সুবিচার না পেয়ে বন্যার আত্মহত্যা

bonnaসুরমা টাইমস ডেস্কঃ স্কুলে যাওয়া-আসার পথে মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করত, কলেজে ভর্তি হওয়ার পর এর মাত্রা আরো বেড়ে যায়। প্রভাবশালীদের কাছে বিচার দিয়েও সমাধান মেলেনি। শেষে বখাটে ছেলেটির সঙ্গে প্রেমের অভিনয় শুরু করে মেয়েটি।
কারণ, পড়াশোনা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতে চাইনি। তার স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু একপর্যায়ে বিয়ের লোভ দেখিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে ওই বখাটে। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে মেয়েটি বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে।
কিন্তু ছেলেটি ঘটনাটিকে অস্বীকার করে, উল্টো তার পক্ষে সালিস বসায়। সালিসে উপস্থিত প্রভাবশালীরা ‘রায়’ দেয়, ছেলেটি ভুল করে এ কাজ করেছে। শাস্তি স্বরুপ মেয়েটি ও তার পরিবারের কাছে তাকে ক্ষমা চাইতে হবে।
প্রহসনমূলক এ ‘বিচার’ মানতে পারেনি মেয়েটি, অভিমানে কীটনাশক ঢেলে দেয় গলায়। টানা আট দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে অবশেষে গত বৃহস্পতিবার হার মানে সে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।
মেয়েটির নাম কাকলী আক্তার বন্যা (১৭)। মাওনা পিয়ার আলী ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল সে। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের বেতঝুরি মজিদ মোক্তারেরচালা গ্রামে তার বাড়ি, বাবার নাম আবদুল কাইয়ুম।
বখাটে ছেলেটির নাম শফিকুল ইসলাম (২৬)। একই গ্রামের মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে সে। প্রতিবেশীরা জানায়, ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে সে। বছরখানেক ধরে মাওনা ইয়াকুব আলী টাওয়ারের দোতলায় মোশারফ হোসেন বাবুলের জুতার দোকানে কর্মচারীর কাজ করছিল সে। কিন্তু বখাটেপনা ছাড়েনি।
শফিকুলের বিরুদ্ধে গ্রামের আরো মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। বন্যার মৃত্যুর পর বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে সে ও তার পরিবারের সদস্যরা।
শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢামেক হাসপাতাল থেকে বন্যার মৃতদেহ বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় শিক্ষক-সহপাঠীসহ অসংখ্য মানুষ তার বাড়িতে ভিড় জমায়। তারা এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করে। রাতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বন্যার মরদেহ দাফন করা হয়।
গ্রামবাসী জানায়, বখাটে শফিকুল দীর্ঘদিন ধরেই বন্যার পেছনে লেগে ছিল। পাশের বারোতোপা আফসার উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে বন্যাকে হয়রানি করত সে। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে শফিকুলের যৌন হয়রানি কথা জানিয়ে প্রতিকার চেয়েছিল বন্যা ও তার মা-বাবা।
কিন্তু কোনো সমাধান না হলে হয়রানি থেকে বাঁচতে বন্যা একপর্যায়ে শফিকুলের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতে থাকে। কিন্তু একসময় শফিকুলের ফাঁদে পা দেয় সে।
গতকাল বন্যাদের বাড়িতে এসেছিল তার সহপাঠীরা। তারা জানায়, বখাটে শফিকুল পথে-ঘাটে যৌন হয়রানি করায় বন্যা নিরুপায় হয়ে তাকে ভালোবাসার অভিনয় করত। বিভিন্ন সময় বন্যাকে কলেজ থেকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যেত সে।
বন্যার চাচা কামরুল ইসলাম জানান, গত ৪ জুন সকালে বন্যা সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা করার কথা বলে বাইরে বের হয়। বিকেলে বাড়ি ফিরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর দেয়নি, সারা রাত শুধু কেঁদেছে।
বন্যার মা রাহিমা খাতুন জানান, পীড়াপীড়ির পর পরদিন সকালে বন্যা জানায়, সে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা, শফিকুল একাধিকবার তাকে ধর্ষণ করেছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শফিকুলের সঙ্গে দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করে সে।
কিন্তু বন্যাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায় শফিকুল। রাহিমা খাতুন জানান, বন্যার কাছে সব শুনে তিনি শফিকুলের চাচা জামাল উদ্দিনের কাছে যান। কিন্তু জামাল উদ্দিন তাঁকে তাড়িয়ে দেন।
বন্যার মামা শরিফুল ইসলাম জানান, শফিকুল বন্যাকে বলেছিল, গর্ভের অনাগত ‘পাপ’ ফেলে দিয়ে কলঙ্কমুক্ত হলে তাকে স্ত্রীর স্বীকৃতি দেবে সে। গর্ভপাত ঘটাতে গত ১১ জুন বন্যাকে ওষুধ কিনে এনে দেয় শফিকুল। তাতে কাজ না হওয়ায় ১৭ জুন ফের ওষুধ এনে দেয় শফিকুল। সেই ওষুধ খেয়ে গর্ভপাত ঘটে বন্যার।
বন্যার মা রাহিমা খাতুন জানান, গর্ভপাতের খবর পেয়ে বেঁকে বসে শফিকুল। সাফ জানিয়ে দেয়, বন্যাকে বিয়ে করতে পারবে না। তিনি ফের শফিকুলের চাচা জামাল উদ্দিনের কাছে যান। এবার তাঁকে ‘অসতীর মা’ বলে তাড়িয়ে দেন জামাল উদ্দিন। এরপর শফিকুলের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা।
এরই মধ্যে গত ২২ জুলাই সন্ধ্যায় পাশের ফুলানিরসিট গ্রামের চৌধুরী হাসান সোহেল শাকিল, শ্রীপুর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোশারফ হোসেন বাবুলের নেতৃত্বে গ্রামের প্রভাবশালী মাতব্বররা বন্যার বাড়িতে সালিশ বসায়। সালিশে উপস্থিত ছিলেন গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি দুলাল মিয়া, শামসুল মিয়া, আলী আকবর, শফিকুল ইসলামের চাচা জামাল উদ্দিন, চাচাতো ভাই আশরাফুল ইসলাম, তোতা মিয়া ও সিরাজুল ইসলামসহ ৩০ থেকে ৩৫ জন।
বন্যার বাবা আবদুল কাইয়ুম পেশায় কৃষক। তিনি জানান, তাঁরা আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, গ্রামের কোনো মাতব্বরের কাছে যাননি। কিন্তু শফিকুলের পক্ষ নিয়ে মাতব্বররা তাঁকে না জানিয়ে হঠাৎ সালিস বসান। সালিসে বন্যার ঘটনার বর্ণনা শুনে মাতব্বররা মত দেন, শফিকুল ‘’ভুল’ করেছে। ভুলের অপরাধে বন্যাসহ তাঁদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এ রায় শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে বন্যা।
ওই সময় শফিকুলের চাচা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, ‘গ্রামের ১০ জনের রায় না মানলে তোদের একঘরে করা হবে। দরকার হলে তোদের বাড়িঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে তোদের ভিটেছাড়া করব। রায় মেনে নেয়ার জন্য কয়েক দিনের সময় দিয়ে চলে যান মাতব্বররা।
বন্যার বাবা আরো জানান, মাঝে অসংখ্যবার প্রভাবশালীরা রায় মেনে নেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। নানা ভয়-ভীতি দেখায়। গত ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় তোতা মিয়ার বাড়িতে ফের সালিস ডাকেন মাতব্বররা।
সালিশে আবারও শফিকুলের পক্ষ নিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে বন্যা দৌড়ে বাড়ি চলে যায়। বাড়ি গিয়ে কীটনাশক পান করে সে। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে প্রথমে শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়, পরে উত্তরা ফরচুন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পাঁচ দিন পর অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মারা যায় সে। হাসপাতালে অঝোরে কেঁদেছে বন্যা, বড় হয়ে চিকিৎসক হতে চেয়েছিল।
শফিকুলের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বন্যার সেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। বারবার বলেছে, ‘আব্বা গো, আমি আর বাঁচব না। তোমরা ওই পশুটারে ছাইড়া দিও না। আমি ওই পশুটার অত্যাচারের অনেক কথাই কই নাই, তোমরা বুইঝা নিও। আমি মইরা গেলেও শফিকুলের যাতে ফাঁসি অয়।’
গতকাল সকালে শফিকুলের বাড়ি গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। ঘরে তালা ঝুলছিল। শফিকুল ইসলামের চাচা জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বন্যার মৃত্যুর খবর পেয়ে শফিকুল তার মা ও ভাই-বোনসহ পালিয়ে গেছে।’
সালিশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা গ্রামের গণমান্য ব্যক্তিরা বসে দেখেছিলাম শফিকুল অপরাধ করেছে। সে জন্য তাকে নির্যাতিত মেয়ে ও তার পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছিলাম। দুই পক্ষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি শেষ হলে যাতে তারা যেকোনো সময় বিয়ে করতে পারে- এ চিন্তা করে রায় দিয়েছিল সবাই।’ তবে বন্যার মা-বাবাকে হুমকি দেয়ার কথা অস্বীকার করেন তিনি।
সালিশে অংশ নেয়া তোতা মিয়া বলেন, ‘পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মোশারফ হোসেন বাবুল ও চৌধুরী হাসান সোহেল শাকিলের কথায় আমরা সালিসে যাই। তবে রায়ের ক্ষেত্রে আমাদের মত নেওয়া হয়নি। জঘন্যতম অপরাধের শুধু ক্ষমা চাওয়ার রায়টা ঠিক হয়নি।’
এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে চৌধুরী হাসান সোহেল শাকিল বলেন, ‘বন্যার বাবা আমার মাছের খামারের কর্মচারী। আমাকে বারবার বলায় সালিসে গিয়েছিলাম। ছেলেমেয়েকে সময় দিয়ে এসেছিলাম নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে নেয়ার। দ্বিতীয় দফা সালিসে আলোচনা শুরুর পরই মেয়েটি বিষ পান করে।’ ক্ষমা চাওয়ার রায় দেওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো রায় দেয়া হয়নি।
শ্রীপুর মডেল থানার ওসি মহসিন-উল কাদির বলেন, ঘটনা শুনেছি। শফিকুলকে ধরার জন্য অভিযান চলছে।