কুলাউড়ায় মাছুম আত্মহত্যার নৈপথ্যে !

Masumএম.এ. কাইয়ুমঃ ধৈর্যের সীমা হারিয়ে মানুষ যখন দেওলিয়া হয়ে যায়। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি হিসাব কষতে গিয়ে যখন ভেঙ্গে পড়ে, পৃথিবীর কাছে তখন সে নিতান্তই অসহায় ভাবে ঠিক তখনই বেছে নেয় আত্মহত্যার মত কঠিন ও জঘন্যতম কাজ। সাম্প্রাতিক সময়ে কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়েই চলছে। গত ২৪ অক্টোবর শুক্রবার কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের কানিকিয়ারী গ্রামের মাছুম আহমদ (১৫) নামের যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে তা হৃদয়ে স্পর্ষী। কুলাউড়ার অঞ্চলের সাম্প্রতিক যে কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে মাছুমের আত্মহত্যাটি নজর কেড়েছে গোটা দেশের। আত্মহত্যার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে তার নিজ হাতের লেখা চিরকুট, মোবাইলের এসএমএস ফেইসবুক স্ট্যাটাসে নিস্তেজ অক্ষরগুলো সে অপরাধী করে গেছে প্রেম, পরিবার তথা পৃথিবীকে। প্রেম গঠিত জটিলতা তার আত্মহত্যার মূল কারণ। প্রতি মুহুর্তে বন্ধুদের আড্ডার শিরোমনি ছিল মাছুম। সারাদিন হই-হুল্লুড় আর দুরন্তপনা আবেগী স্বভাবের অন্য ১০টি ছেলের মত সেও ছিল সমরে সঙ্গী। হয়তো তার জীবনের স্বাদটুকু অল্প বয়সে বেশি উপলব্দি করতে ছেয়েছিল। পড়াশুনায় বরাবরেরমত সে ছিল প্রখর মেধার অধিকারী। স্বজন/বন্ধুদের কাছে সবসময়ের হাঁসি মাখা মুখখানি আজ লুকিয়ে গেছে চিরতরে। মাছুম আত্মহত্যার আগে যে হাজার-হাজার, তিলে-তিলে, কষ্ঠের অনলে মৃত্যু হয়েছে হৃদয় নামক স্বর্গের তার স্বতঃস্ফূর্ত স্বাক্ষী নিজ হাতে লেখা চিরকুট, ফেইসবুকের প্রতিটি স্ট্যাটাস মোবাইল ফোনের এসএমএস আর এগুলোর মাধ্যমেই বের হয়ে আসে তার আত্মহত্যার ভয়ানক রহস্য। কষ্টকে ঢেকে রেখে প্রতিনিয়ত সে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল এই স্বর্গের মোহে। কিন্তু যখন সে জানতে পারল যাকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখত অবিরাম সেই মেয়েটি তাকে প্রতারনার ফাঁদে আটকে দিলে মেহেদিরাঙ্গা হাতে আক্দ সম্পন্ন হয়েছে রাহুল নামের ছেলেটির সাথে। আত্মহত্যার পূর্ব মুহুর্তে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস লিখে ‘জীবনটা আসলে অনেক কঠিনরে মামা……/সবাই ধোঁকাবাজ, আপন বলেন আর পর বলেন।’ সেখানে স্পষ্ট প্রকাশ পায় তার অসহায়ত্ব। একজন কিশোর যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হতে থাকে তখন তার মাঝে প্রকাশ পায় কিছু ব্যতিক্রমী স্বভাব, সে ভাবতে থাকে এলোমেলো। আধুনিকতার এই সমাজে সেও পাশের গ্রামের স্কুল পড়–য়া একটি মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তার ব্যবহৃত মুঠোফোন ও নিজ হাতে লেখা চিরকুট তলিয়ে পাওয়া যায় তার কিছু নিজস্ব অস্তিত্ব ঐ মেয়েটিকে নিয়ে তার এলোমেলো স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করে। নিয়মিত ফোন আলাপ, লিপকিস টুগেদার, এসএমএস, দেখা সাক্ষাত সহ তাদের সম্পর্কটা রূপ নেয় একটা ভিন্ন মাত্রায়। কিন্তু মাছুমকে দু-এক মাস থেকে কারনে-অকারণে ভুল বুঝতে শুরু করে ঐ মেয়েটি। এরই মধ্যে মেয়ের পরিবার সেই ছেলেটির সাথে বিয়ের সম্পূর্ন প্রস্তুতি নেয় মাছুমের অজান্তে। মেয়েটির হাতে মেহেদী প্রসঙ্গ জানতে চাইলে সে জানায় আমার বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক। বিয়ের সত্যতা জানতে চাইলে ফিরতি এসএমএসে মাছুমকে আক্দয়ের দাওয়াত দেওয়া হয়। মাছুম আশাহত না হয়ে অনেক চেষ্টার পর মেয়েটির সাথে যোগাযোগ করে উভয়ের মতামতের ভিত্তিতে ২৩ অক্টোবর পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সন্ধ্যার পর যথাস্থানে মাছুম ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করলেও মেয়েটি না এসে মুঠোফোন বন্ধ করে রাখে। তখন থেকেই মাছুমের চালচলনের অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হয়। সে দিন রাতে নিজহাতে ছুরি দিয়ে আঘাত করে মাছুম যার ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হয় পরিবারের কাছে। মাছুমের বাবা মুক্তার আলী জানান তার হাতের ছুরিকাঘাত সম্পর্কে জানতে চাইলে সে বারবার বিষয়টি এড়িয়ে যায়। পরদিন ২৪ অক্টোবর দুপুরে মেয়েটির ফোন থেকে একটি উসকানিমূলক এসএমএস মাছুমকে পাঠায়। ফিরতি এসএমএস মাছুম জানায় “প্লিজ এসব বন্ধ কর, বন্ধ না করলে আজ বিকেল ৩টায় আগেই আমার লাশ পাবে।” মেয়ের পক্ষ থেকে ফিরতি এসএমএস না আসায় শেষ বারের মত মেয়েটিকে জানায় “ওকে, ভাল থেকো আমি চলে গেলাম। জীবনে যদি তোমার ভালবাসা না পাই তবে বেঁচে থেকে লাভ কি? আর এসএমএস করোনা/লাভ হবেনা কারণ এখনই আমি ফাঁসিতে ঝুলবো/বাই/নিজের দিকে খেয়াল রেখো” এরপরও কোন ফিরতি এসএমএস না আসায় সে নিরুপায় হয়ে যায়। মাছুম ফেইসবুকের শেষ যে স্ট্যাটাস দেয় সেটি ছিল আরো হৃদয় বিদারক। সে লিখে: আমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি/ আর কোনদিন এ প্রোফাইল থেকে কোন স্ট্যাটাস দেওয়া হবে না/ গুড বাই সবাইকে………….।
সে স্ট্যাটাসটি দেখে তার বন্ধু মহল তাৎক্ষনিক ভাবে তার পরিবারকে নিশ্চিত করলে অনেক খোঁজাখুজির পর মাছুমকে এক পর্যায়ে পাওয়া যায় বাড়ির বাগানের একটি গাছের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায়। সাথে সাথে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন। এভাবেই অল্প বয়সেই প্রেম ঘটনায় প্রতারনার স্বীকার হয়ে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে শোকের সাগরে ৫.৮ ফুট উচ্চতার একটি ফুটফুটে কিশোর চলে যায় পৃথিবী থেকে। উল্লেখ্য যে, অন্যদিকে ভালবাসার প্রতিদানে মেয়েটি যখন যা চেয়েছে তা সময়মত দিত মাছুম। এমনকি দামিদামি কিছু উপহার দিতে গিয়ে সে তার বন্ধুদের কাছে ঋণীও হয়। টাকা পরিশোধের ব্যাপারে বন্ধুরা তাকে চাপ দিলে সার্বিক বিষয়ে বাবার কাছে টাকা চাইলে তার বাবা টাকা দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। এতে করে সে মানসিক ভাবে খুবই ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

মাছুমের মায়ের নাজুক অবস্থা:
মাছুমের আত্মহত্যার পরপরই তার মায়ের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। শারিরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে তিনি মুমূর্ষু অবস্থায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক দ্বারা তার মাকে দফায় দফায় চিকিৎসা করা হলেও দিন দিন অবস্থার অবনতি ঘটছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় মাছুমের ব্যবহৃত শাটং, পেন্ট গায়ে পেঁচিয়ে এদিক সেদিক পাগলপ্রায় হয়ে ঘুরছেন। একইভাবে তাদের পরিবারের সবাই মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ।
মাছুমের লেখা চিরকুট

আমি অনেক অন্যায় করেছি। তবে সৃষ্টিকর্তা ছাড়া এগুলো বর্ণনা কেউ দিতে পারবে না। আজ আমি খুব অসহায়, না পারছি কাউকে বলতে, না পারছি সইতে। তাই এই দু:খ ভরা মন নিয়ে নিজে নিজে ঠিক করেছি যে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আমার কোন ইচ্ছে নেই। সারাটা জীবন অপদার্থ থেকেই গেলাম আজ পর্যন্ত। বাবা মায়ের মুখে হাঁসি ফোঁটাতে পারলাম না। পড়ালেখার মধ্যে মনোযোগ ছিল, এখন আর তা নেই আমি কাউকে এই পৃথিবীতে দোষারূপ করবো না, সব দোষ আমার নিজের। আমার বড় ভাই যখন বিদেশ থেকে চলে আসেন; তখন হয়তো আমার থেকে বেশি কষ্ট পেতে হয়েছে। খুব কষ্ট লেগেছিল তখন দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না। আমার ছোট ভাইটার জন্য দু:খ হচ্ছে। হয়তো আমি মরে গেলে। সে ছোট দাদা ডাকার জন্য কাউকে পাবে না। আল্লাহ্ তাকে যেন ভালো রাখেন ভাইরে আমার জন্য কাদিস না। পরকালে তর সাথে দেখা হবে। আমার ছোট ভাইটার জন্য বিষন কান্না পাচ্ছে। হয়তো আমার ভাইটা একা হয়ে যাবে। বড় ভাইও একা হয়ে যাবে। ভাই যদি কখনও আমার কথা মনে পড়ে তাহলে “কফি হাউজের সেই আড্ডাটা” এই গান প্রতিদিন শুনবে। কারন এটাতে আমাকে খুঁজে পাবে। আর আমার প্রিয় বাবা-মাকে বলছি দু:খ করনা। সন্তানদের একটু স্বাধীনতা দিও। যাতে আমার মত মরতে না হয় এমন শাসন করিও না, যে আমার মত না হতে হয়। আমার বন্ধুদের খুব মিস করছি। (সাকিব, রাকিব, তুহিন, সুজন, সিপন, শাহাব উদ্দিন ও আরো অনেকে) দুস্তরা রাগ করিস না তোদের ছেড়ে চলে গেলাম তবে আশা রাখিস পরকালে তোদের সাথে দেখা হবে। আমি আর কারো বুঝা হয়ে থাকতে চাই না। দুস্তরা আমার কথা মনে হলে সেই গানটা শুনিস। তোরা ছিলি, তোরা আছিস, তোরাই থাকবে বন্ধু………………….
আমার আপুটার কথা খুব মনে হচ্ছে। আর আমার দুটো ভাগনা (সামি, সানি) কে খুব মিস করছি আপুগো আমার জন্য কাদিস না তর কান্না আমি সহ্য করতে পারি না, কিছু করার নেই আমার কথা মনে হলে নিরবে আমাকে ডাকিস তাহলে আমাকে পাবে। প্রিয় মা-বাবা তোমাদের একটা কথা বলা হয়নি আমি একজনকে ভালবাসি তার নাম “জান্নাতুল কানন (অনিকা)”। সে আমাকে কতটা ভালোবাসে তা আমি জানিনা কিন্তু আমি তাকে খুব ভালবাসি। তার সাথে এখানেতো আর মিল হল না, পরকালে দেখা হবে; মিল হবে।
ওকে, সবাই ভালো থাকবেন।

Good Bye
২২/১০/২০১৪ইং
মাসুম আহমদ