বিএনপির সঙ্গেই সংলাপে আসতে হবে : খালেদা
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ সংলাপ ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি প্রধানমন্ত্রী নাকচ করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শনিবার জামালপুরের সমাবেশে এই হুঁশিয়ারি দেন তিনি। তা না হলে ঈদের পর আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে সংলাপ চেয়ে এলেও সরকারের পক্ষ থেকে তা বরাবরই প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার নিউ ইয়র্কে প্রবাসীদের সঙ্গে এক মতিবিনিময় সভায় সংলাপ ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা নাকচ করে বলেন, “এমন কি সমস্যা হয়েছে যে মধ্যবর্তী নির্বাচন?…সংলাপটা আবার কী?”
আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর এই বক্তব্যের জবাবে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন,“আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন দিতে হবে। “তাই আলোচনায় বিএনপির সঙ্গেই বসতে হবে। কোনো কলা-কৌশল করে লাভ হবে না।”
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ভাঙনে সরকার গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন খালেদা। “এই সরকার বিএনপিকে ভয় পায়। তারা জোট ভাঙতে চায়। আলোচনায় বসতে চায় না। সরকারকে বলব, যদু-মধু দিয়ে কোনো কাজ হবে না। বিএনপির সঙ্গেই আলোচনায় বসতে হবে।”
নির্দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি সরকারকে মানতে বাধ্য করতে ঈদের পর আন্দোলনের কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়ার আগে সমাবেশের সম্মতি চান তিনি। “আপনারা কি এই গণবিচ্ছিন্ন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চান” – তার এই প্রশ্নে সমাবেশে উপস্থিত ২০ দলের নেতা, কর্মী সমর্থকরা সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ বলেন। “ঈদের শেষে ইনশাল্লাহ আন্দোলন হবে। ঢাকায় গিয়ে কর্মসূচি দেব। এই অবৈধ খুনি হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করে দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করব,” বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। রোজার ঈদের আগে খালেদা ঈদের পর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এবার কোরবানির ঈদের পর কর্মসূচির ঘোষণা দিলেন।
‘অবৈধ সরকারের আইনও অবৈধ’
৫০ মিনিটের বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসন সরকারের ‘দুর্নীতি’, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সংবিধান সংশোধন, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের ৯৫ ভাগ মানুষ ভোট দেয়নি দাবি করে খালেদা বলেন, “এই সংসদে জনপ্রতিনিধি নেই। তারা অবৈধ। এই সরকারও অবৈধ। তাই এই সংসদে যত আইনই করা হোক না কেন, তা অবৈধ।”
ভোটে না গিয়ে বিএনপি ভুল করেনি দাবি করে তিনি বলেন, “সারাদেশে ভোট হয়নি। আমরা প্রমাণ করেছি, দেশের মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার জন্য একদিন আপনাদের কাফফারা দিতে হবে।”
দল ভাঙার ‘চক্রান্তে’ গোয়েন্দা সংস্থা
বিএনপি জোটকে ভাঙার জন্য সরকারের ইঙ্গিতে গোয়েন্দা সংস্থা তৎপরতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন খালেদা। তিনি বলেন, “আজ গোয়েন্দা দিয়ে দল ভাঙার চক্রান্ত হচ্ছে। আমিও সরকারের ছিলাম, কিন্তু এসব কাজে কখনো গোয়েন্দাদের ব্যবহার করিনি। “আমি সব এজেন্সির নাম জানি। নাম বলতে চাই না। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বলব,আপনারা এসব কাজ বন্ধ করুন। তা না হলে একদিন আপনাদের আইনের আওতায় জবাবদিহি করতে হবে।”
মির্জা আজমও ‘জঙ্গি’
জামালপুরের এই জনসভায় এই জেলার আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজমের সঙ্গে জেএমবি নেতা শায়খ আব্দুর রহমানের আত্মীয়তার সম্পর্ক তুলে ধরেন বিএনপি চেয়ারপারসন। “বিএনপি জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে না। ইসলামও জঙ্গিদের সমর্থন করে না। আমাদের সরকারের আমলে জঙ্গি দমন হয়েছে। শায়খ আবদুর রহমান কে ছিলেন? মির্জা আজমের দুলাভাই। তাহলে মির্জা আজমও তো জঙ্গি।”
“জঙ্গিদের সঙ্গে আওয়ামী লীগেরই সম্পর্ক। বিএনপি অতীতে জঙ্গি দমন করেছে, আগামীকে ক্ষমতায় গেলে এই কাজ করবে।”
‘ষোড়শ সংশোধন মানি না’
সদ্য সংসদে পাস হওয়া ষোড়শ সংশোধন বাতিলের দাবি জানিয়ে খালেদা বলেন, “এই আইনের মাধ্যমে বিচারপতিদের ভয় দেখানো হচ্ছে। তাদের হাত বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। এই আইন আমরা মানি না, মানি না, মানব না।”
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিচারপতিদের স্বাধীনতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। “ব্যবসায়ীদের বলব, আপনারা সোচ্চার হউন। আওয়ামী লীগের লোকজন আপনাদের বড় বড় প্রতিষ্ঠান দখল করে নেবে। তখন বিচার পাবেন না। বিচারপতিদের হাত যেভাবে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে, তখন তারা ওই চোরদের পক্ষেই রায় দেবে।”
জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার মাধ্যমেও সরকার গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ করেন খালেদা জিয়া। ‘আওয়ামী লীগে রাজকার বেশি’
আওয়ামী লীগ নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের দল বললেও দলটিতে রাজাকারের সংখ্যাই বেশি বলে দাবি করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
“নূর মাওলানা কে, আপনারা সবাই জানেন। সে এই এলাকার বড় রাজাকার ছিল। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে তাকে মন্ত্রী বানিয়েছিল। আওয়ামী লীগের ঘরেই বেশি রাজকার আছে। এখনো খোঁজ করলে পাওয়া যাবে অনেক।”
বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের দল দাবি করে খালেদা বলেন, “জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এটা কেবল আমাদের কথা নয়, আওয়ামী লীগের ঘরানার নেতারাই বলেন।”
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমীন আহমেদ এবং মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকারের লেখা বই থেকে উদ্ধৃতি দেন।
“বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের দল। আর আওয়ামী লীগ রাজকারের আশ্রয়দাতা,” বলেন খালেদা। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়া সচিবের নিউ ইয়র্ক সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “এর পেছনে বিরাট রহস্য আছে।”
আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে অসংখ্য মানুষ খুন-গুম হয়েছে অভিযোগ করে ক্ষমতাসীন দলকে ‘খুনি-ড্রাকুলার দল’ বলেও অভিহিত করেন খালেদা। সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে দাবি করে এর সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, “আওয়ামী একটি সন্ত্রাসী দল, আওয়ামী লীগ একটি ছিনতাইকারী দল।”
সন্ত্রাস দমনে গঠিত র্যাবকে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে দাবি করে এই বাহিনী বিলুপ্ত করার দাবিও জানান খালেদা। ঢাকা থেকে রওনা হয়ে বিকাল ৪টার দিকে জনসভাস্থল জামালপুর জিলা স্কুল মাঠে পৌঁছেন খালেদা। মঞ্চে উঠলে দলের নেতা-কর্মীরা করতালি দিয়ে তাদের নেত্রীকে স্বাগত জানায়। বিএনপির জামালপুর জেলা সভাপতি ফরিদুল কবির তালুকদার শামীমের সভাপতিত্বে জনসভায় বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিএনপি নেতা-কর্মীরা যোগ দেন। শেরপুর ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলা থেকেও আসেন অনেকে। সমাবেশে অনেকের হাতে ধানের শীষ প্রতীক, জিয়াউর রহমান, তারেক রহমান ও খালেদা জিয়া বড় বড় প্রতিকৃতি ছিল। এসব ব্যানারের পাশাপাশি বিএনপির মহাসচিব প্রয়াত ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদারের নামে ডিজিটাল ব্যানারও দেখা গেছে। সালাম তালুকদারের বাড়ি জামালপুরে। সমাবেশে তার স্ত্রী মাহমুদা সালাম উপস্থিত ছিলেন। ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর রাজধানীর বাইরে এটা খালেদা জিয়ার চতুর্থ জনসভা। সর্বশেষ গত ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জনসভায় তিনি বক্তব্য রাখেন। জনসভায় বিএনপি নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মির্জা ফখরুল ইসলাম,মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম, সেলিমা রহমান, এ এস এম আবদুল হালিম, এম এ কাইয়ুম, অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন, হায়দার আলী, আমান উল্লাহ আমান, বরকত উল্লাহ বুলু, ফজলুল হক মিলন, আবদুস সালাম, খায়রুল কবীর খোকন, নাজিম উদ্দিন আলম, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, সানাউল্লাহ মিয়া, সিরাজুল হক, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, রশিদুজ্জামান মিল্লাত, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, সুলতান মাহমুদ বাবু, নিলোফার চৌধুরী মনি, রীতা খানম, মহিলা দলের নুরী আরা সাফা, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব উন নবী খান সোহেল, আনোয়ার হোসাইন, রফিকুল ইসলাম মাহতাব, আবুল কালাম আজাদ, আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল প্রমুখ।
জোট নেতাদের মধ্যে ছিলেন এলডিপির অলি আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর মজিবুর রহমান, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল লতিফ নেজামী, খেলাফত মজলিশের মুহাম্মদ ইসহাক, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, জাগপার শফিউল আলম প্রধান, এনডিপির খোন্দকার গোলাম মুর্তজা, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টির মুস্তাফিজুর রহমান ইরান, ন্যাপের জেবেল রহমান গানি, সাম্যবাদী দলের সাঈদ আহমেদ প্রমুখ।