শিক্ষকদের ছাত্রলীগইতো পেটাবে?

MIR ABDUL ALIMমীর আব্দুল আলীমঃ সংবাদ শিরোনাম-‘ শাবিপ্রবিতে শিক্ষকদের পেটাল ছাত্রলীগ’। ৩১ আগষ্ট সিলেটে ছাত্রলীগ এমন ন্যক্কারজনক কাজটি করেছে। এ আর নতুন কি? শিক্ষকদের ছাত্রলীগইতো পেটাবে? এর আগে বহুবার তারা এহেন কাজ করেছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, চশমার দোকান, মদের দোকান থেকে শুরু করে সর্বত্র ফেৎনা ফ্যাসাদ করা, সাংবাদিক পেটানো, শিক্ষক পেটানো, আর শ্লীলতাহানী ঘটিয়ে তারা বারংবারই প্রমাণ করছে তারা বেশ পারঙ্গম। তারা সর্বশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পিটিয়ে। ভিসির পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনরত সরকার সমর্থিত একাংশের শিক্ষকদের ওপর এ হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময় আন্দোলনরত অন্তত সাতজন শিক্ষক আহত হয়েছেন। এ সময় শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের লাঞ্ছিত ও মারধর করেছে তারা। অবস্থান কর্মসূচিতে চড়াও হয়ে শিক্ষকদের ব্যানারও কেড়ে নেয় ছাত্রলীগ।
ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা ছিল ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদের’। উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে গত ১৩ এপ্রিল থেকে আন্দোলন করে আসছেন শাবিপ্রবি শিক্ষকরা। এর অংশ হিসেবে রোববার সকালে ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ’-এর ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপাচার্য কার্যালয়ে তালা দেওয়ার কর্মসূচি ছিল। শিক্ষকদের এই কর্মসূচিকে ঘিরে রোববার সকাল থেকে উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। সকাল ৮টার দিকে শিক্ষকরাও সেখানে অবস্থান নেন। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক আমিনুল হক ভূইয়া তার কার্যালয়ে প্রবেশের সময় শিক্ষকরা তাকে বাধা দেন। এ সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে অবস্থান নেওয়া ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায় এবং শিক্ষকদের মারধর করে।
প্রশ্ন হলো ছাত্রলীগকে রোধ করা হচ্ছে না কেন? বেপরোয়া ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না খোদ সরকারও। ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির নাম শুনলে মানুষ আঁতকে উঠে। প্রায়ই খবরের শিরোনাম হচ্ছে সংগঠনটি। সংগঠনটির নেতাকর্মীদের সহিংসতায় ছাত্র শিশু, সাংবাদিক, পুলিশসহ নিহত হয়েছে বহু লোক। গত সাড়ে ৬ বছরে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্ব এবং প্রাধান্য বিস্তারে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৩ সহস্রাধিক। লাঞ্ছিত করা হয়েছে অগনিত শিক্ষক ও ছাত্রীকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা এমনকি এসিড নিক্ষেপের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধের মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে সংগঠটির নেতারা। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো এসব ঘটনার কোন বিচার হয় না। ছাত্রলীগের এক সময়ের নেতা ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না এর আগে বলেন, বর্তমান সরকারের যা কিছু অর্জন, তার সবই বিসর্জন দিয়েছে ছাত্রলীগ। জুলুম অত্যাচারের কোন পর্যায়ে গেলে নিজ দলীয় নেতা এমন কথা বলতে পারেন। বলা যায় মহাজোট সরকারের সাড়ে চার বছরের পুরো সময় জুড়েই বেসামাল ছাত্রলীগ। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নিয়েও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের। শেষ মুহূর্তে এসে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নেতাকর্মীরা বেপরোয়া রূপে আবির্ভূত হলেও রাশ টেনে ধরতে পারছে না সরকার।
দেশের বিশেষ মুহূর্তগুলোতে ছাত্রলীগের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই ছাত্রলীগ কৈ? কোথায় আজ বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ছাত্রলীগ? তোফায়েল আহম্মেদদের ছাত্রলীগ কি এরই মধ্যে গুম হয়ে গেছে নাকি? ছাত্রলীগের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস কি কেবলই ইতিহাস? আজ আমরা এ কি দেখছি? রুয়েট, কুয়েট, রাবি, ঢাবি, জাবি নয়, ছাত্রলীগ আর ছাত্রলীগ নামধারীদের দৌরাত্ম্য সারা দেশেই। কিভাবে শিশু অপহরণ করে কোটিপতি হওয়া যায়, কিভাবে শিক্ষকদের মারধর করেও বুক ফুলিয়ে হাঁটা যায়। মানুষকে গরুর মতো পেটাচ্ছে এ সোনার ছেলেরা। শিক্ষক থেকে শুরু করে শিশুরা পর্যন্ত তাদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। সংগঠনটির সোনার ছেলেরা সত্যিই সোনা দিয়ে গড়া! এমন সোনার (!) ছেলেরাই পারে শিক্ষকদের মেরে রক্তাক্ত করতে এবং তা এই সোনার দেশেই সম্ভব। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, ফাও মদ না পেয়ে মদের বারে ভাঙচুর, হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তারের ওপর হামলাসহ নানাভাবে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ। দেশব্যাপী তান্ডব চলছে তো চলছেই। হেন অস্ত্র নেই যা তারা প্রদর্শন করে না। গোলাগুলি ও বোমা বিস্ফোরণে ঘটনা ঘটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। নেপথ্যে সেই ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তার। এসব ঘটনায় অবশ্য ২/১ জনকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কার আগেও হয়েছে। কিন্তু থামানো যাচ্ছে কি ছাত্রলীগের এ বেপরোয়া গতি? ছাত্রলীগের ব্যাপ্তি ও ভয়াবহতায় ক্ষণে ক্ষণে মনের ভেতর একটি প্রশ্নই জেগে ছাত্রলীগ কি অপতিরোধ্য?
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় ছাত্রলীগ। লক্ষ্য ছিল শান্তি ও প্রগতির চাকা এগিয়ে নেওয়ার। ৬৪ বছর পর দেখা গেল ভূতের মতো তারা কেবল পেছনের দিকেই হাঁটছে। আগের বছরের অগ্রগতি ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে পরের বছরের নানা অপকর্ম। আগের মেয়াদের সব অর্জন ম্লান হয়ে যায় পরের মেয়াদের প্রবল মাস্তানিতে। এখন ছাত্রলীগের সন্ত্রাস-মাস্তানি নিয়ে যাঁরা আফসোস করছেন, আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, আগামী বছর তাঁদের সেই আক্ষেপ আর থাকবে না। কেননা, তখন সংগঠনটির সন্ত্রাস-লুটপাট বর্তমানকে অনেক গুণ ছাড়িয়ে যাবে। পাঠক তখন মনে মনে বলবেন, আহ! আগের বছরটি কত না ভালো ছিল! এ কথাও সত্যÑ ৬ দফা, ১১ দফা, শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধে এই ছাত্রলীগের অমূল্য অবদান রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক যে, অতীতের সেই গরিমা মুছে ফেলার জন্যই যেন সংগঠনটির বর্তমান নেতাকর্মীরা আদাজল খেয়ে নেমেছে খুন-ধর্ষণ-চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতে। যে ছাত্রলীগ ৬৪ বছর ধরে দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। আজ সেই ছাত্রলীগ নানা কারনে প্রশ্ন বিদ্ধ।
এ মুহুর্তে ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরার বিকল্প নেই। এ সংগঠনের নেতাকর্মী কিংবা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্য সর্বোপরি হত্যাসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তাই নয়; নিজেদের মধ্যেও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। ছাত্রলীগের দানবরুপী লাগামহীন পাগলা ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই। বেপরোয়া ছাত্রলীগের কারনে কমছে সরকার দলের জনসমর্থনও। আর তাই অপ্রতিরোধ্য ছাত্রলীগকে সামাল দেয়া প্রয়োজন। সকল ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে দেশব্যাপী ছাত্রলীগে শুদ্ধিকরণ অভিযান শুরু হোক, সরকারের কাছে এমনটিই প্রত্যাশা।

(লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিষ্ট। [email protected])