসক্তিকে আমি আপনি আমরা সবাই মুখে আশ্রয় না দিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিবো।
মাদকাসক্তি কী: সাধারণত যে সব দ্রব্য পান বা ব্যবহার করলে নেশা তৈরী হয়, আবার অভ্যাসে পরিণত হয় তাকে মাদকাসক্তি বলে। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য প্রদত্ত সংজ্ঞায় বলা হয়েছেঃ ড্রাগ হলো এমন বস্তু যা জীবন্ত জীব গ্রহণ করলে তার এক বা একাধিক কার্যকলাপের ঈষৎ পরির্বতন ঘটায়। মাদক দ্রব্যের ফলে একটি মানুষ তিলে তিলে নি:শেষ হয়ে যায়।
মাদকদ্রব্য হিসাবে বহু উপকরণ রয়েছে, (তবে একই মাদক দ্রব্য বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়) যেমন: ইয়াবা, আফিম, ড্যান্ডি, ভাঙ, মারিজুয়ানা, বাবা, এলএসডি, প্যাথেড্রিন, ফেনসিডিল, হেরোইন, চরস, পপি, মারফিন, হাসিস, কোকেন, ফ্যানাবিন, বোডেন, এক্সটেসি, থিরাইন, কোডেইন, সিডাকসিন, ব্যরিচুয়েট, রাম, গাজা, সিসা, রেক্টিফাইট, কেডিন, ব্রুুপ্রেনরফিন, টিডি জেসিক, ফার্মেন্টড, ইনজেকশন, রেক্টিফাইট স্প্রিট, টেরাহাইড্রোবানাবিল, আইসপিল, স্যানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, মিথাইল, ইথানল, কিটোন, জুতারআঠা, ইনোকটিন, সিডাক্সিন, জামবাক, টিকটিকির লেজ ইত্যাদি।
আরো আছে বাহুল্য পরিচিত মদ। মদকে দু-ভাগে ভাগ করা যায় যেমনঃ দেশি মদ এবং বিদেশি মদ। যেসব মদ দেশে তৈরী হয় তাকে দেশি মদ বলে। আর যেসব অন্য কোন দেশ থেকে আমাদের দেশে আশে তাকে বিদেশি মত বলে। দেশি এবং বিদেশী মদের বহু উপকরণ আছে যেমনঃ দেশি মদের নাম ঃ বাংলা মদ, দেশি মদ, তালের তারি মদ, পচাপানীয় মদ, অনন মদ, আসব মদ, ধেনো মদ, চোলাই মদ, কোডিন মদ, গিট্টু মদ, চুয়ানী মদ, টিটি◦ মদ, হর্স মদ, ডেন্টি মদ ইত্যাদি। বিদেশী মদের নাম যেমনঃ কারনসলিল মদ, বিদেশী মদ, কাভা মদ, জিন মদ, নিপা মদ, প্রুনো মদ, বিটাস মদ, বিয়ার মদ , ব্রান্ডি মদ, ভদকা মদ ইত্যাদি।
এদিকে তামাককেও মাদক বলা হয়। এই তামাকটি হচ্ছে একটি উদ্ভিদ থেকে সংগৃহীত পাতা যার আছে ৪০০০ রাসায়নিক পদার্থ। তামাকের বেশ কিছু উপকরণ আছে যেমন ঃ সিগারেট, বিড়ি, জর্দ্দা, গুল, মতিহাড়ী পাতা, গুলি তাক্কুর, সাদা পাতা, সিগার, চুরুট, খৈনি, মিস্কার ইত্যাদি।
এ সব নেশা সেবন, পান বা ব্যবহারে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হয় যেমন ঃ মানব শরীরের প্রতিটি অঙ্গ মাদক ও তামাকের ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্যান্সার, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ, কিডনি বিকল, ঘুমের ব্যাঘাত, হাটের বিভিন্ন রোগ, স্ট্রোক, চুলপড়া, চোখে ছানি পড়া, শ্বাসকষ্ট ও পায়ের পচন, খাদ্য লালিতে ক্যান্সার ইত্যাদি লক্ষন দেখা যায়।
মাদক এ জরিত হওয়ার বেশ কিছু কারণ লক্ষ করা যায় যেমনঃ তার প্রধান কারণ বিষন্নতা, টেনশন রোগ, অধিক হতাশা, প্রেমের ব্যর্থতা, বেকারত্ব, আর্থিক দৈনতা, নীতি ও আর্দশহীনতা, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, বড়দের প্রতি ছোটদের শ্রদ্ধাহীনতা, বিভ্রান্ত কুসঙ্গ, অধিক কৌতুহল প্রবনতা, বৈবাহিক ও পারিবারিক কলহ, মাদকের সহজ প্রাপ্তি, ব্যবসায় অধিক লাভের বাসনায়, অত্যধিক অর্থশালী হওয়া, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, জীবনের প্রতি আস্তাহীনতা, আইনি দুর্বলতা, অবৈধ অর্থ উপাজনের আধিক্য, ধর্মীয় অনুভূতির অভাব, অপরাধপ্রবণ, মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত সামাজিক পরিবেশ, যৌবনের বিদ্রোহী মনোভাব, পারিবারিক অনুশাসন না থাকা, সন্তানকে অতিরিক্ত শাসন করা ইত্যাদি।
প্রতিকারঃ ধর্মীয় অনুভূতি জাগরন, প্রচার মাধ্যমে আন্দোলন, দ্রারিদ্র বিমোচন ও কর্মস্থান, ইচ্ছা শক্তি, মাদকমুক্ত এলাকা গড়ে তোলা, পারিবারিক শান্তি, মাদকের সহজলভ্যতা বন্ধ, পূর্নবাসন ব্যবস্থা, মাদক সেবন কারির শাস্তিবাস্তবায়ন, চোরাচালান বন্ধ, চোরাচালান রোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো তৎপর, দক্ষ ও প্রশিক্ষন করে তুলতে হবে, সামাজিক আন্দোলন, চিকিৎসদের পরার্মশ, মাদকাসক্তি প্রতিরোধে বা প্রতিকারে মাদকের কুফল সম্পর্কে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা প্রসার ঘটানো, এবং জনসচেতনতা বাড়ানো ইত্যাদি।
পুনর্বাসনঃ মাদকাসক্তদের প্রথমে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। এ জন্য মাদকাসক্তদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো পূনর্বাসন। মাদক র্নিভরশীলতার চিকিৎসার পুনর্বাসন শব্দটি পুনরায় আবাসন অর্থে ব্যবহত হয়। অথাৎ মাদক ব্যবহার করে ব্যক্তি যা হারিয়ে ফেলেছেন, চিকিৎসার মাধ্যমে তা ফিরে পান। প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদী ও জটিল। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার ভেতর দিয়ে একজন মাদক নির্ভশীল ব্যক্তি শারীরিক-মানসিক ক্ষতি, ও পারিবারিক-সামাজিক বিছিন্নতা কাটিয়ে ঊঠে, মাদকমুক্ত জীবনের সুস্থ ধায়ায় ফিরে আসেন। এই পদ্ধতির শুরুতেই ব্যক্তিকে চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করা হয়। এক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগীতাপূর্ণ মনোভাব প্রয়োজন। পূনর্বাসন-প্রক্রিয়ার সাফল্য র্নিভর করে এ বিষয়গুলোর সমাধানের উপর। মনোসামাজিক চিকিৎসা (সাইকোথারাপি ও কাঊন্সেলিং) দীর্ঘমেয়াদী এ পূনর্বাসন প্রক্রিয়ার জন্য জরুরি। মাদকাসক্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পরেও সামাজিক নিগ্রহের শিকার হন, যে কারণে, সে সমাজ-বিচ্ছিন্নতায় ভোগে। এ জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরির্বতন জরুরি। কারণ সামাজিক কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ পূনর্বাসন-প্রক্রিয়ার একটি অনুষঙ্গ। মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তিকে মাদক মুক্ত করতে পুনর্বাসন চিকিৎসার বিকল্প নেই। উল্লেখ্য: পাশ্চাত্যে পুনর্বাসন পদ্ধতিই মাদকনির্ভরশীলতার চিকিৎসা।
উপসংহার: একবার মাদকাসক্ত হয়ে গেলে, সেখান থেকে ফিরে আসাটা কঠিন, তবে অসম্ভাব নয়। এই মাদক এর ক্ষতির দিক, পরকালের শাস্তি, ইহকালে সুন্দর ভাবে জীবন-যাপন করার কথা ভেবে আসুন, আমি আপনি আমরা সকলেই বলি মাদক নয়, সুন্দর জীবন চাই।