সুপারিশকৃত বেতন কাঠামো ১:১০ কতটা যৌক্তিক? : স্বপন তালুকদার
সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিদের বেতন নির্ধারনে গঠিত বেতন কমিশন সুপারিশকৃত বেতনকাঠামো সরকারের কাছে জমা দিয়েছেন।কমিশন চার সদস্যের পরিবর্তে ছয় সদস্যের একটি পরিবারের নূন্যতম মাসিক ব্যয় নির্বাহ বিবেচনায় নিয়ে বেতন কাঠামো প্রনয়ন করেছেন।তাছাড়া নিচের দিকের কর্মচারিদের সাথে উপরের দিকের কর্মকর্তাদের বেতন ব্যবধান কমিয়ে আনতে বর্তমান বেতন কাঠামো বিশ ধাপের পরিবর্তে ষোল ধাপে করা হয়েছে।কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশে অনেক ইতিবাচক দিক আছে।যা স্বীকার করতেই হবে।যেমন কর্মকর্তা কর্মচারিদের আবাসন সুবিধার জন্য ৫% হারে ঋণ সুবিধা, ৮ম থেকে ১ম গ্রেডের প্রতি বিশ জনে ১০কাঠা জমির উপর প্লট কর্মকর্তাদের জন্য এবং নিচের দিকে কর্মচারিদের জন্য প্রতি বিশ জনে ৮কাঠা জমির প্লট।কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য বীমা, জীবন বিমা ও স্বাস্থ্য কার্ড।সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারিদের জন্য “সমৃদ্ধ সোপান ব্যাংক” স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছ। যা সত্যি প্রশংসাযোগ্য সবল দিক।আমি কোন অর্থনীতিবিদ নই,এমন কি লেখক বা কলামিষ্টও নই।তাই অর্থনৈতিক জটিল বিষয়গুলো আলোচনার যোগ্যতাও আমার নেই।আমি সেদিকে যাচ্ছিও না।আমার সাদা চোখে যা দেখছি,তাই তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।কমিশন বিশ ধাপ থেকে কমিয়ে ষোল ধাপে নিয়ে এলেও দশ অনুপাত এক এ ধাপগুলো বিন্যস্ত করেছেন।যা কিনা গতানুগতিক। বিগত সাতটি কমিশনের অনুরূপ সুপারিশ।এতে ব্যবধান কমার চেয়ে ব্যবধান বৃদ্ধিই করা হয়েছে।সর্বনিম্ন ধাপ ৮হাজার ২০০টাকা এবং সর্বোচ্চ ধাপ আশি হাজার।ব্যবধান ৭১হাজার আটশ, যা ছিল ৩৬হাজার।কমিশন সবার বেতন বৃদ্ধি সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ ধাপেও দ্বিগুণ করার সুপারিশ করেছেন।
গত এক বছর ধরে মিডিয়ার কল্যানে আমরা জেনে এসেছি এবং আশ্বস্ত ছিলাম বর্তমান অষ্টম কমিশন ১:৭ এ বেতন কাঠামো সুপারিশ করবেন।যাতে কিনা নিচের দিকের কর্মচারিরা বিশেষ করে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারিরা লাভবান হবেন এবং উপরের দিকের কর্তাদের সাথে জীবনযাত্রার মানের ব্যবধান কমে আসবে।কমে আসবে মানসিক ও সামাজিক ব্যবধান।কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।পে-স্কেল যে অনুপাতে করা হলো তা কতটা যৌক্তিক?
কমিশনের সুপারিশে সর্বোচ্চ আশি হাজার ১ম ধাপ এবং সর্বনিম্ন ৮হাজার ২০০টাকা ১৬তম ধাপ।১৫তম ধাপ৯হাজার, ১৪তম ধাপ ৯হাজার৫০০টাকা,১৩তম ধাপ১০হাজারপাঁচশ। তা দিয়ে কি ছয় সদস্যের পারিবারিক ব্যয় ও বাবা মায়ের চিকিৎসা ব্যয়সহ লেখা পড়ার ব্যয় মেটানো সম্ভব?যদি ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারিদের ঐ স্কেলে ব্যয় নির্বাহ সম্ভব হয়, তবে ১মধাপ আশি হাজার,২য়ধাপ সত্তর হাজার,৩য়ধাপ ষাট হাজার, ৪র্থধাপ৫২ হাজার, ৫ম ধধাপ পঁয়তাল্লিশ হাজার এবং ৮ম ধাপ পঁচিশ হাজার(১ম শ্রেণির কর্মকর্তা)এই ধাপগুলোতে ছয় সদস্যের ব্যয় নির্বাহে এত ব্যবধান কেন?সকলেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি। এ কমিশনও সুপারিশে সবাইকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হিসেবেই গণ্য করছেন।তবে কেন কর্মচারিতে কর্মচারিতে এত ব্যবধান?নিচের সারির কর্মচারিদের জন্য তো আলাদা স্বতন্ত্র মার্কেট প্রাইস থাকবে না।সবাইকে একই বাজার মূল্যের মুখোমুখি হতে হবে।একটা সুন্দর সুচারু সুবিন্যস্ত আদর্শিক বেতন কাঠামো দেশ ও জাতির সেবা প্রদানের অনেকাংশে মানদন্ড। এ কমিশনের উদ্দেশ্যও ছিল, উচু ও নিম্ন সারির কর্মচারিদের মাঝের ব্যবধান যতটা সম্ভব কমিয়ে এনে দুর্নীতিকে নিরুৎসাহিত করার।কমিশন সুপারিশকৃত বেতন কাঠামোতে অষ্টম ধাপ থেকে প্রথম ধাপের কর্মকর্তাদের বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।যে কোন শাসন ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর সৎ, স্বচ্ছ, মেধাবী প্রশাসন ব্যবস্থার দরকার। কমিশন প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় মেধাবীদের টেনে আনতে ঐসব পদ সমুহের স্কেল আকর্ষণীয় করেছেন।কমিশনের যুক্তি অবশ্যই, সংগত।যাঁরা প্রশাসন যন্ত্রের অংশ তাদের দেখভাল অবশ্যই করতে হবে।তাই বলে প্রজাতন্ত্রের বৃহত্তম একটা অংশের সাথে এতটা বৈষম্য রেখে বেতন কাঠামো বিন্যস্ত করা কতটা যৌক্তিক? দেশের অগ্রগতিতে কি শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় যাঁরা আছেন তাঁদেরই অবদান?নিচের সারিতে যাঁরা মাঠ পর্যায়ে দেশের উন্নয়নে সরাসরি সেবা দিয়ে আসছেন,তাঁদের অবদান কি এতটা খাট করে দেখার মত?এতে কি কাজে গতিশীলতা বাড়বে,দুর্নীতি নিরুৎসাহিত হবে?তবে হ্যাঁ,প্রশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে কাজ আদায় করে নেওয়া হয়তো সম্ভব।নিচের দিকে মেধাবীদের টেনে আনার খুব বেশি প্রয়োজন মনে করেনি কমিশন।কমিশনের সুপারিশে তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই।
দেশের প্রতিটা সেক্টরে দুর্নীতি,যা সর্বজন বিদিত।বিগত বেশ কিছু বছর আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান ছিলাম।শেষ দুই তিন বছর ধরে এই গ্রাফে উন্নতি হলেও দুর্নীতি আমাদের ঘিরেই আছে।প্রায়ই পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই,অফিস গুলোতে ফাইল স্তুপাকারে জমে আছে বছরের পর বছর,কর্মচারি কর্মকর্তা অফিসে নাই বা আসেননি এই অজুহাতে ঘুরতে হয় দেশের জনগণকে দিনের পর দিন,এমন কি বছরের পর বছর।ঘুষ বা বকশিস না দিলে ফাইল ছাড়াই হয় না।অফিসারের সাথে সাক্ষাৎ করতে পিয়ন নাকি পয়সা না দিলে দেখা করতে দেয় না।এমন কি হাসপাতালেও রোগীর জন্য সিট পেতে, তাড়াতাড়ি ভর্তি করতে ঘুষ দিতে হয়।শিক্ষার মান কাঙ্খিত নয়,শিক্ষক ঠিকমত পড়ান না।পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায় পরীক্ষার আগের রাতে।স্বাস্থ্যকর্মী ঠিকমত সেবা প্রদান করেন না,মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের ঠিক সময়ে পাওয়া যায় না।এসবের মূল কারন কি কর্মকর্তা কর্মচারিদের মাঝে বৈষম্যমুলক জীবনযাত্রার মানের জন্য নয়?শুধু কি প্রশাসনিক নজরদারিতেই এসব দুর করা সম্ভব!