মৃত্যুপুরী তৈরী করে দু’শ কোটি টাকা সম্পদ লুটে নেয়া হচ্ছে

সীমান্তনদী জাদুকাটার বুকে জিরো লাইনের আশেপাশে তিন শতাধিক অবৈধ পাথর কোয়ারী

sunamganj river pator lut-1হাবিব সরোয়ার আজাদঃ পরিবেশ প্রতিবেশ ও প্রচলিত আইনের প্রতি কোন তোয়াক্কা না করেই প্রচীন ইতিহ্যের সাতশত বছরের লিলাভুমি পর্যটকপ্রেমীদের তীর্থস্থান খ্যাত সীমান্তনদী জাদুকাটার বুকে জিরো লাইনের আশেপাশে প্রায় তিন শতাধিক পাথর কোয়ারী নামক মৃত্যুপুরী তৈরী করে প্রতিদিন গড়ে ২৪ হাজার ঘনফুট পাথর লুটে নেয়া হচ্ছে। গত প্রায় এক মাস ধরে ৬ মাসের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করে কমপক্ষে ২’শ কোটি টাকার পাথর লুটে নেয়ার কাজ চলছে। নদীর বুকে বছরের পর বছর ধরে পাথর আর বালি লুটের কারণে ইতিমধ্যে নদীটি গত ৪০ বছরের মধ্যে এবারই তার নিজস্ব স্বকিয়তা ও সরুপ হারিয়েছে সেই সাথে বন্ধ হয়ে গেছে ওপার থেকে নেমে আসা স্বাভাবিক পানি প্রবাহের পথ।
সরজমিনে গিয়ে কোয়ারী এলাকাঘুরে জানা গেছে, জাদুকাটা নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে নদীর বুকে উচুঁ হয়ে একাধিক চোরাবালির স্তুপ পড়েছে সেই সাথে তৈরী হয়েছে অসংখ্য মৃত্যুফাঁদ। নদীর উৎসমুখ থেকে ঘাগটিয়া-লাউড়েরগড় খেয়াঘাটের মাঝ নদীতে একনদী এখন দু’ভাগ হয়ে গেছে। পরিবেশবাদী সংগঠন ও স্থানীয় সুশীল সমাজের অভিযোগ নদী শাসনে জেলা প্রশাসন ও পরিবশে অধিদপ্তর, স্থানীয় থানা পুলিশ, বিজিবি ও উপজেলা sunamganj river pator lut-2প্রশাসনের উদাসীনতার কারণেই এখন নদীর বুকে কোয়ারী নামের একেকটি গজব বসানো হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে বিজিবির কিছু অসৎ সদস্য, কথিত পাথর সমিতি, ব্যবসায়ী মিলে একটি শক্তিশালী সিন্ডিক্যাট তৈরী করে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এসব কোয়ারী নামের একেকটি পুকুরে দু’টি করে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন শ্যালে মেশিন দিয়ে পানি সেচে এমনকি অবৈধ সেইভ মেশিন দিয়ে অপরিকল্পিত ভাবে পাথর উক্তোলন করে যাচ্ছে। কোয়ারী খনন ও পাথর উক্তোলনের জন্য পাথরখেকো চক্রের নিকট থেকে আগাম দাদন নেয়া মালিক ও গড়ে ৩ সহ¯্রাধিক শ্রমিক অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন নদীর সৌন্দর্য্য নষ্ট করা, স্বাভাবিক পানি প্রবাহের পথ বন্ধ করা ও পাথর লুটের নামে অবৈধ ভাবে মাঝে মধ্যে জিরো লাইন অতিক্রম করে ভারতের সীমানায় অনুপ্রবেশ করা সহ এহেন কোন পদ্ধতি বাদ নেই যা এখন ঐ নদীতে করা হচ্ছেনা।
জনসাধারণের চলাচলের জন্য এলজিইডি কতৃক প্রায় কয়েক কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মাণকৃত পাঁকাসড়ক সর্বসাধারণকে জীবনের হুমকির মুখে ফেলে দিয়ে প্রতিনিয়ত শতাধিক অবৈধ লরি, পিকআপভ্যান ও হ্যান্ডট্রলি দিয়ে পাথর পরিবহন করাও হচ্ছে নির্ঞ্ঝঝাটহীন ভাবে।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার উওর বাদাঘাট ও উওর বড়দল ইউনিয়নের বারেকটিলা লাগোয়া সুনামগঞ্জ ৮-বর্ডারগার্ড ব্যাটালিয়নের বিজিবির লাউড়েরগড় বিওপির নিয়ন্ত্রণাধীন মেইন পিলার ১২০৩ এর পুর্ব- উওরে ও পুর্ব দক্ষিণে নদীর ওপারে জিরো লাইনের আশে পাশে জানুয়ারীর শুরু থেকে এসব মৃত্যুপুরী নামের তিন শতাধিক কোয়ারী তৈরী করে চলছে পাথর লুটের মহোৎসব।
চরে থাকা একাধিক শ্রমিক ও কোয়ারী মালিকদের সাথে আলাপকালে নাম প্রকাশ করার না শর্তে তারা জানান, অলিখিত ভাবে পাথর লুটের কাজে সার্বিক সহায়তা ও চালকের আসনে বসেছেন খোদ বিজিবির লাউড়েরগড় বিওপির ক্যাম্প কমান্ডার। তার আশেপাশ জুড়ে রয়েছে বেশ কিছু প্রভাবশালী সুবিধাভোগী লোকজন ও কথিত পাথর ব্যবসায়ী ও স্থানীয় কলমকেরানী নামের হাতে গোনা আরো ক’জন সুবিধাভোগী। ওখানের চোরাচালান বাণিজ্য, বখরা আদায় আর পাথর লুটের বিষয়ে কিছু লিখতে গেলেই কলমকেরানীরা নানা অভিযোগ তুলে গণমাধ্যকর্মীদের বিরুদ্ধেই উল্টো বিষেধাগার করে নানা অখ্যাত ও অনলাইন পোর্টালে সিসি দিয়ে সংবাদ প্রকাশে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে।
উপজেলার ঘাগটিয়া গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কোয়ারী মালিক বললেন, বিজিবির ক্যাম্প কমান্ডারের মৌখিক সম্মতি নিয়েই আমার মত অনেকেই জিরো লাইনের ওপারে ও এপারে গত এক মাস ধরে প্রায় তিনশতাধিক কোয়ারী খনন করেছেন। এসব কোয়ারী পানি সেচ ও পাথর উঠানোর জন্য কোনটিতে একটি আবার কোনটিতে দু’টি করে শ্যালে মেশিন বসানো হয়েছে। আসলে শ্যালে মেশিন পানি সেচার কাজে ব্যবহার করলেও মাঝে মাঝে এর দ্বারা সেইভ মেশিনের ব্যবহার করে পাথর উঠানোর কাজও করা হয়। প্রতিটি কোয়ারী ১৫ থেকে ১৮ হাত গভীর ও একটি ছোট পুকুরের মতই খোড়া (খনন করা হয়েছে। এসব কোয়ারী থেকে গড়ে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জন হাজিরা শ্রমিক গড়ে ৮’শ থেকে ১ হাজার ফুট বোল্ডার, ভুতু ও সিঙ্গেল পাথর উক্তোলন করছে। এসব উক্তোলন কৃত পাথর প্রতিদিন শতাধিক মাহেন্দ্র লরি ও হ্যান্ড ট্রলি ও পিকআপ ভ্যানে করে হয় লাউড়েরগড় বাজারের নদীর পাশে না হয় সুনামঞ্জের বেঠাখালী ঘাটে নেয়া হয়। প্রতিদিন একেকটি লরি কাছাকাছি হলে ৫ থেকে ৭টি ট্রিপ দিতে পারে। আমরা কোয়ারী থেকে পাথর গুলো ৭ , ১৩ ও ৩২ টাকা ঘনফুট দামে ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রয় করে আসছি। স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পের কথা বলে পার্শ্ববর্তী পুরান লাউড়েরগড় গ্রামের গ্রাম সরকার নুর ইসলামের ছেলে নয়ন ও কেউড়ির আকবর আলীর ছেলে শামছুল প্রতিদিন প্রতিটি কোয়ারী থেকে ৩’শ টাকা করে ও লরি সহ অন্যান্য পরিবহনে প্রতিট্রিপ এ পাথর ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে ১’শ টাকা করে আদায় করছে। এভাবে গড়ে প্রতিদিন এসব কোয়ারী থেকে অবৈধভাবে প্রতিমাসে ৩২ কোটি ৪০ লাখ টাকার আর সামনের জুন মাস পর্য্যন্ত টানা ৬ মাসে নদীকে বিরানভুমি আর মৃত্যুপুরী বানিয়ে ১৯৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার পাথর লুটে নেয়ার কাজ চলছে।
উপজেলার শান্তিপুর গ্রামের অপর এক কোয়ারী মালিক বললেন, নদীর চরে এখন অস্থায়ী ভাবে বেশ কিছু দিন ধরে ভাতের হোটেল, চায়ের দোকান ও ডিজেলের দোকানও বসেছে।
স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে আলাপকালে আরো জানা যায়, ওপারের মেঘালয় পাহাড়ের বুক চিরে বের হয়ে আসা বাংলাদেশ অংশের ২৩ কিলোমিটার দৈর্ঘের সীমান্তনদী জাদুকাঁটায় গত অর্ধশত বছর ধরে হাজারো শ্রমিক হাতে বেলচা ঝুরি বালতি দিয়ে বালি পাথর উক্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করে এসেছে। গত প্রায় ১ যুগের বেশী সময় ধরে ধনাঢ্য আর বালি পাথর খেকো দানবদের থাবায় নদীর তীর কাটা, সেইভ মেশিন , ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালি পাথর উক্তোলনের ফলে নদীর দু’তীরের অর্ধশতাধিক গ্রাম নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে শতাধিক ঘরবাড়ি, হাটবাজার, রাস্তাঘাট,। বিজিবি (পুর্বে) বিডিআর ক্যাম্প,ধর্মীয় প্রতিষ্টান ও স্থাপনা পড়ে হুমকির মুখে এছাড়াও কয়েকটি হাওরে বালি পড়ে মরুভুমিতে পরিণত হয়েছে। গত দশ বছর পুর্বে বিজিবি ক্যাম্প , লাইড়েরগড় বাজার, বড়টেক সহ আশে পাশের এলাকা নতুন করে নদী ভাঙ্গন রোধে জেলা প্রশাসন, পাউবো, বিজিবির ব্যাটালিয়ন কমান্ড, উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে জনস্বার্থে জিরো লাইনের বালুচর থেকে বালি ও পাথর উক্তোলন কাজ বন্ধ করে দেন। অপরিকল্পিত ভাবে বালি পাথর উক্তোলনের ফলে গত ৫ বছরে বারেকটিলা খেয়াঘাট ও ঘাগটিয়া খেয়াঘাটে কম পক্ষ্যে ৬টি খেয়া নৌকা ডুবির ঘটনায় ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে মোটর সাইকেল সহ চালক ও যাত্রী মিলে কমপক্ষে ৬ জনের লাশ ঐ মৃত্যুকোপ নামক কোয়ারীর চুড়াবালিতেই নিমজ্জিত হয়ে পড়ে রয়েছে। গত দু’বছরে ঐ চরের চুড়াবালিতে ২ কয়লা শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটেছে। লরি চাপায় গত দু’বছর পুর্বে নদীর চরে এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। গত ৫ বছর ধরে কয়লা কুড়ানোর নামে ঐ চরে নামানো হয় শ্রমিক। আর চলতি বছর লোভ সামলাতে না পেরে চরের বালি অপসারণ করে পুকুরের আদলে কোয়ারী করার সুযোগ তৈরী করে ক্যাম্প কমান্ডার ও তার সাথে থাকা কিছু অসৎ বিজিবির সদস্য। পাথরখেকো চক্রের দানবরা সংঘবদ্ধ হয়ে মৃত্যুপুরী এমনকি নদীটিকে গলাটিপে হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
সিলেটের পর্যটক ও পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতা হাসান মোর্শেদ বললেন, প্রতিবছর লক্ষাধিক দেশী বিদেশী পর্যটক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থীগণ এমনকি আমনরা নিজেরাও বারেকটিলা ও জাদুকাটা নদীর সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে গিয়ে ঐ চরে ও টিলায় আসা যাওয়া করি। এমন কর্মযজ্ঞে আমরা হতবাক হলাম কি করে এমন ষ্পর্শকাতর জিরো লাইনে এতগুলো কোয়ারী খনন করে মৃত্যুপুরী তৈরী করা হয়েছে।
ঢাকার বারিধারার বাসিন্দা মাহফুজা তুহিন বললেন, আমরা শতাধিক পর্যটক দু’বছর পুর্বে ব্লু-মুন দেখতে জাদুকাটার চরে গিয়েছিলাম সত্যিই এ যেন বাংলার আরেক সৌন্দর্যের লিলাভুমি একে রক্ষা করার জন্য আমি সংশিলস্ট প্রশাসনের প্রতি আহবান জানাই।
ঢাকার পরিবেশ ও মানবাধিকার উন্নয়ন সোসাইটির মহাপরিচালক এবি রাজ্জাক তার নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করতে গিয়ে বললেন এভাবে সীমান্তের লাগোয়া নদীর চরে কোয়ারী খনন করাটা সম্পুর্ণ বে-আইনি ও পরিবেশের সাথে নিরাপক্তার স্বার্থে সাংঘর্ষিক বিষয়। এভাবে যদি কোয়ারী খনন করে পাথর উক্তোলন করা হয় তবে বর্ষায় প্রতিটি গর্তে বালি পলি পড়ে চুরাবালির মরনফাঁদ তৈরী হবে এক সময় দেখা যাবে এসব চরে দরিদ্র পরিবারের লোকজন লাকড়ি কয়লা কুড়াতে গিয়ে অথবা পর্যটকরা চরে বেড়াতে গিয়ে চুরাবালিতে ডুবে মারাও যেতে পারেন। কাজেই এ তান্ডব বন্ধ করে দেয়াটাই এখন জরুরী।
লাউড়েরগড় গ্রামের পরিবেশ উন্নয়নকর্মী সারোয়ার জাহান ও ঘাগটিয়া গ্রামের কলেজ শিক্ষার্থী রাহুল মিয়া বললেন, প্রতিবছর দুই ঈদে, পুজার সময় , বড়দিন উপলক্ষে এলাকার হাজার হাজার পরিবার বারেকটিলা ও চরে তাদের বিনোদন কেন্দ্র হিসাবে বেড়াতে আসেন। এভাবে লাখো মানুষের বিনোদন কেন্দ্রকে বিরাণভুমি আর মরণফাঁদ বানিয়ে কয়েক’শ পাথর খেকো দানবের স্বার্থ রক্ষার করাটা জরুরী নয়।
গত কয়েকদিন পুর্বে স্থানীয় বিজিবির ক্যাম্প কমান্ডার নায়েব সুবেদার ইমাম হোসেন মুঠোফোনে জানান, ফরেষ্টের লোকজন এসে চরটি দেখে গেছেন আমি আমার কতৃপক্ষকে রিপোর্ট দিয়েছি। এলাকার গরিব মানুষ পানি সেচে পাথর উঠাচ্ছে এটা উনারা জানেন। এ বিষয়ে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে.কর্ণেল গোলাম মহিউদ্দিন খন্দকার বলেন, আমি ক্যাম্প কমান্ডারকে নির্দেশ দিয়েছি জিরো লাইনের দু’শ থেকে আড়াই’শ গজের ভেতরে কোন লোক ডুকবে না কয়লাও কুড়াবে না। বিজিবির নামে টাকা পয়সা নেয়ার বিষয়টি কেউ অভিযোগ করেনা। উপযুক্ত প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।