আন্দোলন ও নির্বাচন চলবে সমানতালে: বেকায়দায় ক্ষমতাসীনরা
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ নির্বাচনে গেলেও সরকার বিরোধী চলমান আন্দোলন বন্ধ করবে না ২০ দল। শুধু নির্বাচনী এলাকায় ২০ দল ঘোষিত কর্মসূচি শিথিল করা হতে পারে।
এদিকে রাজপথে আন্দোলনরত সরকার বিরোধী জোট নির্বাচনে যাওয়ার ইঙ্গিতে আওয়ামী শিবিরে টেনশন বেড়েছে। এমনিতেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সমর্থিত প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ করে দলের প্রভাবশালী নেতারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বিএনপি ছাড়াই ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, এখন আর সেটা হচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের জন্য সিটি নির্বাচন উভয় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ার আগেই অনেকটা নড়েচড়ে বসছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। শোনা যাচ্ছে, ইতিমধ্যে ঢাকার দুই সিটিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল তাদের সমর্থন পরিবর্তন করতে পারে। অন্তত একটিতে পরিবর্তন করার বিষয়ে ইতিমধ্যে দলীয় শীর্ষ মহলে আলোচনাও শুরু হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত আওয়ামী লীগ দেশের এ চরম রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত ছিলো না। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরীর কমিটির নবায়ন করার ঘোষণা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সরকার বিরোধী আন্দোলন থেকে জনগণের দৃষ্টি ফেরাতে সিটি নির্বাচনকে কৌশল হিসেবে নিলেও শেষ পর্যন্ত সরকারের জন্য তা বুমেরাং হতে পারে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সরকার মনে করেছিলো বিএনপির শীর্ষ নেতারা জেলখানা ও আত্মগোপনে রয়েছেন। দলটির চেয়ারপারসনের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে নেতাকর্মীরা যোগাযোগ করতে পারছেন না। বিএনপির শক্তিশালী শরিক জামায়াতে ইসলামীর প্রথম সারির প্রায় সব নেতারা দ-িত অবস্থায় জেলে। আর বাইরে থাকা নেতারা রয়েছেন আত্মগোপনে। অপরদিকে দলটি একটি জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত। সেকারণে এ মুহূর্তে বিএনপি ও তার রাজনৈতিক জোট সিটি নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও দলটির শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে মনোভাব ব্যক্ত করায় সরকারের অংকে গড়মিল দেখা দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তিন সিটি নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের সামনে এখন করণীয় দুইটি। এক. পূর্বে যে হিসেবে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য সরকার তড়িঘড়ি করেছিলো সেই হিসেব পাল্টিয়ে নতুন অংকে যেতে হবে। দুই. সম্ভাব্য তিন সিটি নির্বাচন থেকে সরে আসার পথ খুঁজতে হবে সরকারকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত ব্যাটে-বলে না মিললে দ্বিতীয় অপশনে যেতে পারে সরকার।
বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে সরকার তিন সিটির নির্বাচন থেকে সরে আসতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী। রাজধানীতে আজ পৃথক দুই অনুষ্ঠানে তারা এ মন্তব্য করেন। তাছাড়া, ইতিপূর্বে নির্বাচন কমিশন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের উদ্যোগ নিলেও সরকারের অসহযোগিতার কারণে তখন তা সম্ভব হয়নি।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তিন সিটি নির্বাচনে সম্ভাব্য মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পরপর যেন জোর তৎপরতা শুরু করা যায়।
অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী আন্দোলন ও নির্বাচন একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। দলটির একটি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিন সিটিতে ২০ দলের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে গণসংযোগ করতে পারবেন। নির্বাচনে গেলে সভা-সমাবেশ করে আরও বেশি জনসম্পৃক্ততা তৈরি হবে বিরোধী জোটে। তবে ২০ দলের প্রধান দুই শরিকের (বিএনপি-জামায়াত) মধ্যে সিটি নির্বাচন নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি বলে ওই সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে প্রার্থী হিসেবে দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগরীরর সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল আউয়াল মিন্টুকে সমর্থন দেয়া হতে পারে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব ও সেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিবুন নবী খান সোহেল ও চট্টগ্রামে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে দলের পক্ষ থেকে সমর্থন দেয়া হতে পারে।
এছাড়া, ঢাকা দক্ষিণে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস, স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বরকত উল্লাহ বুলু, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, যুবদল সভাপতি এডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন পিন্টু ও অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম-এর নাম শোনা যাচ্ছে। উত্তরে বিএনপির স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর নামও আলোচনায় রয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান ও নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনের নাম শোনা যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে ১৪ দল তিন সিটিতে প্রার্থী সমর্থন দিয়েছে। ঢাকা উত্তরে এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আনিসুল হক, দক্ষিণে সাবেক মেয়রপুত্র সাঈদ খোকন ও চট্টগ্রামে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাসির উদ্দিনকে ১৪ দলের পক্ষ থেকে সমর্থন দেয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি নির্বাচনে এলে ঢাকায় দলীয় সমর্থন পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডিএসসিসিতে সাঈদ খোকনের পরিবর্তে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী সেলিমকে সমর্থন দিতে পারে ১৪ দল। ইতিমধ্যে সাঈদ খোকনকে চ্যালেঞ্জ করে মাঠে রয়েছেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী সেলিম।
আলাপকালে হাজী সেলিম বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে সমর্থন দিতে পারেন। শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এখনো সরাসরি তিনি কোনো গ্রীন সিগন্যাল পাননি। তবে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী তাকে সমর্থন দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অপরদিকে ডিএনসিসিতেও অনেকটা বেকায়দায় আওয়ামী লীগ। এ সিটিতে দলটি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আনিসুল হককে সমর্থন দিয়েছে। এখানে বিএনপির পক্ষে থেকে এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রার্থী হলে চ্যালেঞ্জে পড়বে সরকার। কারণ, এরা দুই জনই এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি। একজন (মিন্টু) সরাসরি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক। অন্যদিকে আনিসুল হক আওয়ামী সমর্থক ব্যবসায়ী হলেও সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকায় দলটির সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সখ্যতা নেই। সেক্ষেত্রে ১৪ দলের কর্মীরা তার জন্য কতটা মাঠে থাকবেন তা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া, এখনো আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ও সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারও মাঠে রয়েছেন। অবশ্য দল সমর্থিত প্রার্থীদের পাশে থাকতে নেতাকর্মীকে ইতিপূর্বেই শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দিতে চায় না। বরং তারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলকে আরো শক্তিশালী করতে চায়।
গতকাল শুক্রবার বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে গিয়েছিলেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ। তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকজন পেশাজীবী নেতৃবৃন্দও ছিলেন। ওই সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি তিন সিটির নির্বাচন নিয়েও কথা হয়। শনিবার বিকেলে এমাজউদ্দীন আহমেদ ের সঙ্গে আলাপকালে জানান, বেগম খালেদা জিয়া সিটি নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। তিনি (খালেদা) মনে করেন, নির্বাচনে অংশ নিয়ে নেতাদের সঙ্গে কর্মীদের সম্পর্ক আরও বাড়বে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সভা-সমাবেশ করা যাবে। পাশাপাশি তিন সিটিতে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে আরও আন্তরিক হতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। খালেদা জিয়া মনে করেন ২৮ এপ্রিলের পর খুব সহজেই ঢাকায় একটি গণজমায়েত করা যাবে। নির্বাচন চলাকালেই সম্ভাব্য ওই গণজমায়েত সফল করতে তৎপরতা চলাবে ২০ দল।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ মার্চ ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। তিন সিটিতে ২৮ এপ্রিল ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সিইসি জানিয়েছেন, প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ ২৯ মার্চ। ১-২ এপ্রিল মনোনয়নপত্র বাছাই ও ৯ এপ্রিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ।