এফবিসিসিআই সহযোগিতা করেনি : ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত
মাঈনুল ইসলাম নাসিম : ২০১৪ সালে ভিয়েতনামের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বানিজ্য যেখানে ছিল ৭৪০ মিলিয়ন ইউএস ডলার, সেখানে গত বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে তা কমে দাড়ায় ৬০০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের কিছু বেশি। এমনিতেই দু’দেশের মধ্যকার ‘ট্রেড ব্যালেন্স’ বরাবরই ছিল বহুগুণে ভিয়েতনামের অনুকুলে তথা ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রফতানী সর্বসাকুল্যে যেখানে মাত্র ৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার , সেখানে হ্যানয়ে দায়িত্বরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. সাহাব উল্লাহ বাইল্যাটেরাল ট্রেডের চলমান সংকট উত্তরণে ঢাকায় বারবার যোগাযোগ করেও কোন সাড়া পাননি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফিবিসিসিআই)-এর কাছ থেকে।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত মো. সাহাব উল্লাহ ১৬ এপ্রিল শনিবার এই প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যিক বিষয়াদি ছাড়াও তুলে ধরেন ভিয়েতনামের সাথে বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নানান দিক। রাষ্ট্রদূত বলেন, “আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে স্ট্রং সাপোর্ট দিয়েছিল ভিয়েতনাম। আমরাও তাদের পুনএকত্রীকেরণের সময় সক্রিয় সমর্থন জানিয়েছিলাম। বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে দুই দেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একে অপরকে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন জানান দিয়ে আসছে বছরের পর বছর। কোনদিন কোন কনফ্লিক্ট হয়নি ভিয়েতনাম-বাংলাদেশ যে কোন ইস্যুতে”।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক সুখকর হলেও ব্যবসা-বানিজ্য আমদানী-রফতানীতে দু’দেশের মধ্যকার চলমান নেতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে বেশ খোলামেলাই কথা বললেন বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বহু বছর কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সচিব পদমর্যাদার এই সিনিয়র কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “ভিয়েতনাম সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আমি বহুবার যোগাযোগ করেছি দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যের অবনতি ঠেকাতে। এখানকার চেম্বারের প্রেসিডেন্ট আমাকে জানিয়েছেন তিনি অনেক চেষ্টা করেও বাংলাদেশের প্রতি ভিয়েতনামের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতে পারছেন না”।
রাষ্ট্রদূত মো. সাহাব উল্লাহ বলেন, “হ্যানয় চেম্বারের প্রেসিডেন্টের পরামর্শের ভিত্তিতে ঢাকায় আমাদের এফবিসিসিআই নেতৃবৃন্দের সাথে আমি যোগাযোগ করি যাতে তারা ঢাকা থেকে একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে ভিয়েতনামে পাঠান, যিনি এখানকার চেম্বারের সামনে প্রয়োজনীয় পেপার তুলে ধরবেন। আমি তাদেরকে এটাও জানিয়েছিলাম, আপনারা কেউ যদি না আসতে পারেন তবে এটলিস্ট কিছু পেপার রেডি করে দিন, যেটা প্রয়োজনে আমিই প্রেজেন্ট করবো। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজ পর্যন্ত আমাদের এফবিসিসিআই থেকে কোন পেপার পাইনি, কোন প্রতিনিধিও এখানে আসেনি”।
বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যানিং কমিশনের সাবেক সদস্য মো. সাহাব উল্লাহ আরো জানান, “ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীদের মাইন্ডসেট এমনিতেই পূর্বমূখী, যার কারণে এরা চায়না, জাপান, কোরিয়া, কাম্বেডিয়া, থাইল্যান্ড ও লাওস থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ইমপোর্ট করে থাকে। ফাস্ট গ্রোয়িং কান্ট্রি হিসেবে ৬.৫ ছিলো এদের গ্রোথ, যা এখন তারা আশা করছে ৭ থেকে ৮ পার্সেন্টে নিয়ে যেতে। এচিভও করছে এরা। ভিয়েতনাম চ্যাপ্টারে বাংলাদেশের স্বার্থ উদ্ধার করতে হলে আমাদের বেসরকারী সেক্টরকেই মূল ভূমিকাটি পালন করতে হবে। সরকার উপদেশ আর বক্তিতা দিয়ে ব্যবসা বাড়াতে পারবে না“। প্রাসঙ্গিক কিছু সম্ভাবনার কথাও জানালেন রাষ্ট্রদূত মো. সাহাব উল্লাহ।
রাষ্ট্রদূত জানান, “আমার অনুরোধের প্রেক্ষিতে অবশেষে চলতি মাসেই ঢাকা থেকে মেট্রোপলিটন চেম্বারের একটি প্রতিনিধিদল হ্যানয় সফরে আসছে, যাতে এফবিসিসিআই এবং বিজিএমইএ-এর সাবেক প্রেসিডেন্টরা অন্তর্ভুক্ত থাকছেন। এটি হতে যাচ্ছে আমাদের জন্য একটি ইমপর্টেন্ট ব্রেকথ্রু। তাছাড়া এ মাসেই প্রায় ১০০ জন ব্যাংকারও বাংলাদেশ থেকে ভিয়েতনামে আসছেন একটি সেমিনারে যোগ দিতে। এই ভিজিটগুলো হয়ে যাবার পর ভিয়েতনাম থেকে বাংলাদেশে ট্রেড ডেলিগেশন নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ দূতাবাস নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে পারবে। বিজনেস রিলেশন ডেভেলপ করতে হলে ট্রেড ডেলিগেশন এক্সচেঞ্জের কোন বিকল্প নেই”।
হাজার দেড়েক বাংলাদেশীর বসবাস মানচিত্রে অনেক লম্বা দেশ ভিয়েতনামে। রাজধানী হ্যানয় থেকে হো চি মিন সিটির দূরত্ব প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার। উত্তরাঞ্চলে তথা রাজধানীতে বাংলাদেশী আছেন মাত্র ১ থেকে দেড়শ‘। অন্যদিকে দক্ষিণে বসবাস ১ থেকে দেড় হাজার বাংলাদেশীর। রাষ্ট্রদূত মো. সাহাব উল্লাহ জানান, “পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজের জন্য দক্ষিণের বাংলাদেশীদের ২ হাজার কিলোমিটার ফ্লাই করে হ্যানয়ে আসতে হয়। তাই আমরা উদ্যোগ নিয়েছি হো চি মিন সিটিতে অচিরেই একটি অনারারি কনসুলেট অফিস স্থাপনের”। বাংলাদেশ থেকে ভিয়েতনামের ভিসা পাবার চলমান কঠিন প্রক্রিয়া শিথিল করতে এখানকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও জানান রাষ্ট্রদূত। ভিয়েতনামের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ লাওসেরও দায়িত্বে আছেন তিনি।
লাওসে যদিও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তেমন কোন বাংলাদেশীর বসবাস নেই, তথাপি অদূর ভবিষ্যতে কৃষিকাজের নিমিত্তে বাংলাদেশ থেকে কর্মীদের লাওসে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার কথা জানান রাষ্ট্রদূত মো. সাহাব উল্লাহ। তিনি বলেন, “আয়তনে বাংলাদেশের সমান হলেও লাওসের জনসংখ্যা মাত্র ১০ লাখ। প্রচুর জমি এখানে পড়ে আছে। বাংলাদেশী কিছু কিছু লোক অনেক জায়গা জমি ইতিমধ্যে লাওসে কিনেছেন। লাওসের লোকেরা এগ্রিকালচারের কাজ খুব একটা জানে না, তাছাড়া শারীরিক পরিশ্রমের কাজ ঠিক ততোটা করতে তারা প্রস্তুত নয়। লাওস সরকারের সাথে আলোচনা করে বলেছি, তোমরা পারমিশন দিলে পরিশ্রমী বাংলাদেশীরা এখানে আসতে পারবে। কৃষিকাজে লাওসে বেতনও ভালো, ৩৫০ থেকে ৫০০ ইউএস ডলার মাসে“। নেগোসিয়েশন চলছে বলে জানান রাষ্ট্রদূত।