পদোন্নতির বেড়াজালঃ দায়ভার কে নেবে?

ফাইল ফটো
ফাইল ফটো

ইসমত পারভীন রুনু: মর্যাদার দিক দিয়ে বিবেচনা করলে শিক্ষকতা পেশা নিঃসন্দেহে সবার শীর্ষে। মহান এ পেশার প্রতি মানুষের আগ্রহ যুগে যুগে ছিল, আজও এ পেশার প্রতি শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা আগের মতোই আছে। যদিও যথাসময়ে পদোন্নতি না হওয়ায় এ পেশার জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছে বৈকি। যথাযোগ্য মর্যাদা আর সম্মানবোধ এই পেশার মূলমন্ত্র। তাইতো এ পেশার প্রতি মানুষ এতো বেশী শ্রদ্ধাশীল।
বর্তমানে এ পেশায় পদোন্নতির ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে এক ভয়ানক তৎপরতা। যার কালো ছায়া আজ ভূক্তভোগী কিছু শিক্ষক-কর্মকর্তার জীবনের সংজ্ঞাই পাল্টে দিচ্ছে। এই বৈষম্যমূলক পদোন্নতি কখনোই কারুর কাম্য নয়। এর ভয়াল থাবায় সিনিয়র-জুনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে এক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে; যা মেনে নেয়া কষ্টকর, ক্ষেত্রবিশেষে অপমানজনক।
দীর্ঘদিন ধরে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে পদোন্নতি থমকে আছে, রিট পরবর্তী স্থগিতাদেশ সংক্রান্ত পরিস্থিতির কারণে। এই নিষেধাজ্ঞা দিনের পর দিন চলছেই। এ মুহূর্তে পদোন্নতিবিহীন অবস্থা প্রায় এক বছরে পদার্পন করতে যাচ্ছে। এর শেষ কোথায়? এই রিট ও স্থগিতাদেশের সবচেয়ে বড় নির্মম শিকার বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের ৭ম ব্যাচ। যার ফলশ্রুতিতে ভূক্তভোগী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনযাত্রায় তা অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করছে। যথাসময়ে পদোন্নতি না পাওয়ায়, পদোন্নতি বঞ্চিত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের কর্মজীবনে আত্মবিশ্বাস, কর্মদক্ষতা, গভীর মনোযোগ, একনিষ্ঠতা জাতীয় গুণগুলোর চর্চার জায়গা ক্রমশ সীমিত হয়ে আসছে সার্বক্ষণিক হতাশার কারণে।
এমন পরিস্থিতি কখনোই সুফল বয়ে আনবে না। পদোন্নতি বঞ্চিত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অসহায়ত্ব মানবতার এক চরম লঙ্ঘন। পরবর্তীতে এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটাতে জুনিয়র কর্মকর্তাগণও নিশ্চয়ই এ পথই অবলম্বন করবেন। কে জানে, সেই প্রতিফল ভোগ করতে সবাইকেই প্রস্তুত থাকতে হতে পারে, যদি মীমাংসা না হয়।
এই সীমাহীন জটিলতা ও নিজেদের সৃষ্ট সমস্যার কারণে আগামীতে আমরা এই পেশার জন্য যোগ্য, সৎ ও মেধাবী কর্মকর্তা চাইলেও পাবো কী? পদোন্নতি বঞ্চিত হতাশার জায়গা থেকে বিচার করলে এ পেশায় ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েরা আর আগ্রহ দেখাবে না। যা দেশ ও জাতির জন্য সুখকর নয়। আমরা জানি, শিক্ষকদের মর্যাদার ওপর একটা জাতির ভাবমূর্তি নির্ভর করে। অথচ সে মনোভাব থেকে আমরা মনের অজান্তেই সরে যাচ্ছি। শিক্ষক-কর্মকর্তাগণ গবেষণার মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সে প্রত্যাশায়ও গুড়েবালি। সমাজ সচেতনতা, রাষ্ট্রের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা, মানবতার জয়গানে সমাজকে বলিয়ান করা এসব আর আজকাল দেখা যায় না। ব্যক্তিস্বার্থই আজ বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো একজন নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব। বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের ৭ম ব্যাচের কর্মকর্তাগণ (বিশেষ করে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের) সে দায়িত্বটুকু ধৈর্য্যের সাথেই পালন করে চলেছেন।
একদিকে গুচ্ছ পদোন্নতির নির্মম শিকার, অন্যদিকে রিটের ভারে জর্জড়িত পদোন্নতি বঞ্চিত এসব কর্মকর্তা আজ রীতিমত দিশেহারা। এক্ষেত্রে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যার কোন বিকল্প নেই। ‘শিক্ষা ছাড়া গণতন্ত্র অচল’-একথা বলেছিলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। একথা কী আজ আমরা উপলব্ধি করছি? প্রতিবাদ, আন্দোলন, দাবী আদায় এগুলো থাকবেই। তবে সবাইকে জিম্মি করে কেন?
সকল শর্ত পূরণ করেও বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের ৭ম ব্যাচের টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ৭ জন কর্মকর্তা ছাড়া বাকি সবাই পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন কোন কারণ ছাড়াই। এমন কী পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোন কোন ক্ষেত্রে মেধাক্রম-০১ও অবহেলিত, তাঁদের বিবেচনা করা হয় নি। এ ব্যাপারে মমত্ববোধ দেখিয়ে কেন্দ্রীয় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতিও পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন না কিংবা সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপও নিচ্ছেন না। সবার দৃষ্টি সিনিয়রদের পিআরএল এর দিকে। সত্যিই বিচিত্র এ সমাজ! আমি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রেক্ষাপটে বলতে পারি, যে সমস্ত কথিত সমস্যার কারণে রিটের পর রিট চলছে, সে সমস্ত সমস্যা টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোতে নেই। কর্মকর্তাগণ শুধুই পরিস্থিতির শিকার একই ক্যাডারভূক্ত বলে। অচিরেই টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোকে এই রিটসমূহের আওতামুক্ত করা জরুরি। তা না হলে ৭ম ব্যাচের একটা বড় অংশই স্বপ্নের ‘অধ্যাপক’ পদে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েই অবসর জীবনে চলে যাবেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, এই রিটের কারণেই অতীতে পদোন্নতি না পেয়ে ৭ম ব্যাচের অনেক কর্মকর্তাই হতাশা আর আক্ষেপ নিয়ে অবসর জীবনে চলে গেছেন। অথচ বিগত পদোন্নতিগুলো জ্যেষ্ঠতার নীতিমালা-১৯৮৩ এর ভিত্তিতেই হয়েছিল। তবে কি সেইসব পদোন্নতিগুলো বৈধ হয়নি?
একটি বেসরকারি চ্যানেলের টক শোতে মাননীয় শিক্ষা সচিব মহোদয় বলেছেন, ‘মামলা তুলে নিন, এক সপ্তাহের মধ্যে পদোন্নতি হয়ে যাবে’। তাঁর কথার প্রতি যথার্থ সম্মান জানিয়ে রিট তুলে নিয়ে এ সমস্যার সমাধানে কেউ কি এগিয়ে আসবেন না?
আমরা চাই- নতুন যুগে, নতুন উদ্যোমে সব অন্ধকারকে আড়াল করে পদোন্নতির নতুন সূর্য উদ্ভাসিত হোক শিক্ষা ক্যাডারের ভাগ্যাকাশে। সেই সোনালী আলোয় সবচেয়ে এ ক্যাডার ফিরে পাক অতীত ঐতিহ্য তথা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। শিক্ষকতা পেশা অটুট রাখুক শীর্ষস্থানের গৌরব। শেষ হোক সব অন্তর্দ্বন্দ্বসহ মত পার্থক্যের বেড়াজাল। নিরপেক্ষতার হাতছানিতে, মানবতার জয়গানে মুখরিত হয়ে উঠুক এ পবিত্র অঙ্গন। পার¯পরিক সমঝোতা ও আপোসের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির অবসান হোক।
লেখিকাঃ সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক, সিলেট।