মেয়র আরিফের ১ বছর : ‘প্রতিশ্রুতি’র মধ্যে আটকে আছে সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন

Mayor-Arifনুরুল হক শিপুঃ ‘প্রতিশ্রুতি’র মধ্যে আটকে আছে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আরিফুল হক চৌধুরী নগরবাসীকে শুধু আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছেন। দিন যায় আশায় আশায়। পরিবর্তনের শ্লোগান নিয়ে ২০১৩ সালের ১৫ জুন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। আওয়ামী লীগ প্রার্থী তৎক্ষালীন মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে দেশবাসীকে চমকে দিয়ে এ পদে আসীন হন। ১৮ সেপ্টেম্বর শপথ নিয়ে দায়িত্ব নেন নগর পিতার। সে হিসেবে গতকাল আরিফুল হক চৌধুরীর সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব নেয়ার ১ বছর পর্তি হয়। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত দ্বিতীয় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচনে জয় লাভের পর বলেছিলেন নগরবাসী ছয় মাসের মধ্যে তাঁর কাজের ফলাফল দেখতে পাবেন। তখন আরিফুল হক চৌধুরী গনমাধ্যমকে বলেছিলেন, সিলেটের উন্নয়ন নিয়ে তিনি পরিকল্পনার সবটুকুই নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকাশ করেছেন। নগরবাসীর দেয়া দায়িত্ব যথাযথ পালন করাই তাঁর দায়িত্ব। কিভাবে নির্বাচনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা যায় সে পরিকল্পনা সব সময় মাথায় নিয়ে কাজ করবেন। তিনি নিজেকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান দাবি করে নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নির্বাচনি ইশতেহার ছাড়াও তিনি নগরী ও নগরবাসীর প্রকৃত সেবক হওয়ার জন্য পরিকল্পনার ছক তৈরি করেন। সেই ছকের কার্যক্রম দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যে নগরবাসী উপলব্ধি করবেন বলে অভিমত প্রাকাশ করেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নগরীতে দৃশ্য মান কোন উন্নয়ন হয়নি বলে অভিযোগ নগরবাসীর।
এখনো নানা সমস্যা আর সংকট আঁকড়ে ধরে রেখেছে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডকে। সিটি কর্পোরেশন এলাকার বিভিন্ন সমস্যা আর নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী কি নির্বাচিত হওয়ার পর দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন? আর যদি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন তাহলে ১ বছরে কেন বড় কোন দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়নি নগরীতে। কেন আজ নির্বচনে দেওয়া অনেক প্রতিশ্রুতি ‘হবে’র মধ্যে আটকে আছে, নগরীর প্রায় ৮০ ভাগ সড়ক চলাচলের অনুপযোগী, জলাবদ্ধতা, যানজট নিরসন, পানির সমস্যা, ফুটপাত দখল মুক্তকরণ, বিদ্যুৎ সমস্যাসহ বড় কোন সমস্য আজও সমাধান হয়নি কেন -এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে নগরবাসীর মধ্যে। আর বাস্তবে সিলেট নগরীতে ওই সমস্যাগুলো জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে।
সিসিক সূত্রদাবি করেছে, নগরীতে জলাবদ্ধতা প্রতি বছর নাগরিক জীবনে মারাত্মক দূর্ভোগ সৃষ্টি করে। এ সমস্যা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দিনে দিনে স্থানে স্থানে অবৈধ স্থাপনা ও জবরদখলের ফলে নগরীর খাল-নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি, ছড়া ও নালা দিয়ে যেতে পারে না। এমন পরস্থিতিতে কর্পোরেশন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও খাল-নালা খননে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিলুপ্তপ্রায় গাভিয়ার খাল উদ্ধার ও খনন কাজ সম্পন্ন হয়। এছাড়া ধোপাছড়া, কালিবাড়ি ছড়া, মালনীছড়া, গোয়ালীছড়া, ভূবি ছড়া, মোগলীছড়া, হলদিছড়া এক্সকেভেটর দিয়ে খনন করা হয়। তারপরও অল্প বৃষ্টিতে নগরবাসীকে পানিবন্ধি থাকতে হয়।
পানির সমস্যা নগরীতে নতুন নয়। দৈনিক পানির চাহিদার পরিমাণ প্রায় ৮ কোটি লিটার। অথচ ৩০ টি উৎপাদক নলকূপের মাধ্যমে দৈনিক ২ কোটি ৫০ লাখ লিটার পানি অর্থাৎ চাহিদার মাত্র শতকরা ৩০ ভাগ সরবরাহ করা হচ্ছে। কোনমতেই তা সহনীয় নয়। ওই সমস্যাটি লাঘবের জন্য নগরীতে ১০ টি উৎপাদক নলকূপ স্থাপনের জন্য দরপত্র আহবান করে যথারীতি কাজ শুরু করা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই এ কাজ সম্পন্ন হবে। প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে প্রতিদিন পানি সরবরাহ ২ কোটি ৮০ লক্ষ লিটার বৃদ্ধি পাবে।
নগরীর বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণের জন্য কর্পোরেশনের উদ্যোগে সিলেটে ৫০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করতে পারলে নগরীর বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি উৎপাদন জাতীয় গ্রীডে সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে দাবি সিসিকের।
সিসিক সূত্র আরো জানায়, নগরীতে যানজট সমস্যা পুরোপুরি দূর করা সম্ভব নয়। ইচ্ছা করলেই সবখানে রাস্তা সম্প্রসারণ করাও সম্ভব নয়। তবু বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষামূলক কিছু কাজ করা হচ্ছে। সুরমা পয়েন্ট থেকে কোর্ট পয়েন্ট পর্যন্ত রিকশা লেন করা হয়েছে। ফুটপাত থেকে হকারদের সরিয়ে তাদের পুনর্বাসনের চিন্তা-ভাবনাও করা হচ্ছে। হকারমুক্ত ফুটপাত নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নগরীকে যানজটমুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উদ্যোগ নিয়েছে সিসিক। বিদ্যুতের লাইন আন্ডারগ্রাউন্ড হলে রাস্তা কিছুটা প্রশস্ত হবে। সে লক্ষ্যে চৌহাট্টা থেকে বন্দর পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে বিদ্যুতের লাইন আন্ডারগ্রাউন্ড করার কিছু কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুতের খুঁটিতে তারজট ঝুঁকিপূর্ণ এবং নগরীর সৌন্দর্যেরও পরিপন্থী। এ থেকে মুক্তি পেতে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগ এ বছর আরো সম্প্রসারিত হবে। দক্ষিণ সুরমায় ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ কাজটি দীর্ঘদিন যাবৎ ঝুলে আছে। নগরীর স্থানে স্থানে ট্রাকের অবাধ অবস্থান ও বিচরণও নগরীতে যানজটের অন্যতম কারণ। তাই ট্রাক টার্মিনালের জন্য অধিগ্রহণকৃত ৮ একর ৪৪ শতক জমিতে আমরা ৬ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ মাটি ভরাটের কাজ শুরু করেছি এবং ইতোমধ্যে প্রায় ৭০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মাটি ভরাটের পর ট্রাক টার্মিনালকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার জন্য ২৩ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। ট্রাক টার্মিনালের পাশে ফিলিং স্টেশন স্থাপনের জন্য ২০ একর জমি অধিগ্রহণেরও উদ্যোগ নেয়া হবে।
নগরীর বর্জ্য পরিবহন কাজে সহায়তার জন্য সিটি কর্পোরেশন থেকে এবার ৫টি হাইড্রোলিক ট্রাক ক্রয় করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বর্জ্য থেকে সার উৎপাদনের জন্যও উদ্যোগ নেওয়া হয়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে।
এছাড়া, বিশ্বব্যাংক ভূমিকম্পের ঝুকি হ্রাসকরণে ঢাকা ভিত্তিক একহাজার কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ যে প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে তার প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী মেয়রের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবতার আলোকে সিলেট নগরীকে এই বিশাল প্রকল্পের অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে সিলেট পরিদর্শনও করে গেছেন। লালদীঘির হকার মার্কেট, হাসান মার্কেটসহ অন্যান্য মার্কেট ও স্থাপনা সংস্কারের বিশেষ পরিকল্পনাও রয়েছে।
স্বাস্থ্য সেবা খাতে নিয়মিত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করেছে সিসিক সূত্র।সিসিক কর্তৃপক্ষের দাবি নগরীর ২৭ টি ওয়ার্ডে ২২ টি স্থায়ী ও ৯০ টি অস্থায়ী টিকাদান কেন্দ্রে মা ও শিশুদের ৯ টি রোগের প্রতিষেধক টিকা দেয়া হয়। স্বাস্থ্য সেবা খাতে চারটি সেকেন্ডারী ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে এবং লালমাটিয়া ডাম্পিং গ্রাউন্ডে একটি স্যানিটারী কন্ট্রোল ল্যান্ড ফিল্ড নির্মাণের পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন।
শিক্ষার মান উন্নয়নে মনিটরিং কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ কমিটি শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা চিহ্নিত করবে ও তা সমাধানে পরামর্শ দেবে। এছাড়া নান্দনিক শহীদ মিনার এলাকা দৃষ্টিনন্দন, সড়কে সিসি ক্যামেরা স্থাপন হবে বলে দাবি সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর। তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ড একটি চলমান প্রক্রিয়া। তিনি এমন কিছু করতে চান, যাতে নগরবাসী তাঁর আমলের পরও আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারেন, এই কাজ অমুক করেছে।’ বর্তমানে কাজই এখন কথার স্বাক্ষি। তিনি বলেন, মেয়র হওয়ার পর এবার সর্বপ্রতম বাজেট ঘোষনা করেছেন। বাজেট দেখলেই বোঝা যায় যে সিটি করপোরেশনের শূন্য তহবিল নিয়ে আমি যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেই সিটি করপোরেশনের আয় গত অর্থবছরের তুলনায় অনেক গুণ বেড়েছে। আয়ের নিত্যনতুন খাত তৈরি করছি।