প্রতারণার মাধ্যমে হোটেল রিজেন্সি দখল করে আছেন তিন পরিচালক

রিজেন্সি বিনিয়োগকারীদের সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসী বিনিয়োগকারী

Protibad shova 2লন্ডন, ২১ মে : ঢাকা রিজেন্সি হোটেলের যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা তাদের নিজের জীবন, পরিবার এবং বিনিয়োগের নিরপত্তা দাবি করে বলেছেন, হোটেলের তিন পরিচালক কবির রেজা, মুসলেহ আহমদ এবং আরিফ মোতাহার কোনো অর্থ বিনিয়োগ ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে হোটেল দখল করে রেখেছেন। এই তিন পরিচালক নিজেদেরকে হোটেলের ৫২ শতাংশের মালিক বলে দাবি করলেও আজ পর্যন্ত তারা তাদের বিনিয়োগের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। গত ২০ মে মঙ্গলবার পূর্ব লন্ডনের মন্টিফিউরি সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব কথা বলেন। এ সময় প্রায় ৪০ জনের বেশি যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিনিয়োগকারী উপস্থিত ছিলেন। মূলত সদ্য কারামুক্ত রিজেন্সির ভাইস চেয়ারম্যান মুসলেহ আহমদ সম্প্রতি গণমাধ্যমে যে বিবৃতি দিয়েছেন তার প্রতিবাদ এবং সত্য ঘটনা প্রকাশের লক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মুসলেহ আহমদের বিবৃতিকে মিথ্যা এবং বানোয়াট উল্লেখ করে বলা হয়, ঢাকা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজুক) রিজেন্সির ভবনটি বানিয়েছিল। আর তিন উদ্যেক্তা ব্রিটেনে এসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে বিনিয়োগ সংগ্রহ করে ভবনটির ৬ষ্ঠ তলা হতে ১৪ তলা পর্যন্ত রাজউকের কাছ থেকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেয়। সুতরাং মুসলেহ আহমেদ যে দাবি করেছেন, তারাই জায়গা কিনে বিহ্বিং বানিয়েছেন তা সঠিক নয়। তাঁর বক্তেব্যের পক্ষে প্রমাণ হাজির করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়।
মুসলেহ আহমদ মাসে ১ কোটি টাকা অপারেশানাল লস হিসাব করে প্রথম ৩ বছরে ৩৬ কোটি টাকা লস হয়েছে এবং তাদের স্ত্রীদের এ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ এনে স্টাফদের বেতন দিয়েছেন বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার জবাবে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০০৭ সালে হোটেল চালু হওয়ার পর জয়েন্ট স্টকে প্রথম বছরে যে আর্থিক হিসাব দাখিল করা হয়- সে হিসাব অনুযায়ী রিজেন্সি ৩ কোটি টাকা প্রফিট করেছিল। এর পরের বছর শেয়ার হোহ্বারদের প্রতি ব্লক অনুযায়ী ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে লভ্যাংশ দেয়া হয়েছে। যদি লস করে থাকেন তাহলে প্রথম বছরে ৩ কোটি টাকার প্রফিট কোথায় গেল এবং শেয়ার হোহ্বারদের লভ্যাংশ কোথা থেকে দিয়েছেন বলে পাব্বা প্রশ্ন রাখেন বিনিয়োগকারীরা।
লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, তিন উদ্যোক্তা হোটেল চালুর ১ বছর আগেই ৪৮ কোটি টাকা প্রবাসীদের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। কথা ছিল- তারা এর সাথে আরো ৫২ কোটি টাকা দিয়ে একসাথেই ৪শ রুমের হোটেল চালু করবেন। কিন্তু তারা হোটেল চালু করেছেন মাত্র ২০ রুম দিয়ে। ৮ বছর পর এসে বর্তমানে হোটেলের রুমের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২১৪টি। ২০ রুমের হোটেল চালু করতে বিনিয়োগকারীদের দেয়া ৪৮ কোটি টাকার পুরোটাও খরচ হয়নি বলে তারা মনে করেন।
বিনিয়োগকারীরা প্রশ্ন করে বলেন, ষ্ক্রহোটেল চালুর ১ বছরের বেশি সময় আগেই তারা সবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংকে জমা রাখেন। সে জমা টাকার নিশ্চয়ই ইন্টারেস্ট দিয়েছে ব্যাংক। এ ইন্টারেস্টের হিসাব কোথায়? ৪শ রুমের হোটেল বানানোর জন্য টাকা নিয়ে ২০ রুমের হোটেল বানানো হয়েছে। তাহলে আরো ৩৮০ রুম নির্মাণের টাকা কোথায় গেল? ৮ বছর পর এসে হোটেলে রুমের সংখ্যা হয়েছে ২১৪টি। যার মানে হল আরো ১৮৬ টি রুম বানানোর টাকা তাদের কাছে রয়ে গেছে। এসব টাকার হিসাব কোথায়? তারা আমাদের টাকায় প্রতিষ্ঠিত হোটেল ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে প্রায় ৮৩ কোটি টাকা লোন নিয়েছেন। এ টাকাও তারা আত“সাত করেছেন বলে বিনিয়োগকারীদের দাবিম্ব।
মুসলেহ আহমেদ তাঁর জীবনের ১৫ টি সোনালী বছর রিজেন্সিতে উ্সর্গ করেছেন বলে যে দাবি করেছেন তা মিথ্যা উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০০৫ সাল থেকে রিজেন্সির সূচনা ধরলে এখন পর্যন্ত রিজেন্সির বয়স হয়েছে ৯ বছরের কম। ১৫ বছর রিজেন্সির জন্য উ্সর্গ করেছেন- এমন আবেগময় মিথ্যাচারের কীসের স্বার্থে বলে প্রশ্ন রাখেন বিনিয়োগকারীরা।
তারা বলেন, অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- এই তিন উদ্যোক্তা এত কষ্ট করে হোটেলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিনত করেছেন, তারা কী পেলেন?। আমরা তাদের উদ্যোগ এবং পরিশ্রমের কথা নিশ্চই স্বীকার করি এবং স্বীকার করি বলেই তারা প্রতি মাসে পারিশ্রমিক বাবদ ১০ লাখ টাকা করে নেয়ার পাশাপাশি গাড়ি, ড্রাইভার, ফ্যামিলি ভাতা, ঈদ বোনাস, ব্সারিক বোনাস, হোটেলে থাকা-খাওয়ার সুবিধাসহ প্রতি মাসে আরো ৫/৭ লাখ টাকার সুবিধা নিয়েছেন। সবমিলিয়ে তারা প্রতি মাসে হোটেল থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকার সুবিধা নিচ্চেছন। তিন পরিচালকের পিছনে বছরে হোটেলের ব্যয় হচ্চেছ ৭ কোটি টাকার বেশি। যা বাংলাদেশে আর কোন প্রতিষ্ঠানে পরিচালকদের নেই বলে তারা মনে করেন।

১০/১২ জন বিনিয়োগকারী তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন বলে মুসলেহ আহমেদ যে বক্তব্য দিয়েছেন তা চ্যালেঞ্জ করে বিনিয়োগকারীরা বলেন, গত ১৫ মে বুধবার ঢাকার সিএমএম আদালতে আরিফ মোতাহার ৪৫ জন বিনিয়োগকারীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন। তারা প্রশ্ন রাখেন এসব বিনিয়োগকারী কী তাদের পক্ষে থাকা সত্ত্বেও এদের বিরুদ্ধে মামলা করা হল? ৭০ জনের অধিক বিনিয়োগকারী তাদের পক্ষে রয়েছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। অপরদিকে পরিচালকদের পক্ষে শুধু তাদের স্ত্রী, মা, ভাই-বোন, আত“ীয়-স্বজন ছাড়া আর কোনে প্রবাসী বিনিয়োগকারী নেই বলে তারা দাবি করেন। তারা আরো বলেন, কিছু বিনিয়োগকারীকে মামলা, হামলা এবং শেয়ার কেড়ে নেয়ার ভয় দেখিয়ে আন্দোলতরত বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে দাড় করানোর চেষ্টা হচ্চেছ।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিনিয়োগকারীরা যদি ৩০ লাখ টাকা রিজেন্সিতে বিনিয়োগ না করে সে সময় ঢাকায় কোনো ফ্ল্যাট বা জায়গা কিনত; তাহলে তার মূল্য আজ ১০/ ১২ গুণ ছাড়িয়ে সাড়ে ৩ কোটি টাকা থেকে ৪ কোটি টাকায় দাঁড়াত। কোনো মামলা কিংবা ঝামেলা ছাড়াই তারা সে প্রফিট পেত। তারা বলেন, আমাদের শ্রমে-ঘামে অর্জিত অর্থ রিজেন্সিতে বিনিয়োগ করে লাভ দুরে থাক; আমরা আমাদের নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তা ও বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বিগ্ন। নিজের অর্থের হিসাব চাইতে গিয়ে আজ আমরা মিথ্যা মামলা, হামলা, হয়রানি এবং বঞ্চনার শিকার হচ্চিছ। গত ৯ বছরে ৩০ লাখ টাকার বিপরীতে তারা আমাদের লাভ দিয়েছেন মাত্র ৬ লাখ টাকা।
ষ্ক্রঢাকা রিজেন্সির ষড়যন্ত্রকারীরা এখন জেলেম্ব বলে মুসলেহ আহমদ যে বক্তব্য দিয়েছেন তার তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানিয়ে বিনিয়োগকারীরা বলেন, মুসলেহ আহমেদ গংরাই হোটেলে ন্যায্য হিস্যা চাইতে গেলে মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের হয়রানি শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্য প্রবাসী ৩ বিনিয়োগকারীসহ ৫ জনকে মিথ্যা মামলা দিয়ে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করানো হয়েছে। একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের জামিন আটকে রাখা হয়েছে। তারা আমাদের হোটেলের অর্থ খরচ করে আমাদেরকেই হয়রানি করছেন।
কয়ছর আহমেদের উপর কোনো ধরনের হামলা কিংবা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি বলে মুসলেহ আহমদ যে বিবৃতি দিয়েছেন তার জবাবে বলা হয়, ২৭ এপ্রিল যেদিন কবির রেজা হোটেলে সন্ত্রাসীদের নিয়ে কয়সর আহমেদের উপর হামলা চালায় সেদিন মুসলেহ আহমেদ ছিলেন জেলে। ঐ ঘটনায় ৩ দিন পর মুসলেহ আহমেদ জেল থেকে জামিনে মুক্তি পান। তিনি জেলে থেকে কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে, কয়সর আহমেদের উপর হামলা করা হয়নি?
সংবাদ সম্মেলনে বিনিয়োগকারীরা ৭ টি দাবি তুলে ধরেন। এগুলো হল : অনতিবিলম্বে রিজেন্সির বর্তমান পরিচালকদের পদত্যাগ করতে হবে, সকল বিনিয়োগকারীর সরাসরি ভোটের ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন পরিচালনা বোর্ড গঠন করতে হবে, হোটেলের যাত্রার সূচনা থেকে পরিচালকদের পদত্যাগ করা পর্যন্ত হোটেলের সকল আয়-ব্যয়ের হিসাব অন্তবর্তী বোর্ডের কাছে দাখিল করতে হবে, অন্তর্বর্তী বোর্ডের মাধ্যমে ২০০৫/২০০৬ সালের বিনিয়োগ অনুযায়ী প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ন্যায্য শেয়ার বিতরণ করতে হবে, প্রকৃত শেয়ার মালিকদের স্পন্সর শেয়ার মালিক হিসেবে কোম্পানীতে নিবন্ধন করতে হবে, প্রকৃত শেয়ার মলিকদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে কোম্পানীর পরিচালনা বোর্ড গঠন করতে হবে এবং প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে পরিচালকদের করা মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করতে হবে।
তারা বলেন, আমরা কোনো হানাহানি, সংঘাত চাই না। আমরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্যই সকলেই হোটেল রিজেন্সিতে বিনিযোগ করেছিলাম। হোটেলে আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা চাই, আমাদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা চাই। তারা তিন উদ্যোক্তার উদ্দেশে বলেন, আপনারা যদি ৫২ কোটি টাকা হোটেলে বিনিয়োগ করে থাকেন তাহলে উপযুক্ত প্রমাণ দিন। সেইসাথে আমাদের বিনিয়োগ অনুযায়ী হোটেলের ন্যায্য হিস্যা বুঝিয়ে দিন। তারা আহবান জানিয়ে বলেন, আসুন আমরা নিজ নিজ বিনিয়োগের প্রমাণ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ঢাকা রিজেন্সিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিই।
বিনিয়োগকারীদের পক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন আমিনা বেগম এবং আমিনা বেগমের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আমিনুল ইসলাম।
জাস্টিস ফর প্রবাসী ইনভেস্টার্সের প্রতিবাদ সভা
এদিকে রিজেন্সি বিনিয়োগকারীদের অধিকার রক্ষায় একটি নতুন সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছে। জাস্টিস ফর প্রবাসী ইনভেস্টার্স নামে এই সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন ও গ্রেটার সিলেট ডেভেলাপমেন্ট এসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেণ্ট এবং প্রবীন কমিউনিটি নেতা এসএম আলাউদ্দিন। মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনের পূর্বে এসএম আলাউদ্দিনের সভাপতিত্বে সংগঠনটি একই স্থানে একটি প্রতিবাদ সভা করে। এ প্রতিবাদ সভায় রিজেন্সি হোটেলে কবির রেজা কর্তৃক কাজী কায়সার আহমেদের উপর সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়।
এসএম আলাউদ্দিন বলেন, ব্রিটিশ সরকারের উদ্বেগ এবং বাংলাদেশ হাই কমিশনের চিঠি সত্ত্বেও কবির রেজাসহ হামলকারীরা এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্চেছ। তিনি এটাকে সকল যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের বিনিয়োগ এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি অশনি সংকেত উল্লেখ করে বলেন, এর মাধ্যমে আমরা অনুধাবন করতে পারি, আমরা যদি বাংলাদেশে গিয়ে হামলা কিংবা হয়রানির শিকার হই তাহলে সরকারগুলোর কাছ থেকে কী ধরনের সহায়তা পাব? তিনি দ্বিতীয় কোনো রিজেন্সি জন্মলাভের আগে সকলকে সচেতন হয়ে ঐকবদ্ধভাবে এ ঘটনা সুরাহায় এগিয়ে আসার আহবান জানান।
আলাউদ্দিন আরো বলেন, তিনি নিজে লন্ডনে অবস্থানরত রিজেন্সির ভাইস চেয়ারম্যান মুসলেহ আহমেদকে এই প্রতিবাদ সবায় উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলেহ আহমেদ তাঁর সে অনুরোধ রাখেননি।