নদী নয় যেন নর্দমা! সুরমাসহ সিলেট অঞ্চলের ৫৩ নদী বিপন্ন

munna-3নুরুল হক শিপুঃ সিলেটের দীর্ঘতম নদী সুরমা। বর্তমান অবস্থা এমন যে, শীতকাল এলেই নদীটি প্রায় শুকিয়ে যায়। জেগে ওঠে অনেক স্থানে চর। কোনো কোনো স্থানে নদীর বুকে শিশুদের ক্রিকেট খেলতেও দেখা যায়। নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে তারপরওা হচ্ছে না ড্রেজিং। আর অপচনশীল পলিথিন, সিলেট নগরের আবর্জনাও এখন ঠাঁই পায় সুরমার বুকে। নদী নয় যেন নদর্মাÑএই সময়ের যে কোনো দিন নদীতে চোখ ফেললেই এমনটাই মনে হবে।
একদিকে ড্রেজিং বিহীন সুরমা হচ্ছে ভরাট আর অন্যদিকে আবর্জনা আর অপচনশীল পলিতিন সুরমার পানিকে করছে মানুষের ব্যবহারের আনুপযোগী। ধীরে ধীরে যেন মরেই যাচ্ছে সিলেট নগরীর বুক চিরে প্রবাহিত হওয়া সুরমা। স্রোতের নদী সুরমার বুকে অনেক স্থানেই এখন পানি নেই। হারিয়ে গেছে নদীর স্রোতও। বছরের ১২ মাস যার বুকে স্রোতের কলকল ধ্বনি বহমান থাকতো, তার বুক এখন স্রোতহীন। স্রোতের কলকল সেই মধুর ধ্বনী এখন আর শুনা যায়না সুরমা তীরে গেলে। দখল, দূষণ আর দীর্ঘদিনেও ড্রেজিং না করায় একসময়কার স্রোতস্বীনি সুরমা এখন যেন মৃত্যু পথযাত্রী।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দক্ষিণ সুরমার কুশিঘাট, নগরী শাহজালাল ব্রীজের নিচ, গোলাপগঞ্জের বৈইটিকড় এলাকার ভেতরে সুরমার বুক শুকিয়ে গেছে। পরিণত হয়েছে এসব স্থান বিশাল মাঠে। ওইসব এলাকায় নদীর বুকেই শিশুরা ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। আর নদীতে যতটুকু পানি রয়েছে তাতে মানুষ হেঁটেই যাতায়াত করতে পারছেন। নগরের ক্বীনব্রীজ এলাকা, কাজিরবাজার, ছড়ারপাড়, ক্বীনব্রীজের দক্ষিণ পাশ, কদমতলী, বরইকান্দি, কুচাইসহ যেসব এলাকার পাশ দিয়ে বহমান সুরমা এসব স্থানে পানিও মানুষ ব্যবহার করতে পারছেননা। অপচনশীল পলিথিন, আর আবর্জনা ফেলার কারণে ওইসব এলাকায় পানি দূষণ এত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, মানুষ এখন সুরমার পানি ব্যবহার করে হতে হচ্ছে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। আর পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুরমার পানি মারাত্মক দূষণ করা হচ্ছে। এসব বন্ধ করে সুরমাকে বাঁচাতে হবে।
আর নগরের বিভিন্ন এলাকার আবর্জনার ফেলতে ডাস্টবিন হিসেবে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে সুরমা নদীকে। পলিথিনে সয়লাব এখন নদীগর্ভ। দূষণ আর পানিশূণ্যতার কারণে সুরমায় নেই আগেরমত মাছও। বছরের বেশিরভাগ সময় সুরমার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন জেলেরা। যাদের উপর্জনের স্থান সুরমা নদী। যে নদীতে মাছ ধরে সংসার চালান জেলেরা তারা আজ মাছ ধরার নৌকাগুলো তীরে বেঁধে অলস সময় কাটাতে হচ্ছে। কুশিঘাট এলাকার জেলে পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, জেলে পরিবারগুলোর করুণ দশা। মাছ ধরে জিবীকা নির্বাহ করেন এমন একাধিক পরিবার রয়েছে ওই এলাকায়। জেলেরা জানান, নদীতে পানি কমে যাওয়ায় এখন মাছও পাওয়া যাচ্ছে না। যার কারণে সকল জেলেরা এখন প্রায় বেকার। একই অবস্থা শারপিং গ্রামের কিছু জেলে পরিবারের।
শুধু যে সুরমা নদীর এমন অবস্থা তা নয় বৃহত্তর সিলেটের নদ-নদীর এখন ভরাট হয়ে গেছে। এতে সিলেটের ভাটি এলাকার জনপদে নৌপথ বন্ধ, চাষবাসে সংকট, অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। নদীগুলো ড্রেজিং ও আবর্জনামুক্ত না করায় একদিকে নদীগুলো হারাচ্ছে নব্যতা, অন্যদিকে দূষণের মাত্রাও দিনদিন বাড়ছে। বিশেষ করে পানিতে বর্জ্য মিশ্রণের ফলে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ভাটির জনপদের নদীগুলো। তীরবর্তী জনপদের জীবন-জীবিকা বদলে যাচ্ছে। বিলীন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। কমছে মাছের উৎপাদন। গতিপথ পরিবর্তন, নাব্যতা হরানো নদী ভাঙ্গনের হারও বেড়েছে ব্যাপক।
সিলেটের প্রধান নদী সুরমা। আরও আছে কুশিয়ারা, খোয়াই, মনু, ধলাই, পিয়াইন, সারি, সুতাং, রতœা, সোনাই, করাঙ্গী, ঝিংড়ি, ভেড়ামোহনা, রক্তি, কালনী, বৌলাই। সব নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। নদী ভরাটের কারণে কৃষকরা হাহাকার করেন শুকনো মৌসুমে। নদী ভাঙনে জকিগঞ্জ উপজেলার বহু এলাকা সিলেটের মানচিত্র থেকে হারিয়ে পার্শ্ববর্তী ভারতে চলে গেছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের সুরমা ও কুশিয়ারাসহ ৩০ টি নদী এবং মৌলভীবাজারের মনু, ধলাই এবং হবিগঞ্জের খোয়াইসহ ২৩টি নদীই বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
সুরমা নদী প্রসঙ্গে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান সুরমা টাইমসকে জানান, সুরমা নদী সিলেটের ঐতিহ্য। নদীটির খনন কাজ হয়নি। আবর্জনা ফেলে পানি নষ্ঠ করা হচ্ছে। নদী কালের গর্ভে হারাতে বসেছে। আগেরমত সুরমার মাছও পাওয়া যায়না। তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুরমা নদীর খনন কাজ করানো ধরকার। ছড়ারপাড় এলাকায় নদীতে পলিথিন ও আবর্জনা প্রসঙ্গে কামরান বলেন, ওই এলাকায় বেশ কিছু কলনী রয়েছে। মানুষের ঘনবসতি। অনেকেই নদীতে আবর্জনা ফেলে দেন। তিনি বলেন, কালিঘাটবাজারের আবর্জনাও ফেলা হয় সুরমায়। তাই সবাইকে সচেতন হতে হবে। নির্দিষ্টস্থানে বর্জ্য ফেলতে হবে। নদী বাঁচাতে সবাই সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বলেন, পরিবেশ আন্দোলন’র সাথে সিটি কর্পোরেশন সুরমা নদী পরিস্কারের একটা উদ্বোগ নিয়েছে। আজ থেকে এ কাজ করানো শুরু হবে। তিনি বলেন, নদীর আবর্জনা পরিস্কারের জন্য সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ল্যাভারও দেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন থেকে প্রতি বছরই সুরমা নদী পরিস্কার করানো হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, সিলেট ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নদীকৃত্য দিবস উদযাপন করে আসছে। আজ বাপার সিলেট জেলা শাখার উদ্যেগে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ দূষণে বিপর্যস্ত সুরমা নদী পরিচ্ছন্নকরন কমর্ঞ্চসূচী পালন করবে। নগরের সমস্ত জঞ্জালের ভাগাড়ে পরিনত হওয়া কিংবদন্তীর নদী সুরমাকে রক্ষা করতে নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান তিনি।