মালয়েশিয়ার সঙ্গে ৪ চুক্তি, ভিসা ছাড়াই সফর

pm hasinaসুরমা টাইমস ডেস্কঃ জনশক্তি রপ্তানি, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা, পর্যটন খাতে সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে চারটি চুক্তি করেছে বাংলাদেশ।
বুধবার পুত্রাজায়ায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রীরা এসব চুক্তিতে সই করেন।
চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারি কর্মকর্তা কূনীতিকরা ভিসা ছাড়াই উভয় দেশ সফর করতে পারবেন।এছাড়া দ্বিপাক্ষিক ও বাণিজ্যিক বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের প্রস্তুতিমূলক কাজের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের পরবর্তী প্রবৃদ্ধির অংশীদার হতে মালয়েশিয়ান বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আপনাদের সকলকে আমি বাংলাদেশে যাওয়ার উষ্ণ আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনারা গিয়ে প্রকৃত বাংলাদেশ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করুন। বাংলাদেশের পরবর্তী প্রবৃদ্ধির বিকাশে নিজেদের অংশীদার করুন।’
কুয়ালালামপুরে গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে বুধবার ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের সুযোগ বিষয়ক সংলাপ’ অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে এ আহবান জানান তিনি।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, মালয়েশিয়ার ব্যবসায়ীরা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশকে বিনিয়োগের প্রকৃত প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পুনরায় বিবেচনা করবে।
তিনি বলেন, কয়েক দশক ধরে আজকের আধুনিক মালয়েশিয়া গড়তে আপনাদের অনেকেই অবদান রেখেছেন। আমি বিশ্বাস করি একই সুযোগের হাতছানি বাংলাদেশেও রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সীমাবদ্ধতা ও নিম্নপর্যায়ের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিনিয়োগের যে সুযোগ ও প্রণোদনা দিচ্ছে তা আপনাদের সদয় বিবেচনার দাবি রাখে।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন মালয়েশিয়ার সাউথ সাউথ এসোসিয়েশন (এমএএসএসএ) এর প্রেসিডেন্ট আজমান হাশিম এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার একেএম আতিকুর রহমান।
এছাড়া অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়া সরকারের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত এস সামি ভেল্লু, মালয়েশিয়ান স্ট্যান্ডার্ড এন্ড এক্রিডিটেশন কাউন্সিল ডাটুকের চেয়ারম্যান মুস্তাফা মনসুর, এমরেইল এসডিএন বিএইচডির নির্বাহী পরিচালক ড. অরবিন্দ হরি নারায়ণ, এক্সিস জাভা গ্রুপের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর বেন্নি হো এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ার শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগ প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিলেন।
ফেডারেশন অফ চেম্বার্স অফ কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজ অফ বাংলাদেশের সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলও ওই সংলাপ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়।
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বে ১৯৯১ সালে গঠিত মালয়েশিয়া সাউথ সাউথ এসোসিয়েশন (এমএএসএসএ) দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সরকারগুলোর সাথে বিস্তৃত বাণিজ্য নেটওয়ার্ক স্থাপনে কাজ করে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, তিনি ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক আরো প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করেছেন।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও যোগাযোগ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার এসব চ্যালেঞ্জকে সুযোগে রূপান্তরিত করতে পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতোমধ্যেই বড় অঙ্কের এফডিআই রয়েছে এবং দেশের বৃহত্তর চাহিদা মেটাতে মালয়েশিয়া থেকে মানসম্পন্ন বিনিয়োগকে স্বাগত জানাতেও প্রস্তত রয়েছে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের অনুকুল পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা জানি। ফলে ১৮টি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন তৈরির প্রক্রিয়া চলছে।
এ প্রেক্ষাপটে তিনি উল্লেখ করেন, সরকার বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য জটিল লজিস্টিক সুবিধা দ্রুততার সাথে সহজ করা এবং সুযোগ সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আরো বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে আমরা আমাদের বৈধ কাঠামোসমূহকে আরো সহজ করার বিষয়টিও খতিয়ে দেখছি।
শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন শিথিল ও বিদেশী নাগরিকদের জন্য ওয়ার্ক পারমিট প্রদান সহজীকরণকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, আমি মনে করি সড়ক, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পর্যটন ও সেবা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পানি সরবরাহের মতো অবকাঠামো খাতগুলো আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করবে। একইভাবে খাদ্য ও কৃষিখাতের পুরোটাই হবে উৎসাহব্যঞ্জক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বসহ (পিপিপি) যে কোনও ধরনের অংশীদারিত্বের বিষয় বিবেচনা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন দক্ষ, দ্রুত-প্রশিক্ষণক্ষম ও যুব কর্মশক্তি, উদার ও প্রতিযোগিতামূলক আর্থিক পরিবেশ ও প্রণোদনা প্যাকেজসহ নতুন যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই সুবিধার দ্বারোদঘাটনে প্রস্তুত রয়েছে।
তিনি বিভিন্ন সমীক্ষার কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও এর বাইরেও গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন, বিতরণ ও সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সংকট মোকাবেলায় সক্ষম সম্প্রসারিত যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবর্তিত উৎপাদন পদ্ধতি, শিল্প কেন্দ্রীভবন ও মূল্য ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের যোগাযোগ মাধ্যম বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া এবং আরো পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এক্ষেত্রে সার্ক, বিমসটেক ও বিসিআইএন-এর মাধ্যমে আমাদের অগ্রসরমান অর্থনৈতিক সংহতি গড়ে উঠছে।
প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার ভিশনের কথা উল্লেখ করে বলেন, তাঁর সরকারের সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডের লক্ষ্য হচ্ছে সকলের জন্য কল্যাণ, ন্যায় বিচার এবং মানবিক মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা।
তিনি বলেন, আমাদের সমাজ হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক, বহুমাত্রিক ও সমজাতিক। আমরা উৎপাদনকে দায়িত্ব ও কর্ম হিসেবে গণ্য করি; যা অন্যের জীবন ও জীবনযাত্রাকে ব্যহত না করে বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রত্যাশিত মুনাফা ও শ্রমিকদের কল্যাণ বয়ে আনে। সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনীতি পাশাপাশিই এগিয়ে যায় এবং দীর্ঘ মেয়াদে যা সুফল বয়ে আনে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, গত ছয় বছরে তাঁর দেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমানে জিডিপি’র পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ১শ’ ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনীতির দেশ। আইএমএফ বাংলাদেশকে ২০১৩ সালে পিপিপি’র হিসেবে বিশ্বের মধ্যে ৩৭তম এবং সাধারণ জিডিপি’র হিসেবে ৩৬তম দেশ হিসাবে স্থান দিয়েছে। বিগত এক দশক থেকে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহতভাবে ৬ শতাংশের ওপর অর্জিত হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের সঞ্চয় ও প্রবৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির (সেভিং- জিডিপি ও ইনভেস্টমেন্ট- জিডিপি) হার দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। আমাদের সার্বিক মানব উন্নয়ন সূচক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে অনেক দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অনেক পশ্চিমা বন্ধুর হিসেবে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিনিয়োগের মুনাফা দেশটির নিজস্ব অর্থনীতির চেয়ে অনেক বেশি।
পরে প্রধানমন্ত্রী বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহের বর্তমান অবস্থা, কর ব্যবস্থা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে মালয়েশীয় ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
এসময় মালয়েশীয় ব্যবসায়ীরা আবাসন, নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ খাতে তাদের আগ্রহ ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে উত্তোলন ও আমদানির মাধ্যমে পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রস্তাবিত এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ সম্পন্ন এবং প্রতিবেশী মায়ানমার থেকে গ্যাস আমদানির সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে গ্যাস সংকটের সমাধান হবে।
বিনট্যাঙ্ক জেভি কনসোর্টিয়ামের চেয়ারম্যান ড. এম সুয়িব কাশমানের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকার চারদিকে রেল সার্কুলার লাইন নির্মাণে তার (কাশমানের) প্রস্তাবকে সরকার স্বাগত জানতে প্রস্তুত রয়েছে।