মুক্তিপণ না পেয়েই সাঈদকে হত্যা : আদালতে ১৬৪ ধারায় কনস্টেবল এবাদুলের জাবানবন্দী (ভিডিও)
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ নগরীর রায়নগর দর্জিবন্দ থেকে অপহৃত শিশু আবু সাঈদকে (৯) হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন পুলিশ কনস্টেবল এবাদুল। রবিবার দুপুরে সিলেট মহানগর হাকিম আদালত-১ এর বিচারক শাহেদুল করিমের আদালতে এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি।
স্বীকারোক্তিতে তিনি উল্লেখখ করেন, মুক্তিপণ আদায়ের জন্যই সাঈদকে অপহরণ করা হয়েছিল। এ কাজে র্যাবের সোর্স গেদা মিয়া ও জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রকিবও জড়িত। অপহরণের পর সাঈদ তাদেরকে চিনে ফেলায় তাকে হত্যা করা হয়। আদালতে এবাদুলের স্বীকারোক্তি দেয়ার বিষয়টি গনমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. রহমত উল্লাহ। অপহরণের পর শিশুটির পরিবারের কাছে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। অবশেষে মুক্তিপণ না পেয়েই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শিশু সাঈদকে। হত্যার পর সাঈদের শরীরে অ্যাসিড জাতীয় পদার্থ নিক্ষেপ করে এক এক করে ৭টি বস্তায় ঢুকানো হয় লাশ। অপহরণের একদিন পরই সাঈদকে হত্যা করা হয়েছে। সাঈদ হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলেন পুলিশ কনস্টেবলসহ ৫ জন। হত্যার আগে সাঈদ অপহরণকারীদের চিনতে পরায় তাকে খুন করা হয়। এরপর গত শনিবার রাত ১২টায় সাঈদের গলিত লাশ নগরীর শনিবার দিনগত রাত সাড়ে ১০টায় নগরীর ঝেরঝেরি পাড়ার সবুজ ৩৭ নম্বর বাসা থেকে শিশু সাঈদের বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে হত্যার আলামত সংগ্রহের পর রাত দেড়টার দিকে মরদেহ উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ মর্গে প্রেরণ করে। আটককৃত ওই কনস্টেবলের ভাড়া বাসা থেকেই উদ্ধার করা হয় শিশু সাঈদের মরদেহ।
আটককৃত পুলিশ কনস্টেবল এবাদুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই শিশুর মরদেহটি উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এবাদুলের তথ্যের ভিত্তিতেই আটক করা হয় জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিব ও গেদা নামের র্যাবের এক সোর্সকে।
জয়নাল আবেদীন জানান, অপহরণের পর তাকে ও সাঈদের বাবাকে ফোন করে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপন দাবি করা হয়। পাঁচ লাখ টাকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে তারা দুই লাখ টাকা দাবি করে। প্রথমে টাকা নিয়ে শাহজালাল (র.) দরগায় যেতে বলে অপহরণকারীরা। দরগায় যাওয়ার পর অপহরণকারীরা আবার ফোন করে সেখান থেকে এয়ারপোর্ট সড়কের বাইশটিলা এলাকায় যেতে বলে। বাইশটিলায় যাওয়ার পর পুলিশ ও র্যাবকে বিষয়টি কেন জানানো হয়েছে অপহরণকারীরা ফোনেই তা জানতে চায়। এ সময় তারা সাঈদকে খুন করার হুমকি দিয়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়।
সাঈদের বড় মামা আশরাফুজ্জামান আজিম বলেন, শুক্রবারও কনস্টেবল এবাদুলের সঙ্গে আমার দেখা হয়। এসময় সে সাঈদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয় এবং তাকে উদ্ধারে সব ধরনের সহযোগীতা করার আশ্বাস দেয়। কতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার ফয়াজ আহমদ ফয়েজ জানান, স্কুল ছাত্র সাঈদ অপহরণের অভিযোগে জিডির তদন্ত বর্তায় তার ওপর। তদন্তকালে যে মোবাইল ফোন থেকে সাঈদের বাবা ও মামার কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে সেই মোবাইল হ্যান্ডসেটটি ট্র্যাকিং করা হয়। ট্র্যাকিং করে দেখা যায়, বিমানবন্দর থানার কনস্টেবল এবাদুল এই ফোনটি ব্যবহার করছেন। শনিবার এবাদুলকে কতোয়ালি থানায় ডেকে আনা হয়।
ফয়েজ জানান, জিজ্ঞাসাবাদে প্রথমে কনস্টেবল এবাদুল শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে। একপর্যায়ে সে বিষয়টি স্বীকার করে এবং শিশু সাঈদকে খুন করা হয়েছে বলে জানায়। এবাদুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঝেরঝেরি পাড়ার সবুজ ৩৭ নম্বর বাসার চিলেকোটা থেকে শিশু সাঈদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এক প্রবাসীর বাসার দোতলায় কনস্টেবল এবাদুল ভাড়া থাকেন বলে এসআই ফয়েজ জানান। পুলিশ লাশ উদ্ধারকালে এবাদুলের স্ত্রী সিনথিয়া নির্ঝর তানিয়াও বাসায় ছিলেন। তিনি নগরীর কুমারপাড়ার স্বপ্নঝাড়া বিউটি পার্লার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক।
এবাদুলের দেওয়া তথ্যমতে নগরীর বন্দরবাজার থেকে পুলিশ জেলা ওলামা লীগ সাধারণ সম্পাদক রাকিব ও কোর্ট পয়েন্ট সংলগ্ন মধুবন মার্কেটের সামনে থেকে পুলিশের সোর্স গেদাকে আটক করে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সিলেটের পরিদর্শক শামীমুর রহমান পীর জানান-বাসার চিলেকোটা থেকে শিশুটির বস্তাবন্দি লাশ পাওয়া যায়। একটি পাটের ও ৬টি প্লাস্টিকের বস্তায় মোড়ানো ছিল মরদেহ। শিশুটির গলায় প্রায় দুই হাত লম্বা একটি রশি লাগানো ও গলায় রশির দাগ মিলেছে। শিশুটির গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন তিনি।
পুলিশ জানায়, শিশু সাঈদকে যারা হত্যা করেছে তাদের সকল তথ্য এখন পুলিশের হাতে রয়েছে। পুলিশ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ৩ জনকে গ্রেপ্তারও করেছে। এরমধ্যে প্রধান সন্দেহভাজন মহানগর পুলিশের এয়ারপোর্ট থানার পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমান, র্যাবের কথিত সোর্স গেদা মিয়া ও জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাকিবসহ ৫জন হত্যাকান্ডে অংশ নেয়। পুলিশের হাতে আটক ৩ জন হত্যার দায় স্বীকার করে এমন তথ্য দেয়। পলাতক দুজনকে গ্রেফতারে পুলিশ চেষ্টা করছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমান আদালতে ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গতকাল সিলেট মহানগর প্রথম আদালতের বিচারক শাহেদুল করিমের এজলাসে ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এবাদুর রহমান বলেন, তিনি বিমানবন্দর থানায় একজন কনস্টেবল হিসেবে দায়িত্বরত। গত ১১ মার্চ বুধবার তিনি থানা থেকে সকাল ১১ টায় ঝেরঝেরি পাড়ার ৩৭ বাসায় আসেন। গোসল শেষে মোবাইল ফোনে তার অন্ত:স্বত্তা স্ত্রীর সাথে কথা বলেন। কথা শেষে মোবাইল ফোনেই ভিডিও গান দেখছিলেন এবাদুর। এরপরই র্যাবের কথিত সোর্স গেদা মিয়া ও জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাকিব ও একজন দাড়িওয়ালা লোক তার ঘরের দরজায় ডাকাডাকি করেন। তিনি দরজা খোলে দেখেন অপহৃত সাঈদ তাদের সাথে। এরপর পরিকল্পনামত ৫ লাখ টাকা মুক্তিপন দাবি করা হয় সাঈদের পরিবারের কাছে। এক পর্যায়ে সাঈদ সবাইকে চিনতে পারায় পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে সাঈদকে হত্যা করা হয়। হত্যার আগে মুক্তিপনের টাকা দিলে সাঈদকে ফিরিয়ে দেয়ার কথা বললে টাকা নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পুলিশসহ যান পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু সাঈদকে ফিরিয়ে দেয়া হয়নি জীবিত।
কোতোয়ালি থানার ওসি আসাদুজ্জামান গনমাধ্যমকে জানান, কনস্টেবল এবাদুরসহ ৫ জন এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। আর এবাদুর সাঈদকে আগে থেকে চিনত। সাঈদও এবাদুরকে মামা ডাকত। সাঈদের নানার বাসা ঝেরঝেরিপাড়ার পাশের ৩৭ নম্বর বাসায় এবাদুর বসবাস করত। গেদা মিয়ার পরিবার ও গেদা মিয়ার সাথে সাঈদের পরিবার ছিল পূর্ব পরিচিত। সাঈদকে অপহরণের পর প্রথমে কনস্টেবল এবাদুরের বাসায় আনা হয়। এরপর দিন সাঈদের পরিবারের কাছে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপন দাবি করা হয়। পরিবার সাথেসাথে বিষয়টি পুলিশকে অবগত করে। পুলিশ একাধিক এলাকায় তাদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালায়। তারা ঘনঘন স্থান পরিবর্তন করায়, অভিযান সফল হয়নি।
এরপর বিমানবন্দর থানার কনস্টেবল এবাদুর ও র্যাবের কথিত সোর্স গেদা মিয়ার মোবাইল ফোনে ট্র্যাকিং করে পুলিশ। কোন এলাকায় অপহরণকারী রয়েছে তাও সনাক্ত করা হয়। পুলিশ অভিযানে ওই রাতেই কনস্টেবল এবাদুরসহ বাকী ২ জনকে গ্রেপ্তার করে। ঝেরঝেরি পাড়ার ৩৭ নম্বর বাসায় অভিযান পাওয়া যায় মৃত সাঈদের বস্তাবন্দী লাশ। ৭ টি বস্তায়পুড়ে রাখা হয় সাঈদের লাশ। যাতে গলিত লাশের গন্ধ এলাকায় না ছড়ায় এজন্য। তবে লাশটি বস্তাবন্দী করার কারণে বাতাস ঢুকতে না পাড়ায় পঁচেগন্ধ বের হয়।
এদিকে, স্কুল ছাত্র সাঈদকে হত্যার ঘটনায় গত শনিবার রাতেই কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাত আসামী করে হত্যা মামলা-১৩ দায়ের করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, মামলার প্রধান সন্দেহভাজন পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমান ২০১০ সাল থেকে সিলেট মহানগর পুলিশে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি বিমানবন্দর থানায় কনস্টেবল হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। তার বাড়ি জকিগঞ্জ উপজেলার বাল্লাগ্রামে। এবাদুর রহমান বিভিন্নভাবে মানুষকে হয়রানী করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার কাজ করেন দীর্ঘ দিন থেকে। তার অনিয়মের প্রধান সহযোগী র্যাবের সোর্স গেদা মিয়া, জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাকিবসহ আরো কয়েকজন।
পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কনস্টেবল এবাদুর রহমানের বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে গতকাল রোববার সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (গণমাধ্যম) মো. রহমত উল্লাহ গনমাধ্যমকে জানান, হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল কনস্টেবল এবাদুর, র্যাবের সোর্স গেদা ও জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাকিব। গেদা ও রকিব পুলিশ হেফাজতে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের নিয়ে পুলিশ অভিযান দিচ্ছে। এ ঘটনায় আরো ২ জন জড়িত রয়েছে। আর কনস্টেবল এবাদুর রহমান আদালতে ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
কোতোয়ালি থানার ওসি আসাদুজ্জামান জানান, পুলিশের প্রতি নিহত শিশু সাঈদের পরিবার সন্তুষ্ট। কিন্তু পুলিশ এ অভিযান দিয়ে সন্তুষ্ট নয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, শিশুটিকে উদ্ধারে খুব বেশি পরিশ্রম করেছেন। একাধিক স্থানে অভিযান দিয়েছেন। কিন্তু তাকে জীবিত উদ্ধার করতে পরলেননা। এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ওই মামলা এমনভাবে তদন্ত করা হবে যাতে কোনো অপরাধি আইনের ফাঁক না পায়। শিশু সাঈদের পরিবার অবশ্যই সঠিক বিচার পাবে। আর এজন্য যা করা প্রয়োজন তাই করবে পুলিশ।