লিয়াকতের সন্ত্রাসী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে তিন উপজেলা

Liyakot_Jaintyaছামির মাহমুদঃ সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপর উপজেলায় লিয়াকতের রয়েছে নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। এই তিন উপজেলার পাথর কোয়ারি, বোমা মেশিন, স্টোন ক্রাশার মিল, এমপির ডিও লেটারে বিনা টেন্ডারে পাথর কোয়ারির খাস কালেকশন, সীমান্তের চোরাচালান সিন্ডিকেট, মামলার তদবির, বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানীর কাছে জমি ক্রয় বিক্রয় সব কিছুই চলে জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক লিয়াকত আলী ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা। এই বাহিনীতে আছেন কলেজের শিক্ষক থেকে শুরু করে শ্রমিক পর্যন্ত। তাকে এড়িয়ে কেউ কিছু করতে গেলেই নেমে আসে নির্যাতন, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়ারানী। এসব কিছুতেও যদি ভাগে আনতে ব্যর্থ হলে সেই ব্যক্তিকে খুন পর্যন্ত হয় আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা লিয়াকতের ইশরায়। এক কথায় চুন থেকে পান কশতে হলে সব কিছুতেই লিয়াকত স্থানীয় এমপির নামভাঙ্গিয়ে করে থাকেন। উপজেলা প্রশাসন থেকে পুলিশ প্রশাসন সবাই তাকে ভয় পান এমপির খাস লোক বলে। ফলে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপর উপজেলায় বিস্তৃত লিয়াকতের কালো থাবা।
গতকাল সোমবার সবুজ সিলেটে অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন ‘লাগামহীন লিয়াকত’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে সকালেই তিন উপজেলায় মুহুর্তের মধ্যে সবুজ সিলেট’র সব কপি বিক্রি হয়ে যায়। সংবাদটি ফটোস্ট্যাট হয়েছে সহস্রাধিক কপি বলে জানা গেছে। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চতুর লিয়াকত এখন জৈন্তা পর্যটন উন্নয়ন ও পুরাকীর্তি সংরক্ষণ পরিষদের উদ্যোগে ক্রাশার মিল-বোমা মেশিন বন্ধ ও ভূমিখোকোদের উচ্ছেদের দাবিতে আজ বেলা ১টায় মোকামপুঞ্জির আলু বাগান এলাকায় মানববন্ধনের আয়োজন করেছে। গতকাল এ বিষয়ে মাইকিং করানো হয় জৈন্তাপুর উপজেলাজুড়ে। ওই কমিটির সভাপতি ফয়েজ আহমদ বাবর ও সাধারণ সম্পাদক হামিদুল হক ভূঁইয়া বাবুলও তার বাহিনীর অন্যতম সদস্য। এই বাহিনীই জৈন্তাপুরের নলজুর থেকে জাফলং পাথর কোয়ারি পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে থাকা সহস্রাধিক বৃক্ষ কেটে বনবিট ও সড়ক জনপদের জায়গায় প্রায় ৫০০ ক্রাশার মেশিন ভাড়ায় বসিয়েছেন। ওই সব ক্রাশার মেশিন থেকে মাসে ৫০ হাজার টাকা করে ভাড়া তুলে লিয়াকত বাহিনী। এই টাকার একটি বড় অংশের ভাগ পান আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতা, উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, ও বনবিভাগের কর্মকর্তারা। আর এ কারণেই নির্বিঘেœ পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম অবৈধভাবে চলে আসলেও দেখে না দেখার ভান করেন সংশ্লিষ্টরা। এই লিয়াকত বাহিনী এখনও পরিবেশ রক্ষার কথা বলে নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে চাচ্ছে। জৈন্তারপুরের পরিবেশ ধ্বংসের মুলেও রয়েছেন লিয়াকত। মোকামপুঞ্জির পান-সুপারির বাগন ধ্বংস করে তার মালিকানাধীন বানকান স্টোন ক্রাশার মিল বসিয়েছেন।
অনুসন্ধনে জানা গেছে, কোম্পানীগঞ্জ ভোলাগঞ্জ কোয়ারিতে বোমা মেশিন, রোপওয়ের মুল স্টেশন (‘ভোলাগঞ্জ স্টোন ক্রাশিং প্লান্ট’) এর নিচ থেকে পাথর তুলে) রোপওয়ে স্টেশনটিকে ধ্বংস করার পেছনে লিয়াকতের হাত রয়েছে। ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিতে শতাধিক অবৈধ বোমা মেশিন ও সহস্রাধিক পাথরের প্রতিটি গর্ত থেকে দৈনিক ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা করে দৈনিক লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে শামীম বাহিনী। আর ওই শামীম বাহিনীর গডফাদারও হচ্ছে লিয়াকত। সে মুলত স্থানীয় এমপি, পুলিশ ও জেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে । এছাড়াও উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে লিয়াকতের মাধ্যমে ম্যানেজ করে পাথর খেকোরা। ভোলাগঞ্জ ও উৎমা পাথর কোয়ারির খাস কালেকশন এমপির ডিও লেটারের মাধ্যমে বিনা টেন্ডারে নামমাত্র মূল্যে ইজারা নিয়ে নিজস্ব লোকদের দেয় লিয়াকত। ফলে সরকার দুটি কোয়ারি থেকে দৈনিক প্রায় ৫ লাখ টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত বছরের ২৪ অক্টোবর কোম্পানীগঞ্জের কাটাখালে আলফু চেয়ারম্যান এর লোকদের হাতে খুন হন যুবলীগ নেতা ও পাথর ব্যবসায়ী আবদুল আলী। এই খুনের নেপথ্যের নায়কও এই আলোচিত আ’লীগ নেতা লিয়াকত। লিয়াকত আলফু মিয়া চেয়ারম্যানেরও গডফাদার। নিহত আ্বদুল আলীর পরিবারের অবিযোগ হত্যাকান্ডের পরদিন খুনি আলফুকে লিয়াকত স্থানীয় এমপি ইমরান আহমদের সাথে দেখা করিয়ে দেয়ার জন্য জৈন্তাপুরের শ্রীপুরে বাংলোয় নিয়ে যায়। বাংলো থেকে বের হওয়ার পরপরই সেখান থেকে আলফু চেয়ারম্যান, শফিক মেম্বারসহ কয়েকজন আওয়ামীলীগ নেতাকে আটক করে ডিবি পুলিশ। পরে আলফু ও শফিকসহ তিনজনকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেয়া হয়।
অভিযোগ আছে জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মখলিছুর রহমান দৌলা হত্যাকান্ডের পরিকল্পনার সাথেও জৈন্তাপুর আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক লিয়াকতের হাত রয়েছে। দৌলা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি গ্রেফতারকৃত মো. বিলাল উদ্দিন ওরফে টলা বিলাল ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক লিয়াকত আলীর আপন মামা শশুর। বিলাল আটকের দিন থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতে জোর তৎপরতা চালান লিয়াকত আলী। থানায় লিয়াকতের তদবিরের বিষয়টি নিয়ে সেসময় দৈনিক জালালাবাদ পত্রিকায় একটি খবরও প্রকাশিত হয়।
এব্যাপারে নিহত আবদুল আলীর ছোটভাই আবদুল হক বলেন, আবদুল আলী হত্যার মুল পরিকল্পনাকারী পাথর শামীম, লিয়াকত আলীসহ আওয়ামীলীগের বেশ কয়েকজন নেতা। এদেরকে অবৈধভাবে চাদা না দেয়ায় তারা আবদুল আলীকে হত্যা করিয়েছে। কিন্তু বার বার পুলিশকে বলার পরও রহস্যজনক কারণে এদের ধরছে না।
গোয়েন্দা সুত্রে জানা যায়, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপর সীমান্ত এর চোরাচালান কারবারিদেরও গডফাদার লিয়াকত। এলচির মাধ্যমে পাথর, চুনাপাথর এবং কয়লা আমদানি করে থাকে ব্যবসায়ীরা। এই এলচির মালা আনলোড করার পর চালকদের হাত সোনা ভারতে পাচার করে লিয়াকত। আর ভারত থেকে নিয়ে আসা হয় দামি মদ ও ফেনসিডিল। এগুলো আবার সে ঢাকায় অভিজাত হোটেলে নিয়ে বিক্রি করে থাকে।
কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপর এই তিন থানার ওসিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসিক মাসোহারা এমপির নাম ভাঙ্গিয়ে নিয়ে থাকে লিয়াকত। এর ব্যথয় ঘটলে ওসিকে বদলি করে টাকার বিনিময়ে নতুন ওসি নিয়ে আসেন তিনি। গোয়াইনঘাট থানার সাবেক ওসি শফিকুর রহমান খান (বর্তমানে জকিগঞ্জ থানায়) ইউনুছ মিয়া (বর্তমানে ডিবি জেলায়) গোয়াইনঘাটে ওসির দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে তাঁর অন্যায় আবদার না রাখায় তাদের বদলি করিয়ে নতুন ওসি আবদুল হাইকে নিয়ে আসেন লিয়াকত।
সর্বশেষ সম্প্রতি গোয়াইনঘাটের ইউএনও আজিজুল ইসলাম স্টোন ক্রাশার মিল উচ্ছেদে অভিযানে গেলে তার গাড়িতে হামলা করে একটি চক্র। পরে এঘটনায় থানায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হামলাকারিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলে বর্তমানে ওসি আবদুল হাই লিয়াকতের মাধ্যমে দফারফা করার কারণে আসামিদের গ্রেফতার করছেন না। এই মামলাকে কেন্দ্র করে লিয়াকত কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে। ওই মামলায় গ্রেফতার টেকাতে আসামীদের নিকট থেকে জনপ্রতি ৫০হাজার টাকা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় সে। এই টাকার ভাগবাটোয়ারা এমপির শ্রীপুরের বাংলোয় বসে ওসি ও লিয়াকত ভাগ বাটোয়ারা করে নেয় বলে সুত্রটি নিশ্চিত করেছে।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে লিয়াকত আলীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, একটি চক্র আমার সম্মান হানি করার জন্য এসব রটাচ্ছে। তবে তিনি টেসকো নামের একটি কোম্পানীর কাছে খাসিয়াদের জমি বিক্রি করে কিছু টাকা আয় করেছেন দালালির মাধ্যমে সে কথা স্বীকার করে বলেন, সাবেক এমপি আবু তাহেরের ছেলে সুমন আমার বন্ধু মানুষ। সে টেসকো কোম্পানীর জন্য মোকামপুঞ্জিতে জমি পছন্দ করে। পরে আমি ক্রেতা ও বিক্রেতাকে দিয়ে জমিটি বিক্রি করিয়ে দিয়ে শতক প্রতি ৩০ হাজার টাকা করে পাই।

আরও পড়ূনঃ