জীবন ও জীবিকা : জুড়ীতে রং চা বিক্রি করে সংসার চালায় সমছু
বিশ্বজিৎ রায়, কমলগঞ্জ প্রতিনিধিঃ “ঘর ভাঙ্গলেও মন ভাঙ্গেনি হাট-বাজারে ঘুরি আল্লাহর উপর ভরসা করে চা বিক্রি করি ” ঘর নেই, বাড়ি নেই, জায়গা জমিসহ সবকিছু বিলীন হয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ে। সব হারিয়ে আর কি করব, কিছুই করার নেই। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। সব ভেঙ্গে যাক ভাঙ্গুক, তবুও মন ভাঙ্গেনি। পুঁজি নেই, তেমন লেখা পড়া করতে পারি নাই অভাবের তাড়নায়। তারপরও আশা ছাড়িনি। আল্লাহর উপর ভরসা করে পরিবারের ভরন পোষনে শেষ পর্যন্ত স্বল্প পুঁজি নিয়ে রং চা বিক্রি শুরু করে দেই। তাতে সারাদিন যা উপার্জন হয়, তা দিয়ে পরিবার নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনরাত কাটাই। আক্ষেপের সাথে একথাগুলো বলেন, কক্সবাজার থেকে জুড়ীতে আসা ৩৫ বছরের এক যুবক সামছুল হক সমছু। তার মূল বাড়ি কক্সবাজার জেলার পশ্চিম কুতুবদিয়াপাড়া গ্রামে। ওই গ্রামের আবুল বাশারের ৬ সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান সে। বর্তমানে সে স্ত্রী চার সন্তান নিয়ে মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলা সদর জায়ফরনগর ইউনিয়নের জাঙ্গীরাই গ্রামে ষাটশালা বাড়ীতে ২ হাজার টাকা ভাড়ায় ভাড়াটিয়া থাকে। হতভাগা সমছু বিয়ে করেছে ১৩ বছর পূর্বে। তার ২ ছেলে, ২ মেয়ে। তার বাড়ি বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী হওয়ায় ওই সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে বাড়িঘর জায়গা জমিসহ সব বিলীন হয়ে গেছে বহু আগে। ওই সময় সমছু নিরাশ না হয়ে হাল ধরে পরিবারের। ছেলেবেলা থেকেই প্রকৃতির কাছে হার মানার অভ্যাস তার নেই। সে জানে বাঁচতে হলে সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়। বিগত ৪ বছর আগে কক্সবাজার থেকে মৌলভীবাজারের জুড়ীতে তার পরিবার-পরিজন নিয়ে আসে ক্ষুধার তাড়নায় অন্নের সন্ধানে। এখানে এসে কয়েকদিন জুড়ী হাট-বাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাফেরা করে পরিস্থিতি বুঝে সে। পরে ইচ্ছে করে জুড়ী শহরের হাট-বাজারে রং চা বানিয়ে বিক্রি করবে। “যে কথা সে কাজ”। শুরু করে দিল সমছু সে কাজটি। চা-পাতাসহ ১২টি উপাদানের সংমিশ্রনে তার রং চা। শুরু থেকে তার চায়ের খুব কদর। কারণ দেশের অন্যান্য রং চা থেকে ব্যতিক্রম তার রং চা। ওই চায়ের ঘ্রাণ ও স্বাদই আলাদা। স্বল্প দিনেই সমছু’র চা জুড়ী শহরের প্রতিটি হাট-বাজারের চা পিপাসুদের মন জয় করে ফেলে। সরজমিনে জুড়ী শহরের জুড়ী নিউ মার্কেটের সামনে গিয়ে চা-বিক্রেতা সমছুর সাথে কথা হলে, সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, সাংবাদিক সাব (সাহেব) গৃহ হারা হয়ে আজ আমি জুড়ীতে আসছি অন্নের সন্ধানে। কোনো কাজ না পেয়ে বড় পুুঁজি না থাকায় শেষ পর্যন্ত স্বল্প পুুঁজি নিয়ে চা বানিয়ে জুড়ী শহরে হাট-বাজারে ঘুরে ঘুরে তা বিক্রি শুরু করে দেই। সারাদিন যা বিক্রি হয় তার আয় দিয়ে কোনরকমে পরিবার নিয়ে চলি। সে কাজটি করতে প্রথমে তিনটি বড় ফাক্স কিনে। সেগুলো সারিবদ্ধভাবে বাঁশের কাঠিতে বাঁধে। তারপর এগুলোতে চা ভর্তি করে জুড়ী শহরের হাট-বাজারে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে। তোমার রং চায়ের এত কদর কেন জানতে চাইলে, সে বলে, আমি ভালো চা-পাতাসহ ১২টি আইটেম দিয়ে চা বানাই। সেগুলো হলো- চা-পাতা, চিনি, লং, এলাইচ, দারুচিনি, তেঁজপাতা, গুয়ামুরি, জিরা, খেজুর গুড়, আদা, লেবু ও পায়েস পাতা। তাই তার এত কদর। সব খরচ বাদে তার প্রতিদিন ২৫০-৩০০ টাকা আয় হয়। তার এ আয় দিয়ে বাসা ভাড়া, ছেলে-মেয়ের লেখপড়াসহ অন্যান্য খরচ চালিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় বলে সমছু জানায়। বড় পুঁজির অভাবে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে পারছেনা সে। তার বড় মেয়ে তাসলিমা আক্তার জুড়ীর স্থানীয় দক্ষিন জাঙ্গীরাই মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ও দ্বিতীয় মেয়ে সুমি আক্তার স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ২য় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। এমতাবস্থায় দেশের সরকারি, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সংস্থা কিংবা সহৃদয়বান ব্যক্তির কাছে তার ব্যবসার পরিধি বাড়াতে সহযোগিতার আশ্বাস চায় চা বিক্রেতা সমছু।