ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনি : বন্ধ প্রকল্পে চুরির মহোৎসব
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার ট্যাকেরঘাটে দেশের একমাত্র চুনাপাথর খনিজ প্রকল্প। ক্রমবর্ধমান লোকসানের কারণে ১৯৯৬ সাল থেকে বন্ধ প্রকল্পটির সব কার্যক্রম। তখন থেকেই খোলা আকাশের নিচে অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে রয়েছে প্রকল্পটির প্রায় ৬০ কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে এ প্রকল্পের জন্য নির্মিত অবকাঠামোও। এছাড়া এখানকার বৈদ্যুতিক তার, রেললাইন ও মূল্যবান যন্ত্রপাতি চুরির ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। অভিযোগ উঠেছে, চুরির ঘটনায় প্রকল্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত কিছু ব্যক্তির যোগসাজশ রয়েছে। তবে প্রকল্পের ইনচার্জ এসএম আব্দুল হালিম এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তিনি বলেন, এখানে প্রায় ৬০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি রয়েছে। খোলা আকাশের নিচে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা তো নষ্ট হচ্ছে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের কোটি কোটি টাকার স্থাপনা ও মূল্যবান যন্ত্রপাতি পাহারা দেয়ার জন্য রাখা হয়েছে একজন এপিসি ও একজন পিসিসহ মোট ২০ সদস্যের আনসার বাহিনী। অন্যদিকে প্রকল্প তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র একজন কর্মকর্তা। জনবল কম থাকায় কিছু চুরির ঘটনা ঘটছে। তবে তা রুখতে আমরা সচেষ্ট আছি।
১৯৬৬ সালে তাহিরপুর সীমান্তবর্তী মেঘালয় পাহাড়ঘেঁষা ট্যাকেরঘাটে ৩২৭ একর ভূমিতে বাংলাদেশের প্রথম চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয়। শুরু থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রকল্পটি মুনাফায় ছিল।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পেট্রোলিয়াম খনিজ সম্পদ বিভাগ ১৯৮৪ সালে প্রকল্পটি বিসিআইসির কাছে হস্তান্তর করে এবং এর পাঁচ বছর পর বিসিআইসির বোর্ডসভায় তাহিরপুর উপজেলার ট্যাকেরঘাট খনিজ প্রকল্পকে ছাতক সিমেন্ট কোম্পানির সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় পরিচালনায় অব্যবস্থাপনার কারণে ক্রমেই খনিজ প্রকল্পটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ফলে ১৯৯৬ সালে বিসিআইসি খনিজ প্রকল্পটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের উত্তোলন বন্ধ করে ১৯৯৬ সালে ভারত থেকে চুনাপাথর আমদানির মাধ্যমে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এটিকে আমদানি কেন্দ্রে রূপান্তর করে। ট্যাকেরঘাট খনিজ প্রকল্পটিকে আমদানি কেন্দ্রে রূপান্তর করে ছাতক সিমেন্ট কোম্পানির সঙ্গে সম্মিলিতভাবে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু তার পরও এ প্রকল্পে লোকসানের পরিমাণ দিন দিন বাড়তে থাকে। ফলে এখানকার সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময় প্রকল্পে কর্মরত ৩১ কর্মকর্তাকে ছাতক সিমেন্ট কোম্পানিতে বদলি করা হয়। তবে বেকার হয়ে পড়েন সহস্রাধিক শ্রমিক।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন, প্রকল্পের কার্যক্রম শুরুর আগে জরিপে ট্যাকেরঘাটের পাঁচটি কোয়ারিতে ১৩ কোটি ২৫ লাখ ৫৬ হাজার ৫৩৪ টন চুনাপাথরের মজুদ নির্ধারণ করা হয়। তবে প্রকল্প এলাকা থেকে অপরিকল্পিতভাবে চুনাপাথর উত্তোলন করায় মজুদ থাকা সত্ত্বেও বন্ধ হয়ে যায় প্রকল্পটি। খনির গভীরতা ৩৫ মিটারের বেশি থাকার ফলে এ খনি থেকে উত্তোলন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। ফলে ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ৭৮৩ টন চুনাপাথর উত্তোলনের পর প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিকল্পিতভাবে উত্তোলন করলে আরো প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ টন চুনাপাথর সংগ্রহ করা যেত; যা মাটির নিচে এখনো মজুদ আছে। চুনাপাথর খনির জন্য অধিগ্রহণকৃত ৩২৭ একর ভূমির মধ্যে মাত্র ১২০ একর ভূমি খনিজ প্রকল্পের অধীন আছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পটির ইনচার্জ। বর্তমানে পাঁচটি কোয়ারির মধ্যে দুটি রয়েছে, বাকি তিনটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। খনি প্রকল্পের বড়ছড়া বারুতখানায় ৩৩ একর ২০ শতাংশ ভূমি তিন বছরের জন্য বিসিআইসির কাছ থেকে ইজারা নেয় স্বর্ণা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে গড়ে ওঠে কয়লার ডাম্পিং ইয়ার্ড।
এদিকে ১৯৯৬ সাল থেকে এ প্রকল্পের উৎপাদন বন্ধ থাকার ফলে ১৯ বছর ধরে খোলা আকাশের নিচে থাকায় মরিচা পড়ে নষ্ট হচ্ছে প্রকল্পের ৬০ কোটি টাকার মূল্যবান যন্ত্রপাতি। নষ্ট হওয়া যন্ত্রপাতির মধ্যে কয়েকটি খননযন্ত্র, কয়েকটি রেলের বগি, রেললাইন, ওয়াগন রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এছাড়া প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এ প্রকল্পের জন্য নির্মিত আটটি ভবন। অযত্ন-অবহেলায় এসব ভবনের দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ে শ্যাওলা জমেছে।
এ ব্যাপারে ছাতক সিমেন্ট কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসনাত আহমেদ বলেন, সংরক্ষণ না করায় এখানকার বেশির ভাগ যন্ত্রপাতিই নষ্ট হয়ে গেছে বলে শুনেছি। এখনো যেগুলো কার্যকর রয়েছে, সেগুলো কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় এবং নিজেদের কাজে লাগানো যায় বা বিক্রি করা যায়, এ ব্যাপারে আলোচনা করছি।