অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরন

আব্দুল আজিজ তকি

Bangladesh Map‘হিকমত’ ছাড়া ‘হুকুমত’ হাছিল হয় না। অনাধিকালের ইতিহাস তার স্বাক্ষী। ইতিহাসে একটু চোখ বুলালেই যে কেউ এমনটি বুঝতে পারবেন। কথা হল কি, কেউ যদি ইতিহাসই দেখেনা তা’হলে কিভাবে শিক্ষাটা নেবে বুঝতে পারছিনা। হালে কিছু মুসলিম ভাই-বোনেরা ইসলামি রাস্ট্র তৈরির স্বপ্ন বাস্তবায়নে হাতিয়ার হাতে তুলে নিয়েছেন। কিন্তু তারা আগপিছ ভাল করে দেখেছেন বলে মনে হয় না। নিজেদের ল্যাজ কতটা শক্ত-সাবুদ আছে দেখে নেয়াটা যে জরুরী তা’দের সে জ্ঞাণ আছে কিনা জানি না। আমার মনে হয় নেই।এমন জ্ঞাণ থাকলে নিশ্চয় ইরাক অথবা শিরিয়ার মাটিতে দু’চারটা বন্ধুক, আর কয়েক হালি গোলাবারুদ এর বস্তা নিয়ে জান খতরার মধ্যে উঠতি বয়সী এই ছোকরা-ছোকরীর দল মরনগর্তে পা বাড়াতো না। তাদের বুঝা উচিৎ যে ফটাং (বাঁশের চোঙ্গাদিয়ে তৈরী বাচ্চাদের খেলনার বন্ধুক) দিয়ে যেমনি একটা চড়ুই পাখি মারা যায়না তেমনি হাতে পরিচালিত বন্ধুক নিয়ে বিমান হামলার মুখে দাঁড়ানো যায়না। আমার কথাগুলো হয়তো অনেকের কাছে ভাল নাও লাগতে পারে। তা না লাগুক, আমিতো আর বাকবিতন্ডার যুদ্ধে নামি নাই। জ্ঞাণ দেবার দায়েও কলম ধরিনাই। উচিৎ অনুচিৎ নিয়েও কারো সাথে তর্ক বাধাই নাই যে লাফ দিয়ে টাস করে বাঁশ দিয়ে মাথায় একটা বাড়ি মারবেন। কথার কথাই বলছি।
ইসলামের নাম ধরে ইসলামী হুকুমত কায়েমে যারা জংগ করতে নেমে জঙীর খাঁতায় নাম লিখিয়ে জান কুরবানী করছেন এদের দেখে বুকটা কম্পিত। নিজে কিছু করতে পারছিনা বলে অপরাধী ভাবী। বুকের এই ব্যথা নিবারণের কোন ঔশধ নেই বলে জংগের বদলে জবানে ‘আল্লাহু আকবর’ ‘আল্লাহু আকবার’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ মহান’ ধ্বণী তুলছি। কারণ আমি একজন মুসলমান হিসাবে ইসলামকে কোনমতেই অনৈসলামিক ভাবে ব্যবহার করে অমুসলিমদের কাছে খাঁটো হতে চাইনা।আমার ভাইয়েরা কি করছেন বোধগম্য নয়।
অসহায়ের মত মুসলমানদের মারামারি আর কত দেখবো। অবস্থাদৃষ্ঠে মনে হয় কিয়ামত বেশী দূরে নয়। মানুষ যখন নিজেরাই মানুষের আজরাইল হয়ে গেছে তখন দুনিয়ায় মানব বসতির হায়াৎ বিলক্ষন বেশী নেই। যে কোন ক্ষনে মহাপ্রলয়ের ধাক্কা খেয়ে আসমান জমিন উলট পালট হতে পারে। আর তা’ না হলেও বলা যায় একদল লোক পতনের দিগে আস্তে আস্তে ধাবিত হচ্ছে। আর এ দলটিই মুসলমান। আমাদের মুসলিম ভাই বেরাদরের যে হালচাল আর রক্তের হুলিখেলা বিশ্বজোড়ে চলছে এটা যদি এমনিভাবে চলতে থাকে তা’হলে নিংসন্দেহে পতন অনিবার্য। কবি নজরুলের ভাষায় বলতে হয় ‘আসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ’। মুসলমানদের এমন ভরাডুবির কারণ অনুসন্ধানে গেলে প্রথমেই বলতে হয় বর্তমান মুসলানরা আসল জ্ঞাণ, বিজ্ঞাণ, চিন্তা-চেতনা, বিজ্ঞতা এমন কি অভিজ্ঞতা থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছে। শিক্ষা-সংস্কৃতি মানুষের ভিতর যে আলো জেলে অন্ধকারত্বকে সরিয়ে দিয়ে মানুষকে আলোকিত করে সে আলো মুসলমানদের ভিতর জলছে বলে মনে হয় না। যদি এই বাতি জলতো তা’হলে মুসলমানরা উদারতা,সহিষ্ণতা,সহমর্মিতা, সহানুভুতি সর্বপোরি নিজেদের হেকমত চালিয়ে দুনিয়ায় হুকুমত চালাবার সাহস দেখাতে পারতো। একসময় সারা বিশ্বে মুসলমানদের এ সম্মান ছিল।
জ্ঞাণ বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান অস্বীকার করার মত সাহস কোন বেটার নেই। বিজ্ঞানের যতই উন্নতি হোক না কেন, এমন উন্নতির শুরুটা কিন্তু মুসলমানদের হাতে। আধুনিক বিশ্বের সকলেই তা’ মাথাপেতে নেয়। তবে সেতো পুরোনো দিনের কথা। মুসলমানরা ঠিকই শুরু করলেন কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উন্নতির ধারাবাহিকতাটা বেশীদিন ধরে রাখতে পারলেন না। যে পুত-পবিত্র গ্রন্থখানি দিয়ে জ্ঞাণের আলো মুসলমানদের দেয়া হল সে জ্ঞানের আলোকে বিজ্ঞানের আলো মাখিয়ে নিজেদের যে স্থরে পৌছানোর কথা ছিল মুসলমানরা সেখানে পৌছতে পারলো না। না হলে ভৌগলিক জ্ঞাণে ইবনে বতুতা, ইবনে খালদুনকে প্রাচ্য প্রতিচ্য যেভাবে নমঃ নমঃ করে তা’ দেখে কে না গর্ব করে। কিন্তু তারাতো আজকালকার লোক নয়। এদের পথ অনুসরনে মসলমানরা আর রইলো না, বিচ্যুত হয়ে পড়লো। সেই ১১৬৬ সালে মুসলিম পন্ডিত আল ইদ্রিসি পাহাড় পর্বত, শহর নদী দিয়ে নিখুঁত বিশ্ব-ম্যাপ তৈরি করেছিলেন। আর আল মুকসাদী প্রথম ভৌগলিক যিনি রঙ দিয়ে একেবারে নির্ভূল ম্যাপ তৈরী করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। স্পেনের ৭০০ বছরের মুসলিম শাসন আমলে স্থাপিত হয়েছিল centers of learning। দুনিয়ার সকলের কাছে এগুলো প্রশংসীত হয়েছিল। জানার বিষয় যে Christopher Columbus আমেরিকা পৌছলেন তার নেভিগ্যাটরটাতে ছিল মুসলমানদের অবদান। ভা¯ক দা গামা ও কলম্বাস দু’জনেই মুসলিমদের তৈরি নেভিগ্যাটর ব্যবহার করে সাগর পাড়ি দিয়ে নতুন নতুন দেশে পৌছেছিলেন। জিরো আকৃতিটি মুসলমানের সৃষ্টি, ‘সাইফার’ সব্দটা আরবিক ‘সিফর’ থেকে এসেছে। মুসলমানরা সর্বদা ধর্মীয় অথবা ধর্মনিরপেক্ষতার জ্ঞাণ অন্বেষণ করেছে। যে কারণে নবী মোহাম্মদের (দঃ) মিশন অল্পদিনের ভিতর দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে প্রজ্জলিত হয়েছিল। ফলে হাজার বছর আগের তিউনিসিয়ার আল-জয়তুন (Al-Zaytunah), কায়রুর আল-আজহার (Al-Zaytunah) এর মত বিশ্ববিদ্যালয় এখনও চলমান রয়েছে। ইউরোপের প্রথম দিগের ইউনিভার্সিটিগুলো যেমন বলুনা (Bologna), হাইডেলবার্গ (Heidelberg), সরবনে (Sorbonne) এগুলো কিন্তু ঐ মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে গড়া হয়েছে। এমন কি শিক্ষাশেষে যে টুপি ও গাউন পরে ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী নেয়ার সমাবর্তনী হয় এটা কিন্তু আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়েরই উদ্ভাবন।
প্রথম মুসলমান গণিতিক আল- কাওয়ারিজমি (Al-Khawarizmi) আল-জাবরা উদ্ভাবন করেছিলেন। ইবনে সিনা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পুরোধা। তার বই ৭০০ বছর ইউরোপের সাধারণ পাঠ্যবই হিসাবে পঠিত হয়েছে। এবনে সিনার কাজ আজও কিন্তু পড়ানো হয়। আর Al-Razi মধ্যযুগে সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক ও চিকৎসা বিজ্ঞানি ছিলেন। এমন কি এগারো শতাব্দিতে Abul-Qasim Az-Zahrawi ছিলেন অত্যন্ত নামকরা সার্জন। ইবসে সিনার বই কKitab al-Shifa ঔষধ তৈরীতে বিশেষ অবদান রেখেছে। গ্যালিলিয়কে বলা হয় টেলিস্কপের উদ্ভাবক কিন্তু সত্য কথাটা হল Abu Ishaq ibn Jundub দূরের কিছু দেখার বস্তু ও নিয়মাবলী বানিয়েছিলেন। আর রসায়ন বিজ্ঞানে Jabir ibn Hayyan এর স্থান অগ্রগন্য। ইবনে খালদুন রাজরাজুড়ার গল্প থেকে ইতিহাসকে বদলে নিয়ে সমাজবিজ্ঞানে পরিনত করেছেন এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। ইউরোপীয়ানরা স্বীকার করেছে যে খালদুন এর ‘মোকাদ্দমা’ বইটি একাই একেবারে একশত। তিনিই ইউরোপকে দিয়েছেন আধুনিক ইতিহাস বিজ্ঞান। বলা যায় ইসলামিক আন্দোলন সৃষ্ঠি করেছিল ইবনে খালদুন আর ইবনে খালদুন সৃষ্ঠি করেছিলেন আধুনিক ইতিহাস বিজ্ঞান। তার মত করে আর কোন আরব অনারব দার্শনিক ইতিহাসের গতি প্রকৃতিকে এত পরিপূরক করতে পারেন নাই। যে কারনে তিনিই আজ অবদি ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ট দার্শনিক।
মুসলমানদের সৌর্যবির্যের কিছু উদাহরণ তুলে ধরলাম। আমাদের জেহাদি ভাইদের বলবো ইসলামকে নিয়ে নাড়াছাড়া করার আগে ‘হিকমত’ কি তা’ একটু জেনে নিন। এমনটি জানতে পারলে ক্ষতির চেয়ে বেশী লাভবান হবেন। ইসলামও রক্তপাতহীন ভাবে জ্ঞাণের আলো দিয়ে দুনিয়াকে আলোকিত করতে পারবে।