উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড- গণতন্ত্র ও সুশানের বিকল্প নয় : কর্নেল অলি

colonel oliলিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল অলি আহমদ বীরবিক্রম বলেছেন, দেশের বর্তমান অবস্থা ভয়াবহ ও ভীতিকর। দেশ অনিশ্চিয়তা এবং নিরুদ্দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কারও মনে শান্তি নাই, স্বস্তি নাই, যাওয়ার কোন জায়গা নাই। শুধু পকেটে কিছু টাকা আর পেটে ভাত থাকলে হয় না, প্রয়োজন মানসিক শান্তি এবং দেশে শাস্তি। এক কথায় বলতে গেলে সকল সমস্যার সমাধান হল, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ। প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা পরিহার করে, প্রতিশোধের রাজনীতি/আচরণ বন্ধ করে, বর্তমান অস্বস্থিকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

তিনি আজ (২০ এপ্রিল) স্বস্ত্রীক পবিত্র ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রাক্কালে উপস্থিত পার্টির নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে এ কথা বলেন।

কর্নেল অলি বলেন, মেরুদন্ডহীন ও সরকারের আজ্ঞাবহ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য একজন নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন যে, তারাও অসহায়। সুতরাং এই অবস্থায় সুষ্ঠ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করাটাই হবে অবাস্তব। কারণ বিগত প্রায় দুই বৎসর যাবৎ অধিকাংশ এলাকায় দিনের বেলা নির্বাচন হয় নাই। নির্বাচনের সময় সরকারী বাহিনী দ্বারা ব্যালট পেপার ব্যালট বাক্সে ঢোকানো হয়েছে, হয়তো রাতের অন্ধকারে অথবা দিনের বেলা বন্দুকের নলের ইশারায়। এতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে ঐ সমস্ত এলাকায় নির্বাচনের দায়িত্বরত অসাধু ও নীতিহীন কিছু সরকারী কর্মকর্তারা। কারণ এরা আল্লাহ্কে ভয় পায় না। মনুষ্যত্ব বলতে তাদের মধ্যে কিছুই নাই। ভোটারদের ভোট প্রয়োগ করার অধিকার খর্ব করা হয়েছে। হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে, ভোটার আই.ডি. কার্ড করা হয়েছে, অথচ ভোটের সময় এই আই.ডি. কার্ডের কোন মূল্য নাই। এছাড়াও অতিসম্প্রতি ভোটে জয়লাভ করার জন্য প্রকাশ্যে ব্যবহƒত হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র এবং গুন্ডা বাহিনী। তাও আবার সরকারী বাহিনীর ছত্রছায়ায়। বর্তমানে জনগণের ভোটের কোন মূল্য নাই। ফলে জনগণ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসছে না। বহু এলাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে। ফলে সমাজের অবাঞ্চিত, মাস্তান ও অস্ত্রবাজরা হয়ে উঠছে দেশের চালিকা শক্তি। ধীরে ধীরে মানুষ অসহায় হয়ে, রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে, কারণ তারা হাতাশা, নিরাপত্তাহীনতা এবং আস্থাহীনতায় ভূগছে। অন্যদিকে সরকারের বদ্ধ ধারণা, তারা দেশে বিপুল উন্নয়নমূলক কর্মকা- পরিচালনা করছে। সুতরাং জনগণ তাদের সাথেই আছে। সরকারের বুঝা উচিত, উন্নয়নমূলক কর্মকা- ‘গণতন্ত্র এবং সুশাসনের’ বিকল্প হতে পারে না।
তিনি বলেন, বিগত কয়েক মাসে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৫০ জনের উর্ধ্বে নিহত এবং হাজারের অধিক মানুষ আহত হয়েছে। সংবাদ পত্রে দেখেছি, প্রধান নির্বাচন কমিশনারও স্বীকার করেছেন, তার কথা পুলিশ ও প্রশাসন শুনে না। অবাধ, সুষ্ঠু এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন ভোটারদের আই.ডি. কার্ডের নম্বর ব্যালট পেপারের পিছনে এবং ব্যালটের কাউন্টার ফাইলে লেখার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা। অন্যথায় ঐ ব্যালট পেপার বাতিল বলে গণ্য করতে হবে। এছাড়াও বর্তমানে যেকোন উপজেলা সদর থেকে ঐ এলাকার ভোট কেন্দ্রগুলিতে যাওয়ার জন্য সর্বাধিক এক ঘন্টার বেশি সময়ের প্রয়োজন নাই। সুতরাং নির্বাচনের পূর্ব রাত্রির পরিবর্তে, নির্বাচনের দিন ভোর ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রের জন্য ব্যালট পেপার পাঠানোর ব্যবস্থা করা যায়। এতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তৃতীয়ত, এক মাস ব্যাপী বিভাগওয়ারী নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা কোথায়। তবে ফলাফল একই দিন একই সময়ে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা যায়। তাহলে জালভোট দেওয়ার কোন সুযোগ থাকত না। এত প্রাণহানী ও হতাহতের ঘটনাও ঘটত না। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হত এবং তাদের পছন্দের উপযুক্ত প্রার্থীরাই নির্বাচিত হত। গণতন্ত্র সুসংহত ও শক্তিশালী হত। দেশে শান্তি বিরাজ করত এবং উন্নমূলক কর্মকা-ে গুন্ডাদের হস্তক্ষেপ হত না। বরং ত্বরান্বিত হত। সর্বত্র আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হত।
কর্নেল অলি বলেন, দেশে আজ চরম অরাজকতা বিরাজ করছে, যত্রতত্র প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি চলছে, গোলাগুলি, গুম, গুপ্তহত্যা, সরকারী জমি দখল, ফুটপাত দখল নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, দূর্ঘটনা, শিশু অপহরণ, বলাৎকার, খাদ্য-দ্রব্যে ভেজাল, বিচার বিভাগকে বিতর্কিতকরণ এবং সর্বোপরি নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের অংগ সংগঠন হিসাবে ব্যবহƒত হচ্ছে। কিছু কিছু সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী সরকারী দলের সদস্য হিসাবে নিজকে পরিচালিত করছে, ফলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও জবাবদিহিতারও কোন বাধ্যবাধকতা নাই। মানুষের জীবনের কোন মূল্য নাই। সততার সাথে কাজ করে জীবন যাপন করা বর্তমানে মহাপাপে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও সরকার জোরপূর্বক, যেভাবে দেশের শাসন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, অনুরূপভাবে সর্বত্র তাদের নেতা/কর্মীরাও সরকারী এবং অসহায় মানুষের জায়গা দখল, ব্যবসা ও টে-ার নিয়ন্ত্রণসহ ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষের উপর জুলুমের মাত্রা অনেকগুণ বৃদ্ধি করেছে। বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। নিঃসন্দেহে দেশে লক্ষ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কর্মকা- হচ্ছে, অথচ গণতন্ত্রের ভীত এবং সুশাসন নিশ্চিত করার কোন প্রচেষ্টা নাই। বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা রাজনৈতিক মামলা, হয়রানি, নির্যাতন ও প্রতিশোধ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা আমাদের কারো জন্য কখনো সুখকর হবে না। কারণ কোন সরকারই শেষ সরকার নয়। চিরস্থায়ী নয়।
তিনি আরো বলেন, বিগত ৭-৮ বছরে শত শত রাজনীতিবিদ, অবসর প্রাপ্ত/বর্তমানে সরকারী চাকুরীরত বড় বড় অনেক কর্মকর্তারা নিজ নামে বা তাদের ছেলে/মেয়েদের নামে, স্ত্রীর নামে অথবা অন্য নামে বিদেশে কয়েক লক্ষ হাজার কোটি পাচার করেছে। বিদেশে বাড়ী খরিদ করেছে, স্বনামে/বেনামে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করছে। বিদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বসে আছে, প্রয়োজনের খাতিরে শুধু দেশে থাকে। সরকারী/ বেসরকারী/বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে রাষ্ট্রদ্রোহীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত শেয়ার কেলেংকারীর সাথে জড়িত অথবা ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎকারীসহ, হলমার্ক, ডেসটিনি, যুবক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ইত্যাদির কারো বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নাই। হয়তঃ সরকার অসহায় অথবা তাঁদের কর্তাব্যক্তিরা জড়িত। শুধু গরীবদের পিঠে এবং পেটে লাথি মারা হচ্ছে, তাদের জেল-হাজতে দেওয়া হচ্ছে। বিদেশে টাকা পাচারকারীদের কেন তথ্য প্রমাণসহ নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না? কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? কারণ এরাই হলেন বর্তমানে বিভিন্ন দল/দেশের হর্তাকর্তা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরাই হল রাষ্ট্রদ্রোহী ও দেশের মানুষের শত্রু। দেশের মানুষ এই ধরণের রাষ্ট্রদ্রোহীদের কাছে কতদূর নিরাপদ। দেশের সম্পদও বা কতখানি নিরাপদ।
দেশের অর্থনীতির অবস্থা হতাশাব্যাঞ্জক। বিগত আট মাসে রাজস্ব ঘাটতি ১৩ হাজার কোটি টাকার উর্ধ্বে, অন্যদিকে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি ৩০% নীচে। প্রকল্পগুলির অগ্রগতি সন্তোষজনক না হওয়ায়, দাতা সংস্থা ও বিভিন্ন দেশ, এই অর্থ বৎসরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার উর্ধ্বে অর্থ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকে অলস টাকা পড়ে আছে, কারণ বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত। শুধু বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ বা ৭ শতাংশে উন্নীত হলে, দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে না। এই বার্ষিক উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে উপকৃত হচ্ছে, দেশের ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ ধনী ব্যাবসায়ীরা, অসাধু কর্মকর্তারা এবং দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা। অবশিষ্ট ৯০ শতাংশ মানুষ অনেক কষ্টে জীবন যাপন করছে।
হয়তো অনেকে ভুলে গেছেন, বর্তমান সরকারের মন্ত্রীরাও লাঠি-সোটা নিয়ে একসময় ১৯৯১ সালের পর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে প্রবেশ করে, মান্যবর বিচারপতিদেরকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে দ্বিধাবোধ করেন নাই। বিগত ২ মাস পূর্বে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত মান্যবর প্রধান বিচারপতিকে সরাসরি বক্তব্যের মাধ্যমে মন্ত্রীদ্বয় তীব্র সমালোচনাও করেন। এছাড়াও ১৯৯৬ সালের প্রথমার্ধে ঢাকা শহর অবরোধ করে রেখেছিলেন। ২০১৪ সালের প্রথমার্ধে সমগ্র দেশে অনেক জ্বালাও পোড়াও হয়েছে। এর জন্য কে বা কারা দায়ী তা এখনও আমাদের কাছে পরিস্কার নয়। ভবিষ্যতে আমরা এই ধরণের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই।
আমরা সকলে শুধু অশালীন গালাগালি, মিথ্যা তথ্য ও বক্তব্য দিয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার কাজে লিপ্ত রয়েছি। নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছি। সমাধানের কোন লক্ষণ নাই, চেষ্টাও নাই। তাই দেশের মানুষ মনে করে, রাজনীতিবিদরা মিথ্যুক, প্রবঞ্চনাকারী, অসভ্য এবং দুর্নীতিবাজ। যুব সমাজকে আমরা কি শিক্ষা দিচ্ছি? আসুন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মিথ্যা পরিহার করে, সত্যের সন্ধানে নিজকে আত্মনিয়োগ করি। আমিত্ব পরিহার করি।
কর্নেল অলি বলেন, এ ধরণের অবস্থা দেখার জন্য বা জীবন যাপন করার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি নাই। আমাদের সকলের উচিত দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে সুষ্ঠ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সুসংহত করা, সুশাসন নিশ্চিত করা। দেশকে এবং ভবিষ্যত প্রজš§কে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা। মনে রাখতে হবে, উন্নয়নমূলক কর্মকা- কখনও ‘গণতন্ত্র ও সুশাসনের’ বিকল্প নয়।