গুরুত্বপূর্ণ হলেও অবহেলিত ‘কালনাঘাট’ : ত্রুটিপূর্ণ ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার

বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-মাওয়া-ঢাকা-সিলেট-তামাবিল সড়কের কালনা ফেরিঘাট

বাস ও ট্রাক পারাপারে ৫০ টাকার স্থলে নেয়া হয় ২০০ টাকা ॥ গাড়ির সারি (সীরিয়্যাল) ও বকশিসের নামে ইচ্ছেমতে টাকা আদায় ॥ ঘাট চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে একযাত্রীকে পিটিয়ে হত্যা ॥ হয়রানির শিকার যাত্রীসাধারণ ও চালকেরা

Mawa-feriনড়াইল প্রতিনিধি: ‘কালনাঘাট’। পশ্চিমপ্রান্তে নড়াইল এবং পূর্বপ্রান্তে গোপালগঞ্জ জেলা। মধুমতি নদী এই দু’টি জেলাকে বিভক্ত করেছে। সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মধুমতি নদীর কালনাঘাটটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘাট দিয়েই বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-কালনা-ভাটিয়াপাড়া-ভাঙ্গা-পদ্মা সেতু-মাওয়া-ঢাকা-সিলেট-তামাবিল সড়কের মাধ্যমে ‘আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ’ স্থাপিত হবে। বর্তমানে কালনাঘাট দিয়ে খুলনা, সাতক্ষীরা, বেনাপোল, যশোর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, বরিশাল, মাদারীপুর, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন সড়কে যাত্রীবাহীবাস এবং পণ্যবাহী ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন চলাচল করছে। কালনাঘাটের ফেরিচালক বুলু ঠাকুর জানান, এই (কালনা) ফেরিঘাট দিয়ে প্রতিদিন ১৫০-২০০ গাড়ি পারাপার হয়। বিশেষ করে রাতভর পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার হয়। তবে ফেরি বিকল হওয়ায় মাঝে-মধ্যে সমস্যা হচ্ছে। বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালকেরা জানান, কালনাঘাটে দীর্ঘদিন ধরে ত্রুটিপূর্ণ ফেরি দিয়ে পারাপার চলছে। এতে জীবন ও মালামালের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। গত ১৮ জুন বুধবার রাত ৩টার দিকে তলাছিদ্র ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপারের সময় কালনাঘাটে ছয়টি ট্রাক, দু’টি পিকআপ ও একটি মাইক্রোবাসসহ ফেরিটি ডুবে যায়। প্রায় এক বছর যাবত তলাছিদ্র ওই ফেরি দিয়েই যানবাহন পারাপার করা হচ্ছিল।
সেই সাথে ফেরি পারাপারে নির্ধারিত টাকার তিনগুণ থেকে চারগুণ নেয়া হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, গাড়ির সারি (সীরিয়্যাল) থেকে চাঁদাবাজির টাকা আদায়কে কেন্দ্র করে ২০১২ সালের ৩০ মার্চ রাত ৯টার দিকে কালনাঘাটে মাহমুদ হাসান (১৬) নামে এক বরযাত্রীকে পিটিয়ে ও নদীতে ফেলে হত্যা করা হয়। নিহত মাহমুদ গোপালগঞ্জের তেতুলিয়া গ্রামের জাফর মোল্যার ছেলে। এ ঘটনায় আরো ছয় যাত্রী আহত হন। এদিকে, কালনাঘাটে দু’টি ঘাট ও দু’টি পন্টুন থাকলেও একটি ফেরি দিয়ে পারাপার চলছে। এতে যেমন সময়ের অপচয় হচ্ছে, তেমনি একটিমাত্র ফেরিতে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি যানবাহন পারাপার করায় জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। কালনায় চলাচলরত ফেরিতে আট থেকে নয়টি বড় গাড়ির ধারণ ক্ষমতা থাকলেও বেশির ভাগ সময় সেই নিয়ম মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে রাতের সময় পণ্যবাহী ভারি ট্রাক ফেরিতে উঠানো হচ্ছে। এমন অভিযোগ করেছেন কালনাঘাটে চলাচলরত বাস, ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহনের চালকেরা। ট্রাকচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, সড়ক ও জনপথ টাকাই আয় করছে। টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। তাদের কাছে মানুষের জীবন ও সম্পদের কোনো মূল্য নেই। ট্রাকচালক মেছের আলী জানান, জরাজীর্ণ ফেরিতে পানি উঠলেও ফেরি কর্তৃপক্ষ তা দেখেও দেখে না। ‘কোনো অসুবিধা নেই’ বলে তারা প্রচার করতে থাকে। তিনি অভিযোগ করেন, বড় ট্রাক পারাপারে ৫০ টাকার স্থলে দেড়শ’ থেকে ২০০ টাকা করে নিচ্ছে। এছাড়া গাড়ির সারি (সীরিয়্যাল) থেকে ২০ টাকা নিচ্ছে। নড়াইল-যশোর-খুলনা-মাওয়া-ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে চলাচলরত যাত্রীবাহী পরিবহনসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও গাড়ির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কালনাঘাটে বাস পার হতে ২০০ টাকা করে দিতে হয়। যদিও বাসপ্রতি ৫০ এবং ছোটবাস ও ছোটট্রাক প্রতি ৩০ টাকা করে নেয়ার নিয়ম রয়েছে। পিকআপ চালক আকমল জানান, পিকআপ পারের জন্য ২০ টাকার স্থলে ৭০ টাকা এবং বকশিসের জন্য ১০ টাকা করে দিতে হয়। মাইক্রোবাস ও কার পার হতে ৬০ থেকে ৮০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। কোনো সময় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দিতে হয়। গত কয়েকদিনের অনুসন্ধানে এসব অনিয়ম বেরিয়ে এসেছে। যদিও সরকারি নিয়মানুযায়ী মাইক্রোবাস প্রতি ২০ টাকা, জিপ, কার ও বেবিট্যাক্সি প্রতি ১০ টাকা এবং ভ্যান ও মোটরসাইকেল প্রতি পাঁচ টাকা করে ধার্য করা হয়েছে। যানবাহন পারাপারের সড়ক বিভাগের ধার্যকৃত মূল্য তালিকাটিও ফেরিঘাট থেকে আড়াল করে পাশের ঝোঁপে ফেলে রাখা হয়েছে। ভূক্তভোগীরা জানান, বেশির ভাগ সময় আধাঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি দেরি করে ফেরি ছাড়া হচ্ছে। বাড়তি টাকা না পেলে তারা (ফেরি কর্তৃপক্ষ) যথাসময়ে ফেরি ছাড়ে না। বছরের পর বছর এই অবস্থা চলে আসছে। নড়াইল জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, এখানকার (কালনা) ফেরি অহেতুক ঘাটে বসে থাকে এবং ধীরে চলে। ফেরি সেবার মান বৃদ্ধি পেলে কালনাঘাটে যানহবানের সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমনি রাজধানী ঢাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। সময় ও জ্বালানি তেলের সাশ্রয় হবে। তিনি জানান, কালনা ফেরিঘাট থেকে ঢাকার দুরত্ব ১০৮ ও বেনাপোল ৯২ কিলোমিটার। এক্ষেত্রে কালনাঘাট দিয়ে বেনাপোল-ঢাকা সড়ক ২০০ কিলোমিটার, যশোর-ঢাকা ১৬০ কিলোমিটার, নড়াইল-ঢাকা ১২৬ কিলোমিটার, খুলনা-ঢাকা ১৯৫ কিলোমিটার। অথচ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাট দিয়ে ঢাকা যেতে এসব সড়কে ৩০০ থেকে ৪৫০ কিলোমিটার অতিক্রম করতে হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় যুগ্মসম্পাদক ও খুলনা বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটির কার্যকরী সভাপতি ছাদেক আহমেদ খান বলেন, যানবাহন পারাপারে বেশি টাকা নেয়াসহ কালনা ফেরিঘাটে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক অনিয়ম চলছে। ফেরিসেবার মান মোটেও ভালো নয় জানিয়ে তিনি আরো বলেন, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের উন্নয়নে ও সহজ যোগাযোগের ক্ষেত্রে কালনাঘাটের প্রতিবন্ধকতা দুর করা প্রয়োজন।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে ফেরি ইজারাদারদের পক্ষে মিজান সিকদার বলেন, মূলত একজনের নামে ইজারা নেয়া হলেও আমরা প্রায় ৩০ জন ইজারার দায়িত্ব আছি। গাড়ি পারাপারে বেশি টাকা নেয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করেন মিজানসহ অন্য ইজারাদারেরা। এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ গোপালগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী সমীরন রায় জানান, কালনাঘাটের ফেরি এক বছরের জন্য প্রায় ৪০ লাখ টাকা ইজারা (লীজ) দেয়া হয়েছে। ইজারাদারের লোকজনই যানবাহন পারাপারের দায়িত্বে আছেন। ফেরি পারাপারে বেশি টাকা নেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া ফেরির সংখ্যা বাড়াতে চেষ্টা করা হচ্ছে।