‘শান্তিপূর্ণ ভোট ডাকাতি’ এবং ভোটারের মনোকষ্ট
মীর আব্দুল আলীম
সেদিন চমৎকার শিরোনাম দিয়েছে ঢাকার একটি ডাকসাইটের জাতীয় দৈনিক।“শান্তিপূর্ণ ভোট ডাকাতি”।- ভোট ডাকাতি সম্পন্ন হয়েছে, তাও আবার শান্তিপূর্ণভাবে! আজকাল আমাদের কথার সাথে কাজের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা বলছি একটা, আর করছি অন্যটা। বলতেই হয় পত্রিকাটি বাক্যপ্রয়োগে পরিবর্তন এনেছে। যথার্থ ভাষা প্রয়োগ করেছে। পত্রিকাটি হাল জামানার সাথে মিল রেখে তবেই শিরোণামটি দিয়েছে। যা কিনা হওয়ার কথা ছিলো “নজিরবিহীন ভোট ডাকাতি” সেখানে দেয়া হলো “শান্তিপূর্ণ ভোট ডাকাতি”। -এ জাতীয় ডাকাতি প্রকাশ্যে প্রশাসন, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং আমজনতার চোখের সামনে এমন ভাবে সম্পন্ন হচ্ছে যে, ডাকাতির মতো নেক্কারজনক ঘটনার আগে আমাদের পত্রিকাওয়ালারা শান্তিপূর্ণ শব্দটি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছেন। জানি এজাতিয় বাক্য প্রয়োগে সাংবাদিকদের মনোকষ্ট অনেক, তবুও ভোটের নামে দেশজুড়ে যা ঘটেছে তাতে এমন শিরোনাম মন্দ কিছু নয়।
পাঠক উপজেলা নির্বাচনের নামে কি দেখলাম আমরা? গত ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধীদল অংশগ্রহন না করায় জনগনকে ভোটকেন্দ্রে যেতে দেখা গেছে খুব কম। ২/১টি পত্রিকা কোন কোন কেন্দ্রে ভোটার না থাকায় লেংড়া কুকুরের ছবি পর্যন্ত ছেপেছে। যদিও এটা মোটেও সোভনীয় ছিলো না। যাই হউক বলতেই হবে সে নির্বাচনে ভোটের উৎসব ছিলোনা মোটেও। ভোটার শুণ্য ছিলো ভোট কেন্দ্রগুলো। বিগত ৫ বছরে আওয়ামীলীগ সরকারের অধিনে শান্তিপূর্ণ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি তা কিন্তু নয়। এ সরকারের সময়ে (দশম জাতীয় সংসদ এবং উপজেলা নির্বাচনের আগে) প্রায় সকল নির্বাচনই গ্রহনযোগ্য হয়েছে। সেসব নির্বাচনের ব্যাপারে দেশ বিদেশে যেমন বিতর্ক নেই, আমিও এ ব্যাপারে বিতর্কে জড়াতে চাই না। দেশের ৫ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনেরর পর নির্বাচন বিষয়ে সরকারের গ্রহনযোগ্যতা তখন অবশ্যই বাড়ে। তাতে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে সিইসি তথা হাসিনা সরকার। পরে ৫ ফেব্রুয়ারীরর নির্বাচনে দেশে নির্বাচনি আমেজ এবং গ্রহনযোগ্যতা নষ্ট হয়েছে। এর পর আসে উপজেলা নির্বাচন। ৫ ধাপে সে নির্বাচন সম্পন্নও হয়েছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম ধাপের নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়। বিএনপিসহ সমমনারা সে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় নির্বাচনি আমেজ ফিরে দেশে। নির্বাচনমূখী হয় দেশের মানুষ। ক্ষমতাসীন দলের বহুবিধ নির্যাতনে বিধ্বস্ত বিএনপি এ নির্বাচনকে ঘিরে জেগে ওঠে। অতি দ্রুত মাঠ পর্যায়ে নতুন গতি সঞ্চার হয়। অনেক বাধাবিঘন পেরিয়ে বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা উপজেলা নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও আটঘাট বেঁধে এই নির্বাচনে নামে। জমে উঠে নির্বাচন। ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৯৮ উপজেলার মধ্যে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ৪৫টি উপজেলায় জয়ী হয়ে দারুণ সফলতা দেখাতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা পান মোট ৩৪টি আসন। জামায়াতে ইসলামী জনগণের অনুমানের চেয়েও বেশি উপজেলায় জয়ী হয়ে সবাইকে রিতিমত তাক লাগিয়ে দেয়। বিএনপির এমন ফলাফলে মাঠের সমর্থক, অনুসারীরা যেন আরো সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে বিএনপি পুনরায় চমক দেখাতে সক্ষম হয়। সে সময় ঘোষিত ১১৬টি উপজেলার ফলাফলে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা মানিকগঞ্জ ও ঢাকায় একচেটিয়া ভোটের আধিপত্য দেখিয়ে মোট ৫২টি উপজেলায় জয়লাভ করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা প্রার্থীরা মোট ৪৬টি আসনে জয়লাভ করেন। সারা দেশে চাঙ্গা হয়ে ওঠে বিএনপি ও সমমনাদলগুলো। এর পরই সবকার দলের টনক নড়ে। তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে নির্বাচনী রূপ একেবারে পাল্টে যেতে থাকে। ভোটে জোড়জুলুম এমন পর্যায়ে আসে যে সংবাদপত্রগুলো শান্তিপূর্ণ ভোট ডাকাতি হচ্ছে বলে উল্লেখ্য করতে বাধ্য হয়েছে। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে জনগনের সম্পৃক্ততা না থাকা এবং বর্তমানে সম্পন্ন হওয়া উপজেলা নির্বাচনে নানামূখী বিতর্ক দেশের নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যে নষ্ট করেছে তা বলবার আর অপেক্ষ রাখে না।
এ কথা বলতেই হয়, দেশ জুড়ে নিবিঘেœ ব্যাপক হারে কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট, ভোটের আগে ব্যালটে সিল মেরে বাক্্ের ঢুকিয়ে রাখা, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, ভোটারদের বাধা, মারধর ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে উপজেলা নির্বাচন। সর্বশেষ পঞ্চম ধাপে ‘ভোট ডাকাতির’ অভিযোগ এনে ১৪ জেলার ২০টি উপজেলায় বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও দলের বিদ্রোহীসহ মোট ৬৪ জন চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। এর আগের ধাপগুলোতেও বহু উপজেলায় বিরোধী প্রার্থীরা ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। ভোট বর্জনের ঘোষনা কেবলাই শান্তনা। বর্জন করে কোন এক উপজেলায় ভোট কার্যক্রম বন্ধ থেকেছে ফলাফল বন্ধ রয়েছে তার অন্তত নজির নেই। প্রার্থীরা ভোট কেন বর্জন করবেন? যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার কথা, কিন্তু তা হয়েছে কি? এছাড়া অনিয়মের বিরুদ্ধে বহু পদক্ষেপ নেয়ার কথা ছিল কিন্তু তা নেয়া হয়নি।উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, জবরদখলের মহা উৎসব। বোঝা যায়, উপজেলা নির্বাচনে উপর্যুপরি হারের পর ক্ষমতাসীন দলের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়েছিল। একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, পঞ্চম, চতুর্থ ও তৃতীয় পর্যায়ে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তাতে পাবলিক সেন্টিমেন্ট মোটেও সরকারের অনুকূলে যায়নি। বরং ভোটের অধিকার নিয়ে মানুষ নতুন করে মহাভাবনায় পড়েছে। জনগন ভোট দিতে না পেরে অসহায়ত্ববোধ করছে।
এদিকে দেশে যখন উপজেলা নির্বাচন চলছে তখন হঠাৎ করেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছুটিতে গেছেন। সরকারের উপদেষ্টা বলছেন, তিনি ক্লান্ত হয়ে ছুটি নিয়েছেন। তিনি নাকি অবকাশযাপনে গেছেন। তিনি নিজে তা কিন্তু বলে যাননি। এনিয়ে যতটুকু জল্পনা কল্পনা তাতে সরকারের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় তিনি ছুটি নিয়েছেন। সরকারের পক্ষাবলম্বনকারীরা বলছেন, তিনি ছুটিতে যেতেই পারেন, এটা বড় কোনো বিষয় নয়। অন্য চারজন কমিশনার তো আছেন। তারা নির্বাচন পরিচালনা করছেন। কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান ডিজিটাল যুগে তিনি সশরীরে উপস্থিত থাকলেন কিনা, সেটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে কোনো জায়গায় থেকেই কাজ করা যায়। কথা যেভাবেই আসুক জনগন কিন্তু ভর উপজেলা নির্বাচন চলাকালনি সময় সিইসির অবকাশযাপনে যাওয়াটা মোটেও সহজভাবে নেয়নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এভাবে অবকাশে যাওয়া মোটেও সমচিন হয়নি। সর্ব্বোচ্চ স্থানে থেকে নির্বাচন করতে গিয়ে যদি কেউ ক্লান্ত হয়ে যান, তার যোগ্যতা এবং গ্রহনযোগ্যতা উভয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কাজের সময় কেউ ক্লান্ত হয়ে গেলে, আর যাই হোক তাঁর অন্তত প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকা উচিত নয়। তিনি জনগণের অর্থে সব সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে নির্বাচনকালনি সময়ে ক্লান্ত হয়ে দেশত্যাগ করবেন এটা হতে পারে না। হতে পারে সরকারের সাথে তারা বনিবনা হয়নি, তিনি (সিইসি) যেভাবে চেয়েছেন সেভাবে নির্বাচন কার্য সম্পন্ন করতে পারেননি তাও হতে পাওে, তাই বলে তিনি সব ফেলে অবকাশে যাবেন তা মোটেও শোভনীয় নয়।
এবারের কিস্তিবন্দী উপজেলা নির্বাচনের সবচেয়ে দৃশ্যমান দিক হচ্ছে, ভোটকেন্দ্র দখল, নির্বাচনের আগের রাতে এবং নির্বাচনের দিন ভুয়া ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্্র ভরাট করা, সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বিরোধীদলীয় এজেন্টদের বিতাড়িত করা, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দান, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ব্যালট পেপারে আগুন লাগানো ইত্যাদি। পত্রপত্রিকায় খবর এসেছে সরকার দলীয়রা বিভিন্ন স্থানে বলে ফিরেছে, ‘ভোট যাকেই দেন চেয়ারম্যান হবেন উনিই’; ‘আপনার কষ্ট করে আসার দরকার ছিল না, আপনার ভোট আমরাই দিয়ে দিয়েছি’, ‘ফুটেন ভোট দেওন লাগবো না’ ইত্যাদি, ইত্যাদি। এ অবস্থায় উপজেলা নির্বাচনে অনিয়মে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাচন কমিশন ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তাঁর মতে, উপজেলা নির্বাচনের শেষ ধাপে অনিয়ম আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাচন কমিশন ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের নিশ্চুপ থাকার প্রশ্নে ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘নিশ্চুপ বলে কোনো জিনিস নেই। বিষয়টা হল সক্রিয়তাকে আমি নেতিবাচকভাবে নিব, অনিয়ম দেখেও আমি কোন পদক্ষেপ নেব না বিষয়টা হল এমন।’ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চুপ থাকার কারণে সাধারণ মানুষ কিন্তু নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এর আগে আশঙ্কা ছিল, বিএনপি ও তার মিত্ররা হয়তো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় স্থানীয় পর্যায়ের এই নির্বাচনে অংশ নাও নিতে পারে। কিন্তু অনেকটা কৌশলগত কারণেই বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিলে এই নির্বাচন ঘিরে তৈরি হয় তুমুল উত্তেজনা। বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেওয়ায় শাসক দলের অনেকেই কটাক্ষ করে বক্তব্যও দিতে থাকেন। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, তৃণমূল পর্যায়ে দলকে নতুন করে গোছাতেই এই নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করছে। বিএনপির এমন ঘোষণায় সাধারণ ভোটাররাও নড়েচড়ে বসে। জমে ওঠে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। কিন্তু এ নির্বাচনে যা হবার তাই হয়। ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে যে কারণে বর্জন করেছিল বিএনপি ও তাদের অনুসারী জোটসহ অসংখ্য রাজনৈতিক দল, উপজেলা নির্বাচনে এসে সেটিই ফের প্রমাণিত হলো। ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ফলাফল নিজেদের দখলে নিতে স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে প্রমাণ করেছে ভোটের অধিকার কতটা বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পতিত। জনগণ নতুন করে দেখেছে, তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি ক্ষমতাসীনরা কতটা মর্যাদাহীন করতে পারে।
বর্তমান সরকার বলেছিল, তাদের অধীনে প্রতিটি নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। ভোটাররা নির্বিঘেœ তাদের ভোটাঅধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। কিন্তু তা কি আদৌ হয়েছে? উপজেলা নির্বাচনই এর সঠিক জবাবব মিলবে। গণমাধ্যমের বদৌলতেই দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করেছে। আমরা পত্রিকা আর টিভিতে দেখেছি, কিভাবে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ধাপে ধাপে ক্ষমতাসীন দল শক্তি প্রয়োগ করেছে। সর্বশেষ চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে কী তুঘলকি কা- হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল শক্তি প্রয়োগ না করলে, ভোটকেন্দ্র দখল না করলে, আওয়ামীবিরোধীরা যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত, তা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়। এবারের উপজেলা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব, বাগাড়ম্বর ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বও আমরা চাক্ষুষ দেখতে পেয়েছি। সরকার যত কথাই বলুক, উপজেলা নির্বাচনে সাধারণ জনগণ স্বাধীনভাবে মতের প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। এটা সন্দেহাতিতভাবে প্রমানিত হলো যে কোন দলীয় সরকারের অধিনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া অতিব কঠিন কাজ।