বাকরুদ্ধ মা, স্তব্ধ বাবা : ভয়ার্ত সাইদের সহপাঠী-খেলার সাথীরাও

15-03-15-Abu-Sayed_Sylhet-2ইয়াহইয়া মারুফঃ বাকরুদ্ধ মা, স্তদ্ধ বাবা। সাথে অসহায় ও ভয়ার্ত সাইদের সহপাঠী-খেলার সাথীরাও। নয় বছরের শিশু আবু সাইদ। সিলেট নগরীর শাহী ঈদগাহস্থ শাহমীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেনীর ছাত্র। রায়নগরস্থ দর্জিবন্ধ বসুন্ধরা এলাকার ৭৪ নং নিজ বাসার ভাড়াটিয়া আব্দুল মতিন ও সালেহা বেগমের সন্তান।
আদরের সন্তানকে হারানোর বেদনায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন মা, ছেলের মুক্তিপণ দিতে না পেরে লাশ কাদেঁ নিয়ে স্তদ্ধ সাইদের কৃষক বাবা আব্দুল মতিন। পিতার কাদেঁ সন্তানের লাশের ভার যে কত কষ্টের তার বিবরণ লিখে শেষ করার নয়। গতকাল রোববার দুপুরে ময়না তদন্তের শেষে পুলিশ পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তরের পর নিয়ে যাওয়া হয় কুমারপাড়াস্থ সাইদের মামার বাসায়। সেখানে যখন সন্তানের লাশ রাখা হয়েছিল মা-বাবার সামনে। সেই দৃশ্য দেখলেই অন্তত কিছুটা অনুমান করা যেত।
যখনই জ্ঞান ফিরে পান তখনই হাঁউ মাঁউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মা সালেহা। বলতে থাকেন, ‘কি অপরাধ আমার? কেন ওরা আমার কলিজ্বার টুকরা সন্তানকে আমার বুক খালি করে কেড়ে নিল? টাকার জন্য যে নরপশুরা আমার বুক খালি করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি চাই। আমাদের মত যেন আর কোন মা-বাবার আদরের সন্তানকে হারাতে না হয়। মুক্তিপণ দিতে না পেরে আর কোন কৃষক বাবা যেন সন্তানের লাশ কাঁদে নিতে না হয়। গর্ভে ধারনকারী সন্তানকে হত্যার সংবাদ দিয়ে যেন আর কোন সাইদের মায়ের বুক খালি না হয়। এসব হিংস্র জানোয়ারদের জন সম্মুখে শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত মুলক নজির স্থাপনের দাবি কর্তৃপক্ষের কাছে এই মা-বাবার। সন্তানের লাশের পাশে বসে বাবা-মাকে এভাবেই আর্তনাদ করতে দেখা যায় গতকাল রোববার বেলা ১টায় সিলেট নগরীর কুমারপাড়াস্থ এভারগ্রীন ৭৩ নং সাইদের মামার বাসায় গিয়ে। সাইদ অপহরনের পর থেকে ভয়ে ও বন্ধুবিহীন স্কুলে যাচ্ছেনা মাহি ও সৌরভ নামে দুই ছোট বেলার বন্ধু।
পরিবার সুত্রে জানা যায়, গত বুধবার সকাল ১১টায় নগরীর রায়নগরস্থ দর্জিবন্ধ বসুন্ধরা এলাকার ৭৪ নং নিজ বাসা থেকে কুমারপাড়াস্থ এভারগ্রীন ৭৩ নং মামার বাসায় যাওয়ার পথে অপহৃত হয় সাইদ। পর দিন বৃহস্পতিবার অপহরণকারীদের চাওয়া ৫ লক্ষ টাকা দরিদ্র বাবা-মা না দিতে পারা ও অপহরণকারীদের চিনে ফেলায় নির্মমভাবে সাইদকে হত্যা করে। আলামত গোপন রাখার জন্য মরদেহটি ৭টি পলিথিনে ভরে রাখে হত্যাকারীরা। অপহরণের পর সাঈদের বাবা ও মামার কাছে ফোন করে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। অন্যতায় সাঈদকে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি দেয় তারা। এরপর সাঈদের বাবা ও মামা কোতোয়ালি থানায় গিয়ে জিডি করেন। সাঈদ অপহরণ ঘটনার দায়ের করা জিডির তদন্তের ভার দেয়া হয় কোতোয়ালি থানার সেকন্ড অফিসার এসআই ফয়াজ আহমদকে।
এসআই ফয়াজ আহমদ জানান- আমরা যে মোবাইল ফোন দিয়ে সাঈদের বাবা ও মামার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল, সেই মোবাইল ট্র্যাকিং করে এটি এসএমপির বিমানবন্দর থানার কনস্টেবল এবাদুলের ফোন বলে জানতে পারি। গত শনিবার তাকে কাজ আছে বলে থানায় ডেকে আনা হয়। সেখানে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদকালে সে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে এবং সাঈদকে হত্যার কথা জানায়। সেকেন্ড অফিসার ফয়াজ আরো জানান, অপহরণকারীর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গত শনিবার দিবাগত রাত ১১টার দিকে নগরীর ঝেরঝেরী পাড়ার সবুজ ৩৭ নং বাসা থেকে সাঈদের বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ।
সাইদরা দুই ভাই এক বোন। সাইদ দ্বিতীয়। তার বড় বোন সাইদা অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী। বাবা আব্দুল মতিন একজন কৃষক। মা সালেহা বেগম গৃহিনী। মতিনের ছোট্ট সংসার সুখিই ছিলো। গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার খাসিলা গ্রামে। সাইদের মামা নগরীর কুমারপাড়া এভারগ্রীন ৭৩ নং বাসায় ভাড়া থাকেন। পাশেই রায়নগরস্থ দর্জিবন্ধ বসুন্ধরা এলাকার ৭৪ নং বাসায় বোনকে ভাড়া করে দেন থাকার জন্য। সাইদ প্রায় সময়ই মামার বাসায় থাকতো। মামাতো ভাইদের সাথে স্কুলে যাওয়া, খেলাধোলা করত। অপহরনের দিনও সেই ধারাবাহিকতায় মামার বাসায় আসছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। আসা হলো মামার বাসায়; তবে লাশ হয়ে। ঘাতকরা সাইদকে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করল ৫ লক্ষ টাকা। দরিদ্র মা-বাবা ৫ লক্ষ টাকা না দিতে পারায় নির্মম হত্যার শিকার হলো নয় বছরের শিশু সাইদ। এ ঘটনার পর থেকেই সাইদের মা-বাবা, মামার পরিবারে জ্বলছে শোকের বাতি।
গতকাল রোববার বেলা ১টায় মামার বাসায় লাশ দেখতে গেলে, তার খেলার সাথী মামাতো ভাই ও একই ক্লাসের ছাত্র মোঃ মাহি‘র সাথে কথা বলে জানা যায়, সাইদ অপহরনের পর থেকে ভয়ে ও একা স্কুলে যাচ্ছেন না মাহি। বাবা স্কুলে দিয়ে আসতে চাইলেও ভালো লাগেনা, সাইদ আসলে যাব বলে মাহি। তখন মাহি ভাবেনি তার স্কুল ও খেলার সাথী সাইদ তাদের মাঝে আর আসবেনা। এমনকি হত্যার পরও খবর শুনে বিস্বাস করেনি সে। মাহি এখনো অপেক্ষায় আছে ছোট বেলার সাথী সাইদের। বন্ধু আসলেই এক সাথে স্কুলে ও খেলার মাঠে যাবে। সাইদ ক্রিকেটে ভাল ছিল। ক্লাসের বা পাড়ার তার বয়সি ছেলের থেকে অনেক বেশী খেলত।