ত্রিমুখী চাপে বিএনপি, ঝড়ের পূর্বাভাস!

bnp logoডেস্ক রিপোর্টঃ ঘোষিত কমিটি নিয়ে বিএনপিতে অস্থিরতার পাশাপাশি জমে উঠেছে স্থায়ী কমিটিসহ অন্যান্য কমিটি ঘোষণা করতে দেরি হওয়ার ক্ষোভ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ঘোষিত কমিটি নিয়ে দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের অসন্তোষ। ঢাকায় তার অনুসারীরা ওই অস্থিরতাকে আরও উস্কে দিচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশের আশঙ্কা- এই ত্রিমুখী অস্থিরতা যে কোনও সময় ঝড়ে রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে গুলশান কার্যালয়ে বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কারণ বিএনপিতে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে, চেয়ারপারসন মূলত দুই ব্যক্তির সহায়তা নিয়ে কমিটি গঠন করছেন। এদের একজন হলেন তার বিশেষ সহকারী শামসুল ইসলাম শিমুল বিশ্বাস, অন্যজন নবনিযুক্ত সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ।
শিমুল বিশ্বাসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত দলের সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপুর ব্যাংক হিসাবে সম্প্রতি সাড়ে চার কোটি টাকা লেনদেনের ঘটনা ফাঁস হওয়ায় পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে- পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের সঙ্গে ওই লেনদেনের যোগসূত্র থাকতে পারে।
শিমুল বিশ্বাস রাতে গুলশান কার্যালয়ে বসেন এবং দিনে খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসায় থাকেন। আবার কমিটি ঘোষণার ব্যাপারে রিজভীর কাছে খালেদার নির্দেশনাও যায় শিমুলের মাধ্যমে। রিজভী ও শিমুলের সখ্যের বিষয়টিও বিএনপিতে এখন আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। খবর পাওয়া গেছে, লন্ডনে বসে খোদ তারেক রহমানই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন ওই দু’নেতার ওপর। একইসঙ্গে ওই দুই নেতার বিরুদ্ধে ক্রমেই তৎপর হয়ে উঠছেন পদপ্রত্যাশীদের পাশাপাশি পদবঞ্চিত নেতারাও। ভেতরে ভেতরে তারা একাট্টা হচ্ছেন। এরইমধ্যে গুলশান কার্যালয়ে ক্ষোভের প্রকাশও ঘটে গেছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৩ এপ্রিল শনিবার স্থায়ী কমিটির প্রবীণ নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গুলশান কার্যালয়ে ঘোষিত কমিটির ব্যাপারে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কুমিল্লা বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আউয়াল খানের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব লোককে কারা কীভাবে মনোনয়ন দিয়েছেন তা জানা দরকার। কারণ মনোনয়ন বাণিজ্য করে ওই নেতা গাড়ি কিনেছেন বলে ইতোমধ্যে মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে। তাছাড়া গত উপজেলা (দেবীদ্বার) নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
এর একদিন আগে বরিশাল বিভাগে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে বিলকিস শিরিনকে ও ফরিদপুর বিভাগে শামা ওবায়েদকে মনোনয়ন দেওয়ার ঘটনায় চেয়ারপারসনের কাছে গিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন মহিলা দলের নেত্রী শিরিন সুলতানা ও রেহেনা আক্তার রানু। খালেদা জিয়া তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেও পারেননি। রানুকে ফেনীতে তার নিজের আসন থেকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলে থামানোর চেষ্টা করেন খালেদা। কিন্তু রানু তাতে খুশি হননি। জানা গেছে, এ ঘটনার পর থেকে খালেদা জিয়া সহচর হিসেবে হাত ধরার জন্য মহিলা দলের আরেক নেত্রী সুলতানা আহমেদকে ডেকে আনেন, এতদিন যে কাজটি করতেন শিরিন সুলতানা।
গত ৩০ মার্চ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে পূর্ণ মহাসচিব এবং ছয় যুগ্মমহাসচিবকে ডিঙিয়ে রিজভীকে সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব করা হয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত তিনিই সংবাদ সম্মেলন করে কমিটির আরও দুই অংশ (৭ যুগ্মমহাসচিব, ৯ সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ২০ সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ) ঘোষণা করেছেন। এমনকি ৩০ মার্চে মহাসচিব, সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব এবং কোষাধ্যক্ষের পদও ঘোষণা করেন রিজভী। তিন জায়গাতেই মহাসচিব ছিলেন অনুপস্থিত। এর ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়, কমিটি গঠনে ফখরুলের কোনও কর্তৃত্ব নেই। সব কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা রিজভীই ভোগ করছেন। আর পেছন থেকে তাকে চালাচ্ছেন শিমুল বিশ্বাস।
শিমুল-রিজভী জুটির বিরুদ্ধে কমিটি গঠনের এই অভিযোগ হালে আরও পানি পায় সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে খালেদার দৃশ্যমান কোনও যোগাযোগ না থাকায়। কারণ কমিটি গঠনের ব্যাপারে মহাসচিব ফখরুলসহ সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ তিনি চাননি। অনেকের মতে, শিমুল ও রিজভী খালেদা জিয়াকে এমনভাবে ‘বায়াসড’ করেছেন, যেন তারা দু’জন ছাড়া বিএনপিতে আর কোনও নেতা বিশ্বস্ত নন। ফলে ফখরুলসহ সিনিয়র নেতারা একদিকে ইচ্ছা করে গুলশান কার্যালয়ে যাচ্ছেন না। আবার খালেদা জিয়াও তাদের ডাকছেন না।
পাশাপাশি মহাসচিব ফখরুল এবং স্থায়ী কমিটির প্রবীণ নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ সিনিয়র নেতাদের কাছে কমিটি গঠনের কথা জানতে চাইলেই তারা স্পষ্ট বলে দিচ্ছেন, কোথায় কীভাবে কমিটি গঠন হচ্ছে এ বিষয়ে তাদের ন্যূনতম কোনও ‘ধারণা নেই’।
‘ধারণা নেই’ এ কথাও সত্য। কারণ তারা কেউ জানছেন না কারা থাকছেন কমিটিতে। সূত্রমতে, এভাবেই ওই দুই নেতার ক্ষমতা সম্পর্কে নেতাকর্মীদের মধ্যে ধারণা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে। ফলে তারা সবাই ক্ষুব্ধ হচ্ছেন।
এদিকে, রিজভী ক্ষমতাবান হয়ে ওঠায় ফখরুল সমর্থকদের পাশাপাশি আস্তে আস্তে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সিনিয়র নেতা। তাদের ধারণা- কুপরামর্শ দিয়ে রিজভী ও শিমুলই স্থায়ী কমিটি গঠন ঠেকিয়ে রাখছেন। এতে তারা অসম্মানিত বোধ করছেন এবং ভেতরে ভেতরে ফখরুলকে এর প্রতিবাদ জানাতে বলছেন।
ফখরুল যদিও সামগ্রিক পরিস্থিতিতে খুবই রুষ্ঠ; তবুও মহাসচিব হিসেবে কিছুটা কৌশলী অবস্থান নিতে বাধ্য হচ্ছেন। সবাইকে তিনি ধৈর্য্য ধরতে বলছেন। কিন্তু ইতোমধ্যে মহাসচিব হিসেবে তার মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বলা হচ্ছে, ফখরুলের চেয়ে রিজভী ক্ষমতাবান। আবার ছয় যুগ্মমহাসচিবকে ডিঙিয়ে তাকে সিনিয়র করায় আগেই ওই ছয়জন ক্ষেপে আছেন রিজভীর ওপর। সব মিলিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি একক আধিপত্য বিস্তার করায় গুলশান কার্যালয়ের প্রভাবশালী অন্য কর্মকর্তারাও শিমুলের বিরুদ্ধে সুযোগ খুঁজছেন। আড়ালে কলকাঠি নাড়া শুরু করেছেন তারাও।
জানতে চাইলে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পদ-পদবী নিয়ে দলের মধ্যে কোনও অস্থিরতা নেই বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপির মতো বড় একটি দলে পদ নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকা স্বাভাবিক। এটিকে নেতত্বের প্রতিযোগিতা বলা যায়। তবে কমিটি গঠন নিয়ে আমার কাছে কোনও খবর নেই।’
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘স্থায়ী কমিটি কবে দেওয়া হবে জানি না। তবে যত তাড়াতাড়ি দেওয়া হবে ততোই দলের জন্য মঙ্গল।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পদবী নিয়ে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের মতো দলে সব সময়ই কিছু না কিছু অসন্তোষ থাকে। সময় হলে এগুলো আবার দূর হয়ে যায়।’
সাবেক যুগ্মমহাসচিব মোহম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘রিজভী আহমেদ কমিটির ঘোষণা দিচ্ছেন বলে হয়তো সবাই মনে করতে পারেন, কমিটি গঠনেও তার ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু তা কতখানি সত্য আমি জানি না।’