ব্রিটেনে পার্লামেন্ট নির্বাচনে ১০ বাঙালির ৯ জনই সিলেটি
লন্ডন প্রতিনিধিঃ ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনের আর মাত্র আড়াই মাস বাকি। ২০১৫ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত হবে এই নির্বাচন। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ নানা পরিকল্পনা আর পলিসির ঝুলি নিয়ে জনগণের দুয়ারে হানা দিচ্ছে, ঠিক একইভাবে বিরোধী লেবার পার্টিও নিজেদের নানা পরিকল্পনার কথা জনগণকে জানান দিচ্ছে। বসে নেই আরো এক অংশীদার লিবডেমও। এই তিন দল এখন মরিয়া আগামী নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসীনের জন্য। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রথমবারের মত ১০ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক মূলধারার তিনটি দল থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। অতীতে মূলধারার দলগুলো থেকে এত সংখ্যক ব্রিটিশ বাংলাদেশি আর কখনো মনোনয়ন পাননি। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমাদের রোশানারা আলী অনেক আগেই নাম লিখিয়েছেন। বেশ সুনামের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন তিনি। রোশনারার পথ ধরেই এবার ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন টিউলিপ সিদ্দিক, ড. রূপা হক, মিনা রহমান, ব্যারিস্টার আনোয়ার বাবুল মিয়া, মেরিনা আহমদ, ফয়ছল চৌধুরী এমবিই, প্রিন্স সাদিক চৌধুরী ও আলী আখলাকুল ইসলামও।
এর মধ্যে রয়েছেন সিলেটের মেয়ে রোশনারা আলী, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার মিরপুর গ্রামে ড. রূপা হক, সিলেটের ছাতক উপজেলায় মিনা রহমান, সুনামগঞ্জের জনগন্নাথপুর উপজেলার মিরপুর গ্রামের ব্যারিস্টার আনোয়ার, সুনামগঞ্জের ছাতকের প্রিন্স সাদিক চৌধুরী, হবিগঞ্জের নবিগঞ্জ উপজেলার বদরদি গ্রামের ফয়ছল চৌধুরী, সিলেটের বিয়ানীবাজারের আশুক আহমদ।
রোশনারা আলী
বাঙালি অধ্যুষিত বেথনাল গ্রিনওবো আসনের বর্তমান এমপি রোশনারা আলী। লেবার পার্টি তাকে আবারো মনোনয়ন দিয়েছে। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যান রোশনারা। সিলেটের বিশ্বনাথের ভূরকী গ্রামে ১৯৭৫ সালে জন্ম নেয়া রোশনারা মাত্র ৭ বছর বয়সে বাবা-মার সঙ্গে ব্রিটেনে এসেছিলেন। ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ানের মতে রোশনারা আলী যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলমান মহিলাদের মধ্যে অন্যতম। রোশনারা একদিকে রাজনীতিবিদ, অন্যদিকে অন্যন্য এক সমাজকর্মী হিসেবেও নিজেকে সর্বদা নিবেদিত রেখেছেন। লন্ডনের ইস্টএন্ডে বড় হওয়া রোশনারার স্কুল জীবন কেটেছে টাওয়ার হ্যামলেট এর ম্যালবেরি গালর্স হাই-স্কুলে, পড়েছেন বিশ্বখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ডে। সেখানে তিনি দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন। লেবার পার্টি হয়ে শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক শ্যাডো মিনিস্টারের ভূমিকা পালন করেন। রোশনারা আলী সেপ্টেম্বর মাসে ইরাকে সামরিক হামলার প্রতিবাদে লেবারপার্টি সমর্থন দেয়ায় স্যাডো মন্ত্রী সভা থেকে পদত্যাগ করেন। আগামী নির্বাচনেও তিনি নির্বাচিত হবেন এমনটি আশা রয়েছে বাঙালিদের।
টিউলিপ সিদ্দিক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক। ২০১৫ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন লাভ করেছেন। ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলে প্রথম বাঙালি নারী কাউন্সিলার টিউলিপ সিদ্দিক। এই আসনের বর্তমান এমপি বিখ্যাত অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন অবসর নিয়েছেন। লেবার পার্টির এমপি হিসেবে গ্লেন্ডা দীর্ঘ দিন দায়িত্ব পালন করেন। টিউলিপ মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হন। বর্তমানে টিউলিপ ক্যামডেন বারার রিজেন্টস পার্ক ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ক্যামডেন কাউন্সিলের কমিউনিটিজ অ্যান্ড কালচারাল কেবিনেট মেম্বার। টিউলিপ দক্ষিণ পশ্চিম লন্ডনের মেরটন কাউন্সিলের মিটচাম এলাকায় ১৯৮২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ, ব্রুনাই, ভারত, সিঙ্গাপুর, স্পেনে বাল্যকাল কাটিয়েছেন। পশ্চিম লন্ডন থেকে ১৯৮৮ সালে তিনি উত্তর লন্ডনে চলে আসেন এবং এ-লেভেল সম্পন্ন করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডন থেকে ইংরেজি সাহিত্যের ওপর আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি ও কিংস কলেজ অব লন্ডন থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১১ সালে তিনি পলিটিক্স, পলিসি অ্যান্ড গভর্নমেন্টের ওপর দ্বিতীয় বারের মতো মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।
ড. রূপা হক
ড. রূপা আশা হক পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশিওলজির শিক্ষক। শিক্ষকতা করছেন লন্ডনের কিংস্টন ইউনিভার্সিটিতে। পিএইচডি করেছেন কালচারাল স্টাডিজের উপর। রূপার বাবা-মা ১৯৬০ সালে সিলেট থেকে ব্রিটেনে গিয়েছিলেন। রূপা হক ১৯৯১ সালে লেবার পার্টির সদস্য হন। তখন থেকে তিনি বিভিন্ন নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থীদের জন্য ক্যাম্পেইন করে আসছেন। রূপা ব্রিটেনের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক গার্ডিয়ান, সানডে অবজারভার ও ট্রিবিউন পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। ২০১০ সালে তিনি লন্ডন বার অব ইলিংয়ের ডেপুটি মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। ইলিং সেন্ট্রাল ও একটন সংসদীয় আসন থেকে লেবার দলের পক্ষে পার্লামেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মনোনয়ন লাভ করেন রূপা। রূপা হকের ছোট বোন কনি হক বিখ্যাত বিবিসি প্রোগ্রাম ব্লপিটারের একজন জনপ্রিয় উপস্থাপিকা। রূপা হকের পৈতৃক বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার মিরপুর গ্রামে।
মিনা রহমান
মিনা রহমান খুব ছোটবেলায় মাত্র ২১ দিনের শিশু অবস্থায় বাবা-মায়ের সঙ্গে ব্রিটেনে আসেন। কনজারভেটিভ পার্টি থেকে একমাত্র বাঙালি এমপি প্রার্থী মিনা রহমান। লন্ডনের বাকিং আসন থেকে লড়ছেন মিনা। এ আসনে লেবার পার্টির এমপি রয়েছেন। ব্রিটেনের স্কুল জীবন শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেন তিনি। বর্তমানে পূর্ব লন্ডনের একটি হাউজিং কোম্পানির ম্যানেজারের দায়িত্বে আছেন। তিনি ২ কন্যা ও ২ পুত্রের জননী। সিলেটের ছাতক উপজেলায় মিনা রহমানের জন্ম।
মেরিনা আহমদ
লন্ডনের বেকেনহাম নির্বাচনী আসন থেকে লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন ব্যারিস্টার মেরিনা আহমদ। ৩০ বছর থেকে লেবার পার্টির সদস্য মেরিনা আহমদ। মাত্র ৬ মাস বয়সে বাবা-মার সঙ্গে ব্রিটেনে আসেন মেরিনা। মেরিনা ইউনিভার্সিটি অব সারে থেকে ইংরেজি ও ইতিহাসে বি এ অনার্স ডিগ্রি নেন। পরবর্তীতে ইউনিভার্সিটি অব বাথ থেকে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের ওপর পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমা এবং সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা ইন ল’ অর্জন করেন তিনি। ইনস অব কোর্ট স্কুল অব ল’ থেকে বার পরীক্ষায় অংশ নেন মেরিনা। দুই সন্তানের জননী মেরিনা আহমদ।
ব্যারিস্টার আনোয়ার
নর্থহ্যামটন শহরে বেড়ে ওঠা ব্যারিস্টার আনোয়ার বাবুল মিয়া লন্ডনের অদূরে ওয়েলউইন অ্যান্ড হাটফিল্ড আসন থেকে লেবার পার্টির প্রার্থী। ব্যারিস্টার আনোয়ার ১৯৯৮ সালে ব্যারিস্টার হন। লন্ডনের বিখ্যাত চ্যান্সেরি লেইনে আনোয়ার বাবুল মিয়ার চেম্বার রয়েছে। আনোয়ার বাবুলের বাবার বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট আছে নর্থহ্যামটনে। বর্তমানে তার ভাইরা ব্যবসা দেখাশুনা করছে। আনোয়ার বাবুল ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের সংগঠন ইউকেবিসিসিআইয়ের একজন পরিচালক। বাবুলের বাড়ি সুনামগঞ্জের জনগন্নাথপুর উপজেলার মিরপুর গ্রামে।
প্রিন্স সাদিক চৌধুরী
নর্থহ্যামটন সাউথ আসন থেকে লিবডেম প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন প্রিন্স সাদিক চৌধুরী। ১৯৭১ সালে শিশু বয়সে বাবা-মার সঙ্গে ব্রিটেনে এসেছিলেন সাদিক চৌধুরী। ২০০৭ সালে লিবডেম থেকে নর্থহ্যামটন শায়ারে একমাত্র বাঙালি কাউন্সিলর নির্বাচিত হন সাদিক। তিনি লিবডেমের সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে জড়িত। ব্যবসার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত হয়ে পড়েন কমিউনিটির নানা উন্নয়নমূলক কাজে। একজন কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট সাদিক চৌধুরী ওয়েস্ট নর্থহ্যামটন শায়ার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের কমিটি মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নর্থহ্যামটন কলেজ, নর্থহ্যামটন ক্রিকেট ক্লাব ইত্যাদির উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন সাদিক চৌধুরী। তিনি বিভিন্ন চ্যারিটি কাজের সঙ্গে জড়িত। নর্থহ্যামটন জেনারেল হাসপাতালের জন্য তিনি ৫ হাজার পাউন্ড সংগ্রহ করে ব্যাপক প্রশংসিত হন। সাদিক চৌধুরীর বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতকে।
ফয়ছল চৌধুরী
হবিগঞ্জের নবিগঞ্জ উপজেলার বদরদি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ফয়ছল চৌধুরী। পরিবারের সঙ্গে ৭ বছর বয়সে তিনি ব্রিটেনে আসেন। প্রথমে ম্যানচেস্টার ও পরে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় নিবাস গড়েন। ২০০৪ সালে তরুণ বয়সেই ব্রিটিশ রাণী কর্তৃক ‘এমবিই’ খেতাবে ভূষিত হন। বাবার অসুস্থতার কারণে বড় ছেলে হিসাবে পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে তরুণ বয়সেই পারিবারিক ব্যবসা বারান্দা রেস্টুরেন্ট পরিচালনার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি লেবার পার্টি থেকে এমপি পদে লড়বেন।
আলী আখলাকুল
জন্মলগ্ন থেকেই লুটন শহরেই বসবাস করছেন আলী আখলাকুল ইসলাম। বয়স ৩৮ বছর। পড়ালেখা করেছেন ডেনবিগ হাই স্কুলে। তরুণ রাজনীতিবিদ আখলাকুল ইসলাম ১৯৬০ সালে পরিবারের সঙ্গে ব্রিটেন আসেন। সারের রায়গেইট ও বানস্টেড আসনে লেবার পার্টির অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে বেশ প্রতিযোগিতা করেই মনোনয়ন পেতে হয়েছে বলে জানান আলী আখলাকুল ইসলাম।
আশুক আহমদ
লুটন শহরের বাসিন্দা আশুক আহমদ লিবডেম থেকে এমপি পদে মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি লুটন সাউথ থেকে প্রার্থী হয়েছেন। দীর্ঘ ৩৫ বছর থেকে লুটন শহরের বসবাস করছেন আশুক আহমদ এমবিই। উচ্চ শিক্ষিত আশুক আহমদ ২০০৯ সালে ব্রিটিশ রানী কর্তৃক ‘এমবিই’ খেতাবে ভূষিত হন। আশুক আহমদের নির্বাচনী এলাকায় ১০ হাজারের বেশি বাঙালি ভোটার রয়েছে। তাই নির্বাচনে জয়লাভের ব্যাপারে আশাবাদী আশুক আহমদ। আশুকের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারে।