দায়িত্বশীলদের সংযত হয়ে কথা বলাই ভালো

Abdul Kahharমুহাম্মদ আবদুল কাহহার: কথার কথা নাকি বাজে কথা! কথায় কথা আসে। আর এ কথা নিয়ে কথার শেষ নেই। কথাই মানুষকে এগিয়ে দেয় কিংবা পিছিয়ে দেয়। কথার মাধ্যমে জানা যায়, কে বন্ধু আর কে শত্রু। কাটা দাগ ঘুচে গেলেও কিছু কথার দাগ আছে যা সহজে মুছে যায় না। কথা যদি কল্যাণের হয় তাহলে বলা উচিত অন্যথায় না বলাই শ্রেয়। ব্যক্তি থেকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে যতটুকু দায়িত্বের অধিকারী তার ততটা দায়িত্ব নিয়েই কথা বলা ও সেই পরিমাণ কাজ করা উচিত। কথাই মানুষকে স্বস্তি দেয়, শান্তি দেয়, আবার কথাই মানুষকে শাস্তি দেয়। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যখন বাজে মন্তব্য করেন তখন সাধারণ নাগরিকরা অস্বস্তিতে ভোগেন, কখনো সমস্যায় পড়েন। নাগরিকরা রাষ্ট্রের কাছে তার ন্যায্য অধিকার চায়, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে চায়। চায় সার্বিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। যখন এর ব্যাত্যয় ঘটে তখনই নানামুখী সমস্যা দেখা দেয়। সম্প্রতি যাদের কথায় অধিকাংশ শ্রেণি পেশার মানুষ অসন্তষ্ট, ক্ষুব্ধ তাদেরই একজন মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দূল মুহিত। রাষ্ট্রের বড় একটি দায়িত্বে থাকা এ মন্ত্রী নাগরিকদের যেভাবে বেকায়দায় ফেলছেন তেমনি সরকারকেও করেছেন বিব্রত। আর তাই বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সভায় (১১ নভেম্বর’১২) দলের নেতারা বলেছেন, মুহিত সাহেব মহাজোট সরকারের মহা বিড়ম্বনায় পরিণত হয়েছেন। ওবায়দুল কাদের তার সম্পর্কে বলেেেছন, অর্থ মন্ত্রী মাঝে মাঝেই কিছু কথা সুয়িপিং রিমার্কস করেন। যেটা দেশের মানুষকে হতাশ করে।
আমরা তাকে শ্রদ্ধার সাথে দেখি। তার হাসি আমাদেরকে মুগ্ধ করে। তার মতো এতটা বয়স এবং কর্মক্ষমতা আমরা পাব কি পাবো না জানিনা। তবুও বলতে হয়, অর্থ মন্ত্রীর অনেক কথা অনেককেই বিব্রত করে, ক্ষুব্ধ করে। মন্ত্রীদেরমধ্যে তিনি বিভিন্ন সময়ে শুধু কথা বলার কারণে সংবাদ শিরোনাম হয়ে থাকেন। যা কাম্য নয়। সঠিক ভাবে কথা বলতে না পারলে যে কারোরই চুপ থাকা উচিত। অথচ আমাদের অর্থমন্ত্রী সে নিয়মের যেন তোয়াক্কাই করেন না। যখন যেখানে যা বলা দরকার তা না বলে ভিন্ন কিছু বলায় নিজেকে হাস্যকর করে তুলছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি’র উপর বর্ধিত আরোপিত ৭.৫% ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দেলনের ডাক দেয়। এমতাবস্থায় অর্থমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন,“ শিক্ষার্থীদেরই ভ্যাট দিতে হবে। (১১ সেপ্টেম্বর.’১৫)। হাজারে ৭৫ টাকা বড় কিছু নয়। (১২সেপ্টেম্বর ’১৫)। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট কমানো হবেনা (১৪সেপ্টেম্বর ’১৫)। অর্থমন্ত্রী এ ধরণের মন্তব্য করায় প্রতিবাদ আর মানববন্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বৃহৎ আন্দোলনে রূপ নিতে থাকে। বিশেষ করে কাশ বর্জন, সড়ক-মহাসড়কে অবস্থান ধর্মগট, সব ধরণের যান চলাচল বন্ধ করতে সক্ষমতা, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাগুলো সম্পূর্ণভাবে অচল হয়ে পড়ে। পরিশেষে অর্থমন্ত্রী ও সরকার তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে শিক্ষার্থীদের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। অর্থমন্ত্রী ও নীতি-নির্ধারনী পর্যায়ে যারা রয়েছেন তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারায় সরকারকে হোঁচট খেতে হয়েছে। একই সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দাবি করায় অর্থমন্ত্রী বললেন, “জ্ঞানের অভাবে শিক্ষকরা আন্দোলন করছে।” সম্মানিত শিক্ষকদের সম্পর্কে অজ্ঞতাপ্রসূত মন্তব্য করায় গোটা শিক্ষক সমাজ সংক্ষুব্ধ ও বিক্ষুব্ধ হন। যা গড়িয়ে ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষকদের নিয়ে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যের সমালোচনা সংসদেও হলে অর্থমন্ত্রী বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হন। তাই বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বেধে দেয়া ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটামে শেষ না হতেই তিনি শিক্ষকদের সম্পর্কে করা মন্তব্য নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন।
মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকায় দেশের বিভিন্ন চলমান ইস্যুতে তাকে কথা বলতে হয়। তাই বলে যা ইচ্ছা তাই বলে যাবেন এমনটি হতে পারে না, হওয়ার কথা নয় তবুও তিনি বলে যাচ্ছেন। বাজারে পণ্যের মূল্য চড়া হওয়ায় তিনি সমাধান হিসেবে বললেন, “সপ্তাহে একদিন কম বাজারে যাবেন। একদিন বাজারে না গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।” প্রতিনিয়ত দ্রব্যমুল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়লেও তিনি বলছেন, “দেশের মানুষ খেয়ে পড়ে ভাল আছে”। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়ে যখন পথে বসেছেন, তখন তিনি বললেন,“আমি শেয়ার বাজার বুঝি না, একটা ফটকা বাজার”। ‘শেয়ার বাজার দুষ্ট বাজার এবং এখানকার সবাই দুষ্ট। না হলে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পরও এই বাজারে মানুষজন কেন রয়েছে? শেয়ার মার্কেটে কোন ইনভেস্টর নেই, সব জুয়াড়ি। ” ট্রানজিটের বিরোধীতা যারা করে তারা ননসেন্স। (১৭ আগস্ট’১০)। অর্থমন্ত্রী কথায় কথায় রাবিশ-খবিশ, ইডিয়ট, ননসেন্স এ জাতীয় শব্দগুলো বলতে বেশ পছন্দ করেন। এসব আসলে কোনো দায়িত্বশীল লোকের বক্তব্য হওয়া ঠিক নয়।
জাতীয় প্রেসকাবে পুলিশের জন্য বরাদ্ধ বাড়ানো প্রসঙ্গে গোলাম মাওলা রনি এমপি (সাবেক) বলেন, ‘এ বরাদ্দ বাড়ানোর কথা কাকে বলব? অর্থমন্ত্রীর কাছে যাব, যদি তিনি আমাকে ‘রাবিশ’ বলে ফেলেন!’ (প্রথম আলো, ১১ মে’১২)। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, বাজেট বক্তৃতায় মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন, এমন কথা বিরোধী দল ও বলে না। (আমাদের সময়, ২৮ জুন’১৫)। সিলেটে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন,‘ওরা বাস্টার্ড’ (মানবজমীন, ২৩ মে’১৫)।
অর্থমন্ত্রীর কথা নিয়ে যতটা লেখালেখি হয়েছে এরকম অন্য কারো বেলায় হয়েছে বলে আমার জানা নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে কথা কম বলতে বলেছেন বলে জাতীয় সংসদে এ কথা স্বীকার করেছেন। তদুপরি ওনার কথা থেমে নেই। তিনি যেন সব বিষয় কথা বলতেই পছন্দ করেন। রাষ্ট্রের কোন বিষয়ই যেন তার চোখ এড়ায় না। মানুষের বাসা-বাড়িতে গ্যাস সমস্যা নিয়ে মন্তব্য করেছেন, “বাসা বাড়িতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া উচিত।” রানা প্লাজা ধ্বসে হয়ে ১২০০ ’র অধিক মৃত্যুবরণ করলে তিনি বিরূপ মন্তব্য করে বলেন, “সাভারের ভবন ধ্বস সিরিয়াস কিছু নয়।” পদ্মা সেতুর কাজ বিলম্বে শুরু হওয়ায় নোবেল বিজয়ী ড. মেহাম্মদ ইউনুসকে দায়ী করে বলেছেন, “দেশের একমাত্র সমস্যা ড. ইউনূস। সে তো একজন টোটাল রাবিশ।” দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে তিনি অসৎ লোক বলেও কটুক্তি করেছেন। এছাড়া দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ‘স্টুপিড লিডার’ আখ্যায়িত করেও কথা বলেছেন। এছাড়া হলমার্ক কেলেঙ্কারির হোতা তানভীরের পক্ষে সাফাই গেয়ে বললেন, “তিন বা চার হাজার কোটি টাকা এটা কোন বড় অঙ্কের টাকা নয়।” এ কথার জের হিসেবে জাতীয় সংসদে অর্থ মন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা হলে এ বক্তব্যের জন্য সরাসরি ক্ষমা চেয়ে বক্তব্য প্রত্যাহার করে তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন, “এ মুহূর্তে বোধ হয় আমিই দেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। ” এভাবেই নিজেই নিজের সমালোচনা করেছিলেন। অর্থমন্ত্রীকে আমরা একজন প্রবীণ হিসেবে মনে করি। বয়সের ভারে ন্যুজ এই মানুষটি কেন যে স্বেচ্ছা অবসর নেন না তা বলা মুশকিল। যাইহোক, আমরা দায়িত্বশীল পদে থাকা কারো কাছ থেকে দায়িত্বহীন মন্তব্য আশা করতে পারি না। কেননা, এটি ব্যক্তির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকেও হেয় করে। তাই দায়িত্বশীলদের সংযত হয়ে কথা বলাই ভালো।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
[email protected]