সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়ক সংস্কারের নামে কোটি টাকা চাঁদাবজি-৯ বছর ধরে চরম দুর্গতি
মো.ফখরুল ইসলাম :: ওসমানী বিমানবন্দর-ভোলাগঞ্জ জাতীয় মহাসড়ক প্রকল্পের কাজ দীর্ঘ দিন থেকে লালফিতায় বন্দি হয়ে আছে। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও কাজ শুরুর ব্যাপারে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। কবে হবে তাও বলতে পারছেন না কেউ। এদিকে রাস্তার কাজ সংস্কারের নামে প্রতিদিন প্রায় ২০লাখ টাকা চাঁদাবাজি করা হচ্ছে।
সালুটিকর-ভোলাগঞ্জ সড়ক দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মালবাহী ট্রাক চলাচল করে। দেশের অবকাঠামোর প্রায় ৭০ ভাগ পাথর ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি থেকে সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর দিয়েও মালামাল আনা-নেয়া হয়। সড়কে এক্সেল লোড -এর নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় প্রতি ট্রাকে ৩০ টনের অধিক পাথর বহন করায় এই সড়কটি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। সড়কটির স্থায়িত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ সড়ককে জেলা সড়ক থেকে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করার লক্ষ্যে বিমানবন্দর বাইপাস ইন্টারসেকশন-লালবাগ-সালুটিকর-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ জাতীয় মহাসড়ক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে ৪৪১ কোটি ৫৪ লাখ টাকার প্রকল্প গত বছরের ৭ এপ্রিল অনুমোদন দেয় একনেক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ হাজার পাথরবাহী ট্রাক চলাচল করে এই সড়ক দিয়ে। প্রতিদিন রাস্তা সংস্কারের নামে প্রতিটি ট্রাক থেকে ন্যূনতম ২০০ টাকা হারে ২০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। সড়ক ও জনপথ বিভাগের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নামে এবং স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসীর সহযোগিতায় প্রতিমাসে ৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও পাথর ব্যবস্য়াী ও স্টোন ক্রাশার মিল মালিকদের কাছ থেকেও বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করা হয় রাস্তা সংস্কারের নামে। আর এসব টাকার ভাগবাঁটোয়ারা হয় সরকারদলীয় শীর্ষ নেতা, প্রশাসনের কর্মকর্তা, পুলিশ, স্থানীয় এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের লোকজন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে। শুধু ট্রাক থেকে প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ আদায় করা হয়, তা দিয়ে কয়েকটি নতুন রাস্তা তৈরি করা সম্ভব। অথচ দীর্ঘ দিন থেকে অদৃশ্য কারণে এ রাস্তার সংস্কার কাজ হচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর গণভবনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিমানবন্দর-বাইপাস-ইন্টারসেকশন লালবাগ-সালুটিকর-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ সড়ককে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর নানা প্রক্রিয়া শেষে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় সড়ক বিভাগ। দরপত্র আহ্বান করে যাচাইবাছাই করা হয়েছে। স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ও আব্দুল মোনায়েম লিমিটেড নামে ২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্র মূল্যায়নে উত্তীর্ণ হয় । এর মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসাবে নির্বাচিত হয় স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড । গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সম্পন্ন হওয়ার কথা । চলতি অর্থ বছরে বরাদ্দ এসেছে ৬০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৩১ দশমিক ৭৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের ১৬ দশমিক ৭২ কিলোমিটার সড়ক ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট (বিটুমিন) দিয়ে নির্মাণ করা হবে। বাকি ১৩ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার নির্মাণ করা হবে রিজিড পেভমেন্ট বা কংক্রিট দিয়ে। সড়কে নির্মাণ করা হবে ২ স্পেনের ৭৫ দশমিক ২৪ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু। নতুন করে নির্মাণ করা হবে দুটি কালভার্ট এবং ২৯ দশমিক ৩৫২ বর্গমিটার সারফেস ড্রেন। এছাড়াও ১ লাখ ২২ হাজার ২শ বর্গ মিটার কংক্রিট সেøাপ প্রোটেকশন নির্মাণ করা হবে। আরো থাকবে একটি ইন্টারসেকশন ও ৬টি ট্রাক-বে। এছাড়াও নির্মাণ করা হবে একটি টোল প্লাজা। সওজ সূত্র জানিয়েছে, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প এবং ৪ লেন সড়কের কাজের গতি ত্বরান্বিত হবে। ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর হয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য ও কম সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবহণ করা যাবে।
কোম্পানীগঞ্জ পাথর ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল জলিল জানান, বর্তমানে সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কের অবস্থা একেবারেই নাজুক, যান চলাচলের প্রায় অনুপযোগী। পুরো সড়ক ভাঙাচুরা ও বিধ্বস্ত। সড়কের স্থানে স্থানে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের।
চরম ঝুঁকি নিয়ে ভাঙাচুরা সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কে যানবাহন চলছে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে। যাত্রীরা বলেন, ‘এটি সড়ক নয়, যেন নরকযন্ত্রণা’। সড়কটি পুনর্নির্মাণ করা হবে বলে উত্তর সিলেটবাসী আনন্দিত হয়েছিলেন। পরিবহণ সংগঠনগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে আনন্দমিছিল ও মিষ্টি বিতরণ কর্মসূচি পালন করা হয়। কিন্তু একনেকে অনুমোদনের প্রায় এক বছর পরও সড়কের কাজ শুরু না হওয়ায় সবার মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। চরম ঝুঁকি আর ভোগান্তি নিয়েই চলাচল করছে পাথর ও যাত্রীবাহী যানবাহন।
৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের পিচ একেবারে উঠে গেছে। সড়কটির জীর্ণদশার কারণে ভোলাগঞ্জ থেকে পাথর পরিবহণ তো দূরের কথা, যাত্রী পরিবহণও ঝুঁকিপূর্ণ। ৩৭ কিলোমিটার রাস্তাটির পুরোটিই এখন প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় সারাক্ষণ সড়কসহ আশপাশের এলাকা ধুলোয় আচ্ছন্ন থাকে। আর বর্ষা মৌসুমে পরিণত হয় কাদার ভাগাড়ে। এর ফলে যাত্রী সাধারণের ভোগান্তির সীমা নেই। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন যানবাহন মালিক-শ্রমিকরা। ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তার জন্য যাত্রীদেরও ৩-৪ গুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। পাথর ব্যবসায়ীরা জানান, বিভিন্ন এজেন্সি ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ট্রাক কিনে তারা পাথর সরবরাহ করে থাকেন। ভাঙাচুরা পথে চালাতে গিয়ে কম সময়েই ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয় । তাই সময়মতো দেনা শোধ করতে মালিকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এক সময় এ উপজেলার মানুষ মাত্র ৩৫-৪০ মিনিটে সিলেট যেতে পারতেন। কিন্তু, এখন রাস্তার বেহাল দশার দরুণ ২-৩ ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হয়।
আশির দশকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ রাস্তা নির্মাণ, সংস্কার ও আধুনিকীকরণের পদক্ষেপ নেন। বিএনপির শাসনামলে অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান রাস্তাটির উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে রাস্তার উন্নয়ন কাজ শুরু করেন। যার কারণে লোকজন কোম্পানীগঞ্জ থেকে মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ মিনিটে সিলেটে যেতে পারতেন। এরপর এক এগারো পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাস্তার উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিলেট-১ সংসদীয় আসন থেকে কোম্পানীগঞ্জকে বাদ দিয়ে জৈন্তা-গোয়াইনঘাট আসনের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সংসদ সদস্য ইমরান আহমদ রাস্তাটিকে জেলা সড়ক থেকে জাতীয় মহাসড়কে রূপান্তরের উদ্যোগ নেন। তবে, গেল ৫ বছরে পিরিয়ডিক্যাল মেইনটেন্যান্স ছাড়া রাস্তার কার্যত কোনো সংস্কারকাজ হয়নি। এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড় বছর পার হলেও রাস্তার উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় আন্দোলনে নামেন সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন সামাজিক, আঞ্চলিক ও পেশাজীবী সংগঠন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন। গণমাধ্যমে অনেক লেখালেখি ও সংবাদ পরিবেশনের ফলে এবং বহু আন্দোলনের পর ২০১৪ সালের মে মাসে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভোলাগঞ্জ গিয়ে সড়ককে ‘ক্যানসার আক্রান্ত’ বলে মন্তব্য করে অচিরেই সংস্কার করা হবে বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু এর পরও সেটি সংস্কার হয়নি।
গত বছরের ২১ নভেম্বর সিলেট সার্কিট হাউসে উন্নয়ন কর্মকান্ডের বিষয়ে এক মতবিনিময় সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়ক প্রকল্পের কাজ ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে। কিন্তু এ সময়েও কাজ শুরু হয়নি।
জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি দিলু মিয়া জানান, বর্তমানে শুধু কোম্পানীগঞ্জে প্রতিটি গাড়ি থেকে ১০০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হয়। সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীর সাথে যোগাযোগ করেছি। তিনি ১ এপ্রিল কাজ শুরু করার আশ্বাস দিয়েছেন। আগামী ১এপ্রিল রাস্তার নির্মাণ কাজ শুরু না হলে বিমানবন্দর কোম্পানীগঞ্জ- ভোলাগঞ্জ সড়ক অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাহের (ইজু) জানান, অর্থমন্ত্রী বলে ছিলেন, গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কাজ শুরু হবে। কিন্তু শুরু হয়নি। তাই অতি শীঘ্রই আন্দোলনে যাব।
এ ব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ স্টোনক্রাসার মিল মালিক সমিতির সভাপতি ডা. আব্দুন নুর জানান, এ সড়ক আমাদের জন্য একটি মরণফাঁদ। এ রাস্তার সংস্কারের দায়িত্ব নিয়েছিল স্টোনক্রাশার মিল মালিক সমিতি ,পাথর ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, ট্রাক মালিক সমিতি ও ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন। রাস্তার উন্নয়ন প্রথম দিকে কিছুটা হয়েছিল। পরবর্তীকালে মতবিরোধের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।
কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ জাতীয় মহাসড়ক প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিলেট সড়ক ও জনপথ বিভাগের দায়িত্ব অবহেলার কারণে দীর্ঘ দিন থেকে এই প্রকল্পের কাজ আটকে আছে।
সড়ক বিভাগ সিলেট জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ইফতেখার কবির জানান, সিলেট-ভোলাগঞ্জ জাতীয় মহাসড়ক প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সম্পন্নের লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। ২০১৮ সালের মধ্যেই এটির কাজ শেষ হবে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মনির হসেন জানান, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক মূল্যায়নপূর্বক অনুমোদনের জন্য সওজ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে । অনুমোদন হলে চুক্তি হবে, তারপর কাজ শুরু হবে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের দায়িত্ব অবহেলার কথা তিনি অস্বীকার করে বলেন, এটি যেহেতু বড় প্রজেক্ট তাই দরপত্র আহবান, দরপত্র যাচাই বাছাইয়ে একটু সময় বেশি লেগেছে ।