দেশের উন্নয়নের স্বর্থে জাতীয় কয়লানীতি চূড়ান্ত করা হোক
মনসুর হায়দারঃ বিদ্যমান ও ভবিষ্যৎ ভয়াবহ সঙ্কট পূরণে সস্তা ও সহজলভ্য জ্বালানি উৎস হিসাবে দেশের কয়লা উত্তোলনের কোনো বিকল্প নেই।
দেশের ভূগর্ভস্থ খনিজ সম্পদ বিশেষ করে কয়লার সঠিক ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দেশে আবিষ্কৃত বিপুল পরিমাণের কয়লা সম্পদ মজুদ থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার না করে ভূগর্ভেই ফেলে রাখার কথা বলে আসছেন এক শ্রেণীর পরামর্শক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতির এই যুগে প্রতি মুহূর্তে চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, উদ্ভাবন প্রক্রিয়া বদলে যাচ্ছে। আজকে যে প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার হচ্ছে সময়ের পরিবর্তনে, প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কারে সেই প্রযুক্তিই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। তাই সময়ের নিরিখে যেটা অপরিহার্য তার ব্যবহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করছেন তারা। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে তারা দেশের প্রচুর পরিমাণে মজুদ থাকা কয়লা সম্পদের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছেন, এই সম্পদের কার্যকর ব্যবহার যদি এখনই করা না হয় তবে তার জন্য বাংলাদেশকে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
দেশে এ পর্যন্ত পাওয়া ৫টি কয়লা খনিতে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ আছে বলে ধারণা করা হয়। এ পরিমাণ কয়লার তাপ উৎপাদন ক্ষমতা ৮৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সমান।
দেশের দিনাজপুরের বড় পুকুরিয়ায় বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে উন্নতমানের কয়লা মজুদ থাকার পরেও সেই খনির কয়লা ব্যবহারের উদ্যোগ না নিয়ে এখন ভারত থেকে নিম্নমানের কয়লা উচ্চ দাম দিয়ে কেনার চিন্তা করছে সরকার। ইতোমধ্যে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে এই জ্বালানি ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনাও শুরু করেছে সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি।
দেশের অভ্যন্তরে উন্নতমানের কয়লার খনি থাকার পরেও ভারত থেকে নিম্নমানের কয়লা উচ্চ দামে কেনার জন্য কেন এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার জবাবে খোলাখুলিভাবে একটাই। সেটা হলো আমদানির নামে সংশ্লিষ্টদের সাগরচুরি। ২০০৪ সালে ভারতেরই বৃহৎ বিনিয়োগের টাটা কোম্পানি বাংলাদেশের এই কয়লাকে জ্বালানির প্রধানতম উৎস হিসেবে ব্যবহার করে তিনশ’ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিল। টাটার বিনিয়োগ প্রস্তাবের মধ্যে ছিল ২৪ লাখ টন ইস্পাত উৎপাদন ১০ লাখ টন ইউরিয়া উৎপাদন প্রকল্প। যে ভারত মাত্র কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের উন্নতমানের কয়লা ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল এখন সেই ভারত থেকেই কয়লা কেনার উদ্ভট চিন্তা সরকারের অদূরদর্শিতা ও তোষণনীতি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
দেশের কয়লা ব্যবহার করে ২০৩০ সালের মধ্যে ১১ হাজার ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। একই সময়ের মধ্যে আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে সরকারি-বেসরকারি খাত মিলে ৮ হাজার মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হবে। অথচ দেশে পাঁচটি কয়লাখনিতে মজুদ কয়লা দিয়ে ৫০ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। তবে ফুলবাড়ী কয়লাখনি নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের জেরে ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে দেশী কয়লা উত্তোলন। আগের তিন সরকারের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারও কয়লা উত্তোলনে রক্ষণশীল (গা-বাঁচানো) নীতি নিয়েছে।
কয়লা উত্তোলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি বছরের পর বছর ঝুলে রয়েছে। যার কারণে বর্তমান সরকারকেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করতে হয়েছে বিদেশ থেকে কি পরিমাণ কয়লা আমদানি করা হবে তার উপর।
উল্লেখ্য, এখন নতুন নতুন অনেক পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। উন্মুক্ত বা আন্ডার গ্রাউন্ডের মধ্যে আলোচনায় সীমাবদ্ধ না থেকে কোল বেড মিথেন ও আন্ডার গ্রাউন্ড গ্যাসিফিকেশন প্রক্রিয়ার দিকেও যাওয়া যেতে পারে। গ্যাসিফিকেশন (তরলায়িত) করে বিশ্বে অনেক দেশে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে।
মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতায় এখন পর্যন্ত দেশের কয়লা সম্পদ উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। কয়লা উত্তোলনে কোন পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে, সেটা বড় সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে- দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল দেশের কয়লা উত্তোলন নিয়ে রাজনীতি করছে। অথচ দেশের উন্নয়নের স্বর্থে মাটির নিচে কয়লার মজুদ ভবিষ্যতের জন্য না রেখে এখনই উত্তোলন করা প্রয়োজন। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের পরিচালনাধীন সরকারের সেদিকে নজর নেই। নজর কিভাবে ক্ষমতা হাতানো যায় সেদিকে। তাই সরকার নিজেকে দেশ দরদী ভাবলে অবিলম্বে সরকারের জাতীয় কয়লানীতি চূড়ান্ত করা উচিত।