বড় বড় বানরের বড় বড় পেট ; লঙ্কায় যাইতে মাথা করে হেট
আব্দুল আজিজ তকি (৩রা মে ২০১৪)
এক সময় হাড্ডিসার বাঙালির শ্লোগান ছিল ‘অন্ন চাই বস্ত্র চাই-বাঁচার মত বাঁচতে চাই’। -অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বিশ্বকর্তা সেই আকাঙ্খা পূর্ণকরে বঙ্গ সন্তানদের পর্যাপ্ত পরিমান ভাত আর বস্ত্র দিয়ে মালামাল করে দিয়েছেন। আজকাল বাঙালি নাকি পেট ভরে খেতে পায়। করতে পারে রঙ-বেরঙের কাপড়ের সাজগোজ । শুধু কি তাই? খবর পাওয়া গেছে বর্তমানে বাঙালির ভাড়ারের ধান-চাল নাকি উপচে পড়ছে। রাজ্যপালরাও সগৌরবে বুক উঁচু করে মাইক বাজিয়ে বলছেন- ‘আমরা স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছতে আর বেশী দুরে নই’। -উপচে পড়া চাল বিদেশে বিক্রির এলানও মাঝে মধ্যে শুনা যায়। এমন ঘোষনা শুনে আনন্দ আর খুশীতে চোখে জল আসে। আহারে! এইতো চল্লিশ বছর আগেও মাত্র সাতকোটি মানুষের বাংলাদেশে ভাত-কাপড়ের কতইনা অভাব-অনটন ছিল। সেই সময় না খেয়ে, না পরে হাজারে- হাজার বাঙালি অকালে পটল তুলেছে। বিধির কৃপায়, সেই একই দেশের মাটিতে আজ সতেরো কোটি মানুষ ভাত কাপড়ে ছয়লাব। অন্ন-বস্ত্রহীন হয়ে কেউ মরছে বলে শুনা যায়না।
উল্লেখ্য, দুনিয়া বিখ্যাত ‘ঢাকার মসলিন’ কাপড় এক সময়ে ছিল বাঙালির ঐতিহ্যের বড়াই। বর্তমানে সেই ঐতিহ্যবাহি মসলিনের নামদাম খুব একটা নেই কিন্তু তা’তে কি। ইদানিং বিশ্বের রাঘব দেশগুলোতে বাঙালির তৈরী পোশাক পরিচ্ছদের কদর আকাশছোঁয়া। আমেরিকা, ইউরোপের সব নামিদামি দোকানদারেরা জাহাজ ভরে বাংলাদেশের তৈরী মাল নিয়ে নিজেরা মালদার হচ্ছে। ক্ষতি কি? আমরাও তা’তে করে দু’পয়সা কামিয়ে গুলতানি মারছি। দু’পক্ষই লাভবান। কিন্তু আামাদের জিজ্ঞাসা- ‘মুনাফার কড়িগুলো কার পেটে ঢুকছে।’ রক্তপরিশ্রমী মানুষগুলোর দিগে তাকালে আক্ষেপ আর আফসোস ছাড়া আর কিছু করার থাকেনা। সারাদিন কাজকাম করে এরা কি নিয়ে ঘরে ফিরে? কে এদের দিকে তাকায়? কে তাদের ভাল মন্দটা দেখে? কথায় কথা আসে। রানা প্লাজা ধসে কয়েক হাজার শ্রমিক প্রাণ দিল, হাত পা হারিয়ে আরো কতশত পথের ফকির হয়ে করছে আহাজারি। আমাদের কর্তা-কর্ত্রীরা তাদের কষ্টের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে ঝুলিভরে টাকা তুল্লেন। বছর ঘুরে গেল, এই টাকাগুলো যাদের প্রয়োজনে কাজে লাগনো হবে তা’ আটকে আছে। ভুক্তভোগী মানুষগুলোর আহাজারি দেখে শুধু যে মনে কষ্ট পাচ্ছি তা’ নয় সেই সাথে সন্দেহও বাড়ছে। এই টাকাগুলোও কি শেষ পর্যন্ত দূর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষগুলোর কাছে যাবে; না তাদের অশ্রুজলে ভিজতে ভিজতে একসময় উদাও হয়ে যাবে ? বড় বাবুরা বসে বসে খুব শুধাময় বচনই শুনিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু ‘যা দেখছিনা নিজ নয়নে; বিশ্বাস করি কেমনে গুরুর বচনে।’
এদিগে কিছু সংখ্যাক বাঙালির সুখ দেখলে পেটে আর ভুখ থাকেনা। তারা পেট ভরে খেয়েদেয়ে দিনদূপুরেও দু’এক ঘন্টা এক্সট্রা ঘুমান। শুধু কি তাই, পাতে-ভাতে মালামাল বলেই তারা হাটে-ঘাটেও করেন সর্দারী। সুতরাং তাদের ভাড়ারে অহরহ মাল আসতেই আছে। মালদারেরা যে আরো মালদার হচ্ছে তা’ তাদের চেহারায় চোখ রাখলেই বুঝা যায়। সফেদ চুন, খোশবুদার জর্দা, আর বাহারি মাল-মসলা লাগিয়ে তারা যখন মুখে পান ঢালে তখন বেহেস্তি সুখে দুযোখটা দৌড় দিয়ে দুনিয়ার কোনপ্রান্তে গিয়ে লুকায় টেরই পাওয়া যায় না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে, একটু চোখ তুলে তাকান। দেখবেন আপনার কাছে একমুঠো ভাত অথবা একটুকরো কাপড় এর আব্দার নিয়ে কেউ হাত পাতছে না। বলার অপেক্ষা রাখেনা এটা একটি সুখবর। আপনি নিশ্চয় মনে মনে বলবেন- ‘বাংলার মানুষ তাহলে দরিদ্র মুক্ত হল, কপাল থেকে ভিক্ষার অভিশাপটা মুছলো’।- ধারনাটা মোটেই সঠিক নয় কারণ ‘ডালের বগী এখন খালে’।- বাঙালির প্রয়োজন আরো দশগুণ বেড়ে গেছে। তা’দের জীবন-যাপনে নতুন করে যোগ হয়েছে অপূরন্ত চাহিদার। বদলে গেছে ভিক্ষার তরিকা।
চৌরাস্তার ধারে, কিংবা শহর-বন্দরে এক মিনিট দাঁড়ান দেখবেন আব্দারের পর আব্দার। ঘরের চালে টিন নাই, অপারেশনের টাকা নাই, মেয়ের বিয়ের কড়ি নাই এমন কি হাতে একটা মোবাইলও চাই। অবাক হলেন? তা’তো হবেনই কারণ ‘গোড়ায় গলদ’। -বিধাতার কাছে যত দোওয়া-কালাম, আশা-আব্দার করা হয়েছে তা’ ছিল এক মাত্র ‘অন্ন-বস্ত্রের’। -তখন চাহিদার তালিকাটাতে আরো কয়েকটি আব্দার যোগ করা উচিৎ ছিল। কিন্তু বিষয়টি তখন কারো মাথায় আসেনি। সত্যি বলতে কি, তখন কেউ মনে করেনি এক সময় ঘরের টিন, মেয়ের বিয়ের টাকা, স্বাস্থ্য রক্ষার খরছ এমনকি মোবাইলের দরকার পড়বে। কাল-কালান্তর থেকে সকলে যা চাইলো বিধাতা কৃপা করে তা পূর্ণ করে দিয়েছেন। আবার নতুন আব্দার নিয়ে কোন মুখে তাঁর কাছে ফেরত যাবেন বলুনতো? হালে তিনি ভাগ্যান্বেষী আরেকদল মানুষের প্রতি আলোকপাত করছেন। আমাদের তদারকির ভার ছেড়ে দিয়েছেন কয়েকজন দলপতি, বলপতিদের হাতে। তারাই আমাদের ভাগ্যের বর্তমান হর্তা,কর্তা।
অবশ্য বাংলাদেশের অফিস আদালতে যে সকল সাহেব, মোসাহেব, পেয়াদা-পায়েক আর চাপরাশিরা কাজ-কাম করেন বিধাতা তাদের ভাগ্যটা বর্তমানে কুশাদা করে দিয়েছেন। বিনা কামে যে ভাবে পীর-মুর্শীদ এর পকেটে মাল ঢুকে ঠিক তেমনি এ’সকল চাকুরিজীবিদের পকেটেও ঢুকছে ‘মাল আর মাল’। -সাধারণ পাবলিক প্রচুর দান-খয়রাত করে। ফলে দেখা যায় ‘তিন টাকার চাকরিজীবির নয় টাকার ফুটানি’। ‘আনন্দে’ অথবা ‘নিরানন্দে’ হলেও আমরা বকশিস দিয়ে তা’দের পকেট করি ভার। স্বার্থ উদ্ধারে যত বেশী পারা যায় উপরি মাল দিয়ে তাদেরকে নিজেদের পক্ষে রাখার চালাই প্রতিযোগিতা। তারাও আমাদের সবাইকে দেখান ‘কাচ-কলা’।- মনে হয় সৃষ্টিকর্তাও তা’তে অখুশী নন। অহরহ তার বান্দাদের আঙ্গুলফুলে কলাগাছ হওয়ার কাজকারবার ও কৌশলটা নিশ্চয়ই দেখছেন কিন্তু কিছুই করছেন না। এদিগে দেখেনতো কি কান্ড। ভীতির দায়ে প্রীতি দেখিয়ে অঞ্জলিভরে মাল ঢালি। আমাদের এই ‘দুর্গতিটা’কে বিশ্ববাসি বলছে ‘দুর্নীতি’। -বিশ্ব দুর্নীতির খাতায় আমাদের দেশের নামটা নাকি বার বার চলে আসে এক নম্বরে। মনের দুঃখে বলি গোলাম হোসেন ‘নদীর আরেক নাম গাং, বাঁকা হয়ে চলে তাই এত বদনাম।’
ইদানিং বাংলাদেশে ভাত-কাপড়ের চিল্লাচিল্লি না থাকলেও ‘ভোটাভোটির’ চেঁচামেচি আছে। যারা বক্তৃতায় অনলবর্ষী তারাই দেশের ও দশের স্বঘোষিত বন্ধু,গরীবের ঠিকাদার ও গণতন্ত্রে পাহারাদার। একবার মকসুদে-মঞ্জিলে পৌঁছতে পারলেই তারা তাল গাছের ডগায় চড়ে বাজান ডুগডুগি। আবার নির্বাচন আসলেই পিচঢালা পথে নামেন। খোলামনে কুলি, মজুর, কামার, কুমার সকলের সাথে করেণ কোলাকুলি আর করমর্দন। মালভরা পেটের ঠেলায় তখন বুকভরা ভালবাসা তিন গজ দূরে আছড়ে পড়ে। অসাধারণ একটা চন্দ্র হাসিতে দেখবেন সুখপাখির পতপতানি। সুখের পট্টি বুকে লাগিয়ে সকলের ঘরে ঘরে পাঠিয়ে দেন ম্যাসেজ। মধুবাক্যে আপনার আমার হৃদয় কাড়েন। তারপর? ‘লঙ্কার রাজা- সারাদিন বসে খায় চানাচুর ভাজা’।-এভাবে বার বারই দেখবেন, লঙ্কায় যেতে মাথা হেট করে কত ফকির-মিছকিন আপনার দরজার কড়া নাড়ছে, দশহাত লম্বা সালাম দিয়ে আপনাকে করছে আপ্লুত । এমন সব কাপালিকাদের দেখলেই আমার কেন জানি একটা প্রবাদ বাক্য মনে পড়ে -‘বড় বড় বানরের বড় বড় পেট ; লঙ্কায় যাইতে মাথা করে হেট।’