কথা দিয়েছিলাম পদ্মা সেতুর, নির্মাণ শুরু হলো
ডেস্ক রিপোর্টঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কথা দিয়েছিলাম পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করব, নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গেল। গত নির্বাচনে জনগণ নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিল বলেই এতো বিশাল সেতুর কাজ শুরু সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। এই মাসে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাঙালি জাতিকে দাবায় রাখা যাবে না। সে কথা সত্য হয়েছে। বাঙালিকে দাবায় রাখা যায়নি। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। খাদ্যের জন্য বাংলাদেশকে অন্যের কাছে ভিক্ষা চাইতে হয় না, হাত পাততে হয় না।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওয়াদা করেছিলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব। আমরা তা করেছি। বাকিদের বিচারকাজ চলছে। যত চেষ্টাই করুক, কেউ এই যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে পারবে না।’
শনিবার বিকেলে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের উত্তর মেদেনীমণ্ডলের খানবাড়িতে আয়োজিত জনসভায় তিনি এ কথা বলেন। দুপুরে স্বপ্নের পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী এ সভায় যোগ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ সেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করলাম। এ সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ আরো সহজ হয়ে যাবে। ২০০১ সালেই আমরা এ কার্যক্রম শুরু করি। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সরকার এসে তা বন্ধ করে দেয়।
বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ হাতে নিলে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। আমরা প্রমাণ চাইলাম, তারা প্রমাণ দিতে পারেনি। তখন বলেছিলাম, আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, নিজ অর্থায়নেই সেতু নির্মাণ করবো। আমরা বীরের জাতি জাতি কথা রেখেছি, নিজেদের অর্থায়নেই কাজ শুরু করেছি।
প্রধানমন্ত্রী শনিবার সকালে প্রথমে হেলিকপ্টারযোগে শরীয়তপুরের জাজিরায় পৌঁছান। বেলা ১১টা ১৬ মিনিটে নাওডোবায় পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নদী শাসনের কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সেখানে সুধী সমাবেশেও বক্তব্য রাখেন তিনি।
পরে বেলা ১২টা ৫৭ মিনিটে মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পাইলিংয়ের সুইচ অন করার মাধ্যমে মূল সেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন তিনি।
সেখান থেকে ফিরে মুন্সীগঞ্জের মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১ সালে যেভাবে পাকিস্তানী হায়েনারা মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছিল, ঠিক তেমনিভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট মানুষকে পুড়িয়ে মারার ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষের কল্যাণ তারা করে না, তারা তা চায়ও না। তারা লুটপাট, দুর্নীতি করতে পারে।’
তিনি বলেন, গত জানুয়ারির আন্দোলনের সময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেছেন।
‘তারা (বিএনপি) বলে, তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের নেতারা যদি মানুষ পুড়িয়ে মারে, তাদের নামে মামলা হবে না? খালেদা জিয়া কী চান, তাদের কি ফুলের মালা গলায় দিয়ে পূজো করতে হবে? এটা হবে না।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানুষ পোড়ানোর জন্য যারা হুকুমদাতা, অর্থ সংস্থানকারী, পরিকল্পনাকারী- তাদের প্রত্যেকের বিচার এই বাংলার মাটিতে হবে। মানুষের জীবন নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেব না।’
বিএনপির কারণেই পদ্মা সেতু প্রকল্প বিলম্বিত হয়েছে। এই দল কল্যাণ করতে ‘পারে না’, ধ্বংস ‘ডেকে আনে’। তারা বাংলাদেশকে ‘অকার্যকর রাষ্ট্র’ বানাতে চায়, বলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
তিনি আরো বলেন, ‘২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৯৩ দিন বেগম জিয়া তার অফিসে ছিলেন, আওয়ামী লীগকে নাকি ক্ষমতাচ্যুত না করে ঘরে ফিরবেন না। আন্দোলনের নামে মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছে খালেদা জিয়া, তার হুকুমে তার দলের ক্যাডাররা ট্রাকে, বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে।’
বিএনপি নেতৃত্বের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ তাদের মুখ থেকে নির্বাচন নিয়ে কথা শুনতে হয়। তাদের সংগঠনই তো অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী, তারা আবার বৈধ কাজ করে কীভাবে? তাদের সব কাজই অবৈধ।’
‘আওয়ামী লীগের লক্ষ্য মানুষের সেবা করা, মানুষকে পুড়িয়ে মারা নয়’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন করেছি বলেই আমরা উন্নয়নে কাজ করতে পারছি। পদ্মাসেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পও এখন বাস্তবায়নের পথে।’
প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এমনভাবে উদযাপন করা হবে, যেখানে বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত এবং দারিদ্রমুক্ত।’
২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন- শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, খাদ্যমন্ত্রী অ্যডভোকেট কামরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-আলম খান লেলিন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, মাহবুব-উল-আলম হানিফ প্রমুখ।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু
রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে সড়কপথে সরাসরি যুক্ত করতে স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার মূলকাজ শুরু হয়ে গেছে। দেড় দশকেরও বেশি সময় আগে পদ্মায় সেতু নির্মাণ নিয়ে স্বপ্নের সূচনা হয়েছিল, সেই স্বপ্ন এবার চূড়ান্ত আকার লাভ করতে যাচ্ছে।
শনিবার শরীয়তপুরের জাজিরায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নদীশাসন এবং পরে মাওয়ায় সেতুর মূল কাজের উদ্বোধন করেন। সেখানেও বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন— বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, পানি সম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর রহমান ও ইকবাল সোবহান চৌধুরী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।
আরো ছিলেন— সেনাপ্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, পুলিশের আইজি শহীদুল হক, চিফ হুইপ আসম ফিরোজ, স্থানীয় সাংসদ সুকুমার রঞ্জন ঘোষ ও সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, দীপু মনি, সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। মাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর এক কিলোমিটার ভেতরে শুরু হয় সাত নম্বর পিলারের মূল পাইলিংয়ের কাজ। এরকম মোট ৪২টি পিলারের ওপর ভর দিয়েই প্রমত্তা নদীর দুই তীরকে যুক্ত করবে পদ্মা সেতু।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে আশা প্রকাশ করেছেন, ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু আগামী তিন বছরের মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া সম্ভব হবে। ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থাও থাকবে সেতুতে।
জাজিরায় নদীশাসন কাজের উদ্বোধনের পর এক সুধী সমাবেশে নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম, আমরা পারি, আমরা তা দেখাব।.. আজ আমরা সেই দিনটিতে এসে পৌঁছেছি।’
এই সেতু নির্মাণ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ‘মিথ্যা অভিযোগ’ এবং নানা বাধা বিপত্তির কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বাঙালি জাতি কারও কাছে মাথা নত করেনি, করবেও না। প্রায় ২৯,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ের এই সেতু দিয়ে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দক্ষিণ জনপদের ২১ জেলা। এ সেতু হলে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ১.২ শতাংশ বাড়বে, প্রতিবছর ০.৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচন হবে বলে আশা করছে সরকার। জাজিরার অনুষ্ঠান শেষে নদীপথে অন্য পাড়ের মাওয়ায় পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। পথে নদীর মধ্যে সাত নম্বর পিলারের পাইলিং কাজের জায়গাটিও দেখেন তিনি। মাওয়ায় সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের পাশে নিয়ে বোতাম চেপে পদ্মা মূল সেতু নির্মাণ কাজের ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি সবার কাছে দোয়া চান, যেন ‘সময়মত’ নির্মাণ কাজ শেষ করা যায়। ১৯৯৮ সালে আওয়ামী সরকার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ই পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা শুরু হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরে পুনরায় পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পে প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকার ঋণ সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে আসে বিশ্ব ব্যাংক। কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে থাকে। ২০১০ সালের জুলাইয়ে সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক-যোগ্যতা দরপত্র মূল্যায়ন করে পাঁচ দরদাতাকে বাছাই করে তা বিশ্ব ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য পাঠানো হলেও সংস্থাটি তা ঝুলিয়ে রাখে।
এরপর পদ্মা সেতুতে ‘সম্ভাব্য’ দুর্নীতির’ অভিযোগ আনে বিশ্ব ব্যাংক। দীর্ঘ টানাপড়েন শেষে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় বিশ্ব ব্যাংক। শেষ পর্যন্ত নকশা অপরিবর্তিত রেখে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের জুনে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানিকে মূল সেতু নির্মাণের কাজ এবং সিনো হাইড্রো করপোরেশনকে নদী শাসনের কাজ দেওয়া হয়।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, প্রকল্পের প্রায় ২৭ শতাংশ কাজ এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। এই সেতু নির্মাণের পাশাপাশি মাওয়া থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত চার লেইনের সড়ক হবে। রাজধানীর বিজয়নগর থেকে ঢাকা-মাওয়া সড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে হবে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার। এছাড়া জাজিরা পয়েন্ট থেকে খুলনা, বেনাপোল, কুয়াকাটা পর্যন্ত চার লেইনের সড়ক নির্মণের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন তিনি।