ঘুরে আসুন সিলেটের রাজাকুঞ্জে হাছন রাজা যাদুঘর

Hason Rajaএম. শহিদুজ্জামান চৌধুরীঃ অঢেল ধন সম্পদ জমিদারীর মালিক থাকা সত্ত্বে ও যে কয়েকজন লেখক সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রেমে বিভোর হয়ে নিরলস সাহিত্য সংস্কৃতির সাধনা করে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী তাদের মধ্যে অন্যতম সাধক কবি ব্যক্তিত্ব । কবিগুরু রবি ঠাকুরের পরেই যার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর স্বয়ং রবি ঠাকুরই যার আধ্যাতিœক কাব্যের উপমা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার জন্য অসংখ্য কবি সাহিত্যিক বিভিন্ন উপাধি প্রাপ্ত হয়ে গৌরবান্নিত হয়েছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী সেই সৌভাগ্য বান এক স্বার্থক কবি ব্যক্তিত্ব যার নামের পূর্বে তাৎপর্য পূর্ণ মরমী কবি উপাধি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

একদিন তর হইবেরে মরণ রে হাছন রাজা,
মাটির ও পিঞ্জিরার মধ্যে বন্দি হইয়ারে কান্দে হাছন রাজা,
বাউলা কে বানাইলরে হাছন রাজা রে ,
লোকে বলে বলেরে ঘর বাড়ী বালা না আমার,
হাছন রাজায় কয় আমি কিছূ নয় রে আমি কিছূ নয়,
আমি না লইলাম আল্লাজির নামরে,
আমি যাইমু ও যাইমু আল্লাহর সঙ্গে,

এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় কালজয়ী শ্রোতাপ্রিয় মরমী গানের অমর রচয়িতা এমরমী সাধক কবি ১৮৫৪ সাল মোতাবেক ৭পৌষ ১২৬১ বাংলায় সুনামগঞ্জ জেলার লক্ষণ শ্রীর তেঘরিয়ায় সুনামখ্যাত এক প্রভাবশালী জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি জমিদার দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ও বেগম হুরমত জাহানের ২য় পুত্র। মরমী ও লোক গানের সম্রাট অমর এ কীর্তিমান সাধক কবি ১৯২২ সাল মোতাবেক ২২ অগ্রহায়ণ ১৩২৯ বাংলায় ৬৮ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে স্বীয় জননীর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুর কয়েক যুগ পেরিয়ে যাওয়ার পর সিলেটের জল্লারপাড় রোডের রাজা কুঞ্জে তাহার বিশিষ্ট শুভার্থী কর্তৃক প্রতিষ্টা করা হয় মিউজিয়াম অব রাজাস, বা রাজা দের যাদুঘর। প্রতিষ্টা কাল থেকে উক্ত যাদুঘরে হাছন প্রেমী, দর্শনর্থীদের ভীড় লক্ষণীয় এবং দিন দিন সেই দর্শনার্থীদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। প্রিয় পাঠক, ছুটির ফাঁকে কিংবা ছূটি নিয়ে আপনি ও ঘূরে আসুন উক্ত যাদুঘর। অনাবিল আনন্দ পাবেন প্রফুল্লিত হবে মন প্রাণ। ক্ষণিকের জন্য হলে ও হারিয়ে যাবেন অন্য এক জগতে। উপলব্ধি করতে পারবেন মরমী কবি হাছন রাজাকে। যাদুঘরে প্রবেশ এর নিয়ম, দেওয়ান তালেবুর রাজা ট্রাস্টের পাঁচ টাকার একটি টিকেট কেটে যাদুঘরে প্রবেশ করতে হবে। একটি টিকেট একজনের জন্য প্রযোজ্য। যাদুঘরের বাইরে ফটো তুলতে পারবেন। ভিতরে ব্যক্তিগত ফটো তোলা নিষেধ, তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে পত্রিকা ম্যাগাজিন বা পুস্তকের জন্য ছবি তুলতে পারবেন। যাদুঘরে ঐতিহ্যের ধারক রূপে সংরক্ষিত রয়েছে, দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরীর পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরীর বাড়ির মাটি, হাছন রাজার পিতৃক বাড়ির দালানের ইট, হাছন রাজার ব্যবহৃত সিন্দুক, ইস্ত্রি মেশিন, হ্যারিকেন, হাছন রাজার ঘোড়ার লাগাম, ঘোড়ার পায়ের নাল, হাছন রাজার পায়ের খড়ম, হাছন রাজার মুল গানের পান্ডুলিপি, হাছন রাজার সময়কার ঐতিহাসিক বৃটিশ মুদ্রা, হাছন রাজার ছবি সংবলিত বাংলাদেশ ডাক বিভাগের প্রকাশিত ডাক টিকেট, উদ্বোধনী খাম, তলোয়ার, হাছন রাজার ব্যবহৃত লাঠির ছবি, ৯টি হাতি ও ৮০ টি কোড়া পাখির নামের তালিকা, হাছন রাজার ব্যবহৃত তৈজসপত্র, ব্যবহৃত মুদ্রা। আরো রয়েছে দেওয়ান হাছন রাজার স্ত্রী বেগম সাজেদা বানু(পিয়ারী বিবির) ব্যবহৃত তৈজসপত্র, পুত্রবধু মেহেরজান বানুর ব্যবহৃত স্বর্ণ ও রৌপ্যের জরি দিয়ে তৈরী পোষাক, বেগম তালেবুর রাজার ব্যবহৃত রুপার জরি দিয়ে তৈরী শাড়ী, দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরীর ব্যবহৃত হিসাবের খাতা, তৎকালীন ভাড়া আদায়ের রশীদ, দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরীর পুত্র দেওয়ান তালেবুর রাজাকে দেওয়া তাঁর চিঠি। ১৯২৯ খ্রিঃ দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরীকে বৃটিশ কর্তৃক প্রদত্ত খেতাব খাঁন বাহাদুর মেডেল, বর্তমানে “এন্টিক ক্রিমিনালদের দ্বারা চুরি হয়ে গেছে”। দেওয়ান তালেবুর রাজা চৌধুরীর ব্যবহৃত দোয়াত কলম, হাতের আংটি, রেডিও, ও ১৯৪১ সালের গাড়ি লাইসেন্স, তৎকালীন বিভিন্ন মন্ত্রীর দেওয়া চিঠিপত্র, মেহের জান বানুর কোরআন পড়ার রাওয়াল। চিত্রনায়ক হেলাল খাঁন পরিচালিত হাছন রাজা চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত পোষাক, দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী ওদেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরীকে নিয়ে বিভিন্ন লেখকের লেখা ৩২টি বই এর কপি, সিলেট বিভাগ এর ৩৪০ জন মরমী কবির নামের তালিকা, বাউল সম্রাট রাধারমন দত্ত ও দুর্বিন শাহ এর দু®প্রাপ্র্য ছবি। হাছন রাজার গান গেয়ে খ্যাতির শিখরে পৌছে যাওয়া শিল্পী উজির মিয়া, শফিকুনুর, আঃ লতিফ, র্নিমলেন্দু চৌধূরী (ভারত), বিদিত লাল দাশ, হিমাংশু বিশ্বাস, সেলিম চৌধুরী সহ অসংখ্য শিল্পীর ছবি সহ নামের তালিকা। দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরীর বৈমাত্রেয় বড় ভাই ওবায়দুর রাজা চৌধুরীর ছবি, রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম ক্ষুদ্রাকৃতির পবিত্র কোরআন শরীফের একটি কপি। রয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাদ্যযন্ত্র । রয়েছে ডিআর কঙ্গো, আফ্রিকান একটি গিটার সহ বিভিন্ন দেশের বাদ্যযন্ত্র। রয়েছে দেওয়ান হাছন রাজার বৈমাত্রেয় বোন সিলেটের প্রথম মুসলিম মহিলা কবি সহিদা খাতুন এর কাব্য গ্রন্ত। যাদুঘরটি পরিচালনা করছেন দেওয়ান তালেবুর রাজা ট্রাস্ট।

লেখক : সম্পাদক, মাসিক কবি ও কবিতা
মোবাইল নং- ০১৭১৪৪২৯২২২