সুপারিশকৃত বেতন কাঠামো ১:১০ কতটা যৌক্তিক? : স্বপন তালুকদার

দেশের প্রায় প্রতিটা সেক্টরের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারিরা বেতন বৃদ্ধিসহ কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিদ্যমান বেতন বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য মানববন্ধন সহ নানাবিদ কর্মসুচি পালন করতে দেখা গেছে।শিক্ষা সেক্টরের কথা বললে তো, তা শেষ করার মত নয়।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও মানববন্ধন করতে দেখা গেছে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন বেতন স্কেলের দাবিতে।দীর্ঘদিন ধরেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেতন বৈষম্যসহ দ্বিতীয় শ্রেণির পদ মর্যাদার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কর্মসুচী পালন করে আসছেন।জাতীয় শিক্ষানীতিতেও সর্বস্তরের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেলের কথা রয়েছে।সত্যি দু:খের সাথে বলতে হয়,আমার দেশের প্রাথমিক শিক্ষকরা এখনও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারি।যাঁরা কিনা দেশের সকল প্রতিষ্টানে, সকল পর্যায়ের জন্য মেধাবীদের তৈরি করে সরবরাহ করার আসল কারিগর।সরকারের শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী এমপি সহ প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক বলিয়া মনে করেন।যা প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেলের নির্দেশও দিয়েছেন।কিন্তু কমিশন শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদানে সমর্থন করেনি বলে সুপারিশে উল্লেখ করেছেন।শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেলে সমস্যা কোথায়?কমিশন দেশের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষকদের অবদানের বিষয়টি ঠিকভাবে আমলে নেননি।এতে সর্বস্তরের শিক্ষকদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে।এর নেতিবাচক প্রভাব কি জাতীয় অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্থ করবে না?

বেতন কমিশন সুপারিশ জমা দেওয়ার পর বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষকসহ সরকারি প্রতিষ্টানসমুহের কর্মচরিদের মাঝেও হতাশা বিরাজ করছে।প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিচের দিকের চার টি ধাপ ভেঙে দুইটি ধাপ সৃষ্টি করায় উপরের ধাপগুলোর সাথে বৈষম্য আরও বাড়বে।কারন হিসেবে উনারা বলছেন,প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে পদোন্নতি সুযোগ সীমিত।একই পদে বিশ পঁচিশ বছর চাকরি করার পরও পদোন্নতি হয় না।টাইমস্কেল না রাখায় পরবর্তী ধাপের সাথে ব্যবধান বাড়বেই।তাছাড়া দেশের অন্যান্য সেক্টরের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারিরা ও ঐ একই কারনে হতাশ। উনারা মনে করেন কমিশন উপর তলায় বসে, শুধু উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সুযোগ সুবিধার কথাই বেশি করে বিবেচনায় নিয়েছেন এবং তাঁরা তাঁদের বৈষম্যের কথা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করছেন। কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পূর্বে ব্যবধান কমিয়ে ১:৬ কাঠামো বিন্যস্ত করার দাবি জানিয়েছেন।যদিও কমিশন দ্বিগুণ বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে,কিন্তু কারো বেতনই দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে না।কমিশনে উল্লেখ আছে ইনক্রিম্যান্ট ও মহার্ঘ ভাতা এডজাস্টম্যান্টের পর বেতন বৃদ্ধির হার দাড়াবে ৬৩দশমিক৭ শতাংশ।এবং সুপারিশ কার্যকর হবে ১লা জুলাই-২০১৫ইং থেকে।এই বৃদ্ধির হার যৌক্তিক।কিন্তু সবার জন্য অর্থাৎ ১৬নং ধাপ থেকে ১নং ধাপে সমান হারে বৃদ্ধি যুক্তি সংগত হয়নি বলে মনে করি।এতে বাজার মুল্যে নিম্ন পদস্থদের সমস্যায় ফেলবে।যা তাঁদের অর্থনৈতিক চাপের মাঝেই রাখবে।এই কমিশনের প্রস্তাবিত বেতনকাঠামো বাস্তবায়িত হলে,নিচের দিকের কর্মচারিদের জীবনযাত্রায় স্বস্তির কোন দেখা মিলবে না।আগে যেমন চাপে থাকতেন,তেমনই থাকবেন।বরং স্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতির চাপটা মাঝখান দিয়ে তাঁদেরই সয়ে যেতে হবে।

আমরা উন্নত ও মধ্যম আয়ের দেশসমুহের বেতন কাঠামোর দিকে তাকালে তাঁদের বেতন স্কেল ১:১০এ বিন্যস্ত দৃষ্টিকটু ও প্রকট বৈষম্যপুর্ণ বেতন কাঠামো দেখতে পাই না।বিশ্বের উন্নত ও মধ্যম আয়ের দেশ সমুহে ১:৫ বা ১;৪ এ বেতনকাঠামো বিন্যস্ত করা হয়।কোন কোন দেশে যোগ্যতাভিত্তিক বেতনকাঠামোও চালু আছে।গুরুত্বপুর্ণ সেক্টরের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলও গঠন করা হয়।আমাদের পাশের দেশ ভারতে ১:৫এ এবং শ্রীলংকায় যোগ্যতাভিত্তিক বেতন স্কেল।কিন্তু আমরা স্বাধীনতার ৪৩বছর পরও ঐ আমলাতান্ত্রিক ১:১০ থেকে বেড়িয়ে আসতে পারিনি।এতে কর্মকর্তা কর্মচারিদের মাঝে সহযোগিতাপুর্ণ মনোভাবের অভাব দেখা দেয়।যা সার্বিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্থ করে এবং অনেকে চাপের মুখে দুর্নীতি করতে বাধ্য হয়।
দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমলা ব্যক্তিবর্গ দেশের নীতি নির্ধারণ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রনয়ণ করে থাকেন,উনাদের জীবনযাত্রার মানসহ রাষ্টীয় সুযোগ সুবিধা বেশি থাকবে এটা স্বাভাবিক।তাই বলে এতটা ব্যবধান কখনও শোভনীয় নয়।
আমরা আশা করবো,কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পুর্বে এই স্বাধীনতার পরবর্তী কাল থেকে প্রচলিত( ১:১০)অনুপাত থেকে বেড়িয়ে অন্তত ১:৬ এ নিয়ে আসবেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে এই চাওয়া খুব একটা বেশি হবে না।বেতন কাঠামো ১:৬ অনুপাতে বিন্যস্ত করা সম্ভব হল,তা বর্তমান সরকারের জন্য একটি অন্যতম যুগান্তকারী অর্জন ও রেকর্ড বলে বিবেচিত হবে। এতে সরকার তথা সমগ্র জাতি উপকৃত হবেন।

স্বপন তালুকদার ।
প্রাইমারি টিচার।
জিন্দাবাজার।
সিলেট।