ইতালীতে রোমানিয়ানদের হাতে বাংলাদেশী খুন

Tupu Sultanইতালি প্রতিনিধি: ১৭ আগষ্ট ২০১৪, রবিবার ইতালীর সিসিলি রাগুসায় ছুড়ি দিয়ে কুপিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে কুমিল্লা জেলার হোমনা থানার গোয়ারীভাঙ্গা গ্রামের টিপু সুলতানকে। টিপু সুলতানের নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনার বিষটি জানতে চাইলে টিপু সুলতানের চাচা মোঃ রহিম এবং কাছের বন্ধু জনি হক (বাড়ী কুমিল্লার লালমাই) তারা জানান। আমরা সবাই বাতানিয়া নামক এক ইতালীয়ান মালিকের কৃষি প্রকল্পে কাজ করি। সেই প্রকল্পে শুধু বাংলাদেশীরাই নয়, রোমানিয়ান, ইন্ডিয়ান ও অন্যান্য দেশের মানুষও কাজ করে থাকেন। কৃষি প্রকল্পের মালিক বাতানিয়ার কাছে আমরা অনেক প্রিয়। বাতানিয়া আমাদের অনেক সুযোগ সুবিধা দেন, আমাদের কাজ-কর্ম তিনি অনেক পছন্দ করেন, আমাদের আচার ব্যবহারেও তিনি মুগ্ধ। বাতানিয়া রোমানিয়ানদের কাজ কর্ম এবং তাদের আচার ব্যবহারে সন্তষ্ট ছিলেন না। বাতানিয়ার সাথে রোমানিয়ানদের প্রায় কথা কাটাকাটি হতো। রোমানিয়ানদের প্রতি বাতানিয়া অসন্তষ্ট হয়ে বাংলাদেশীদের বলতেন, তোমাদের যদি আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব থাকে তাহলে তাদের এখানে নিয়ে আসো, আমার প্রকল্পে তোমাদের সাথে কাজ করবে। আমি রোমানিয়ানদের আমার এই প্রকল্পে আর কাজ দিব না এসব কথা বলতেন। বাতানিয়া ধীরে ধীরে রোমানিয়ানদের কাজ থেকে বাদ আর বাঙ্গালীদের কাজ দিতে শুরু করলেন। এ বিষয়টি রোমানিয়ানরা মেনে নিতে পারছিল। রোমানিয়ানরা কৃষি প্রকল্পে কাজের সময় বাঙ্গালীদের অযথা গালাগালি করতো, খারাপ ব্যবহার করতো এবং অনেক সময় অনেক বাঙ্গালীর গায়ে হাত তুলতো। এসব বিষয় বাঙ্গালীরা বাতানিয়াকে বললে, বাতানিয়া বলতো, আমি আস্তে আস্তে সব রোমানিয়ানদের এখান থেকে বাদ করে দেব। এসবেরই সূত্র ধরে গত ৮-৯ মাস আগে ইউলিয়ান নামের এক রোমানিয়ান ৫-৬ জন লোক নিয়ে আমাদের বাসস্থানে এসে মারধর করে চলে যায়। আমরা তখন ৩-৪জন্য বাঙ্গালী ছিলাম, আমরা তাদের প্রতিবাদ করিনি। আমরা সকল বাঙ্গালীরা একত্রিত হয়ে বাতানিয়ার কাছে নালিশ দেই, বাতানিয় বলেন, ঠিক আছে আমি তাদের বুঝাবে এবং প্রয়োজনেস আইনের ব্যবস্থা নিব। (বাতানিয়া এবং রোমানিয়ানদের সাথে কি কথা হইছে, বাতানিয়া কি কোন আইনের ব্যবস্থা নিছে কি না তা আমরা জানি না) তারপর এভাবে ৯ মাস পার হয়ে গেল রোমানিয়ানরা আমাদের কাছে আর আসে নাই, এবং কাজেও যায় না। গত ৯মাস পর ইউলিয়ান, ইউলিয়ানের বাবা ও অন্যান্য রোমানিয়ান সহ ৮ -৯ জনের একটি দল অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে এসে টিপু সুলতানকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে।

৯ মাস পূর্বে রোমানিয়ানদের সাথে বাঙ্গালীদের যে ঘটনাটি ঘটেছিল, সেই ঘটনার ব্যাপারে টিপু কিছুই জানতো না। টিপু রাগুসায় আসছে মাত্র ৪ মাস হয়।টিপু অনেক ভাল ছেলে ছিল, সবার সাথে মিলে মিশে চলাফেরা করতো, ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো।
ঘটনার দিন টিপু এবং অন্যান্য বাঙ্গালী সহকর্মীরা বেলা ১টা সময় কাজ থেকে এসে এক সাথে খাওয়া দাওয়া করে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সহকর্মী আব্দুল বাতেন- কুমিল্ল দাউদকান্দি, জাকির হোসেন- দাউদকান্দি, শাহজালাল-দাউদকান্দি, আব্দুস সালাম- দাউদকান্দি ও মাসুম- দাউদকান্দি, সহ অন্যান্যরা কাজের উদ্দ্যেশ্যে চলে যায়। আর টিপু তাদের বলেন আপনারা কাজে যেতে থাকেন আমি যোহরের নাজায আদায় করেই চলে আসছি। টিপু প্রতিদিনই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে যোহরের নামাজ আদায় করে তার পরে কাজে যেতেন।
টিপুরা যেখানে বসবাস করতো ঐসব ক্ষেত খামার এলাকায় লোকজনের বসবাস খুবই কম ছিল, শহর থেকে একটু দূরে, পায়ে হেটে কিংবা সাইকেলে চড়ে চলাফেরা করতে হয় জন সাধারনের আনাগোনা খুব কম।
জনি হক (টিপুর বন্ধু) আরো বলেন, যখন টিপুর হত্যাকান্ডটি ঘটে তখন আনুমানিক বেলা ৪টা। টিপুর বাসা থেকে ৫-৬মিনিট হাটলেই আমার বাসা। আমি সেদিন কাজে যাইনি, বাসায় ঘুমাচ্ছিলাম হঠাৎ শুনি এ্যাম্বুলেন্স ও ক্যারাবিনিয়ারী-পুলিশের গাড়ি শব্দ। অনেক হৈ চৈ। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি টিপু এবং কৃষি প্রকল্পের মালিক বাতানিয়ার বাড়ির মাঝামাঝি পুলিশ আর এ্যাম্বুলেন্স। আমি খুব আতঙ্কে উঠলাম, কি হলো ঐখানে? পরে বাসা থেকে বেড় হয়ে আস্তে আস্তে আমি ঘটনাস্থলে গেলাম। বাতানিয়া আমাকে দেখে ডাকল, আমি বাতানিয়ার কাছে গেলেই বাতানিয়া বলতে লাগলো দেখ কারা যেন টিপুকে মেরে ফেললো। তখন মৃত দেহটি সাদা কাপড়ে ঢাকা ছিল। পুলিশ চতুরদিকে তখন তল্লাশি করছিল। এক সময় একজন পুলিশ আমার কাছে আসল, আমার কাছ থেকে টিপুর বিষয়ে জানতে চাইলো, পুলিশের প্রশ্নে উত্তর আমি দিয়েছি এবং পরে আমি মোবাইলে কল করে তার সহকর্মী সবাইকে ঘটনাটি জানিয়ে দেই। সবাই কাজ রেখে ঘটনাস্থলে চলে আসে।
কাজ থেকে যখন আমাদের সকল বন্ধুবান্ধব চলে আসে, আমরা সবাই টিপুর মৃত দেহ দেখতে পুলিশের কাছে যাই। পরক্ষনে পুলিশ আমাদের নিয়ে টিপুর বাসস্থানে আসে। আমরা তখন দেখতে পাই টিপু যেখানে নামাজ পড়ে, সেই স্থানো নামাজের জায়নামায বিছানো ছিল, টিপুর মাথার টুপি মেঝেতে পরা ছিল। আসবাবপত্র ভাংচুর ও এলোমেলো এবং মেঝেতে রক্ত পড়ে আছে, দরজায় র্েক্তর দাগ। তখন আমরা ধারনা করলাম খুনিরা টিপুকে বাসার মধ্যেই ছুড়ি দিয়ে আঘাত করে এবং পরে ছুড়ি তার বুকের বাম পাশদিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। টিপু হয়তো বাঁচার চেষ্টায় তার মালিক্রে বাসার দিকেই ছুটতে চেষ্টা করছিল।
অন্যদিকে টিপুর মালিক বাতানিয়া টিপুর বন্ধুবান্ধব এবং পুলিশের উদ্দেশ্যে বলেন, টিপু খুব ভাল ছেলে ছিল। আমার জানামতো সে কোন প্রকার অসামাজিক কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিল না। আমার এ প্রকল্পে সে প্রায় ৪ মাস যাব কাজ করছে। তার এ ঘটনার মূল রহস্যে আমি অবগত না। তবে ধারনা করছি প্রকল্পের কাজের সূত্র ধরেই এই ঘটনা। তিনি আরো বলেন, আমি বাসা থেকে চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। বাসা থেকে কে বা কারা চিৎকার করছে তা দেখতে পাই নাই। আমি অনুমান করলাম হয়তো বাহিরে কোন প্রকার সমস্যা হচ্ছে এসব ভেবে বাসা থেকে বের হই। এসে দেখি বাসা থেকে প্রায় ১০০-১২০ মিটার দুরে রক্তাক্ত একটি দেহ । কাছে গিয়ে দেখি টিপু মাটিতে লুটিয়ে পরে আছে, আমার দিক তাকিয়ে রযেছে, কিছুই বলতে পারছেনা, তার হাত পা লাফাচ্ছে বুকে বড় একটা ছুরা গেঁথে রয়েছে, সারা শরীরে রক্ত। আমি তার কাছে গিয়ে তাকে স্পর্শ করার সাহস পাইনি, আমি ভাল মন্দ কিছু বুঝতেও পারছিলাম না যে কি করবো, আমি কোন উপায় না পেয়ে তাৎক্ষনিকই পুলিশ ও এ্যাম্বুলেন্স কল করি। আমার কলের অল্প সময়ের মধ্যেই ডাক্তার আসে। ডাক্তার এসে তাকে মৃত ঘোষনা করে।
টিপুর হত্যার ঘটনা অল্প সময়ের মধ্যেই সমগ্র ইতালী, ইউরোপ এবং বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তার এই নির্মম হত্যাকান্ডের ব্যাপারে জানতে চাইলে, ইতালীর রাজধানী রোমে বসবাস করেন টিপুর গ্রামেরই সম্পর্কে চাচা শাহজাহান মাস্টার ও সম্পর্কে চাচাত ভাই রাজিব বলেন- টিপু ২০০৬সালে স্পন্সরে ইতালীতে আসে। টিপু আমাদের গ্রামের ছেলে, তাকে আমরা ছোট বেলা থেকেই চিনতাম। খুব ভাল এবং ভদ্র। ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, কোন ধরনের বাজে অভ্যাস ছিলনা। সে ইতালীতে এসে আমাদের বাসায় থাকতো। রোমে আমার বাসায় প্রায় দেড় বছর ছিল। তার পর কাজের জন্য বিভিন্ন শহরে চলে যায় । তার সাথে প্রায় টেলিফোনে কথা হতো। রোমে আসলে আমাদের বাস্য়া থাকতো। টিপুরা তিন ভাই দুই বোন, টিপু ছিল ভাই-বোনের মধ্যে ৪ নাম্বার, তার বাবার নাম আব্দুর রহমান। টিপু গত ৭-৮ মাস আগে দেশে যায় এবং ইতালীতে আসার মাত্র ৭-৮দিন আগে বিয়ে করে আসে। তার এই নৃসংশতম হত্যাকান্ড কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমরা ইতালীয়ান সরকারের কাছে ন্যায্য বিচার দাবী করছি এবং এ ধরনের ঘটনা যে আর না ঘটে সে জন্য সরকারের যথাযথা ব্যবস্থাও গ্রহন করা উচিত বলে মনে করছি।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রোমানিয়ান খুনিচক্রের প্রধান খুনি ইউলিয়ান ও তার বাবাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ইউলিয়ানকে গ্রেফতার করার পর পুলিশের কাছে টিপুর হত্যার কথা স্বীকার করে। পুলিশ এ বিষয়টিকে আরো খতিয়ে দেখছেন এবং খুনের আসল রহস্য উদঘাটনের জন্য অব্যাহত রয়েছে বলে জানা যায়।
হত্যাকান্ডের ব্যাপারে ইতালীস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর রুবায়াৎ-ই-আশিক এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমরা এ দেশের পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছি। পুলিশ তাদের অনুসন্ধ্যান ও তল্লাশী চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এ ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান ।
কাউন্সিলর আশিক আরো বলেন মৃত দেহে দেশে পাঠাতে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করবো এবং ইতিমধ্যে টিপু সুলতানের ইতালীস্থ আত্মীয়স্বজন দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করেছে, এ দেশের পুলিশ আমাদের রেফারেন্সে লাশ হস্তান্তর করবে শীঘ্রই এবং তা দেশে পাঠাতে যা যা করণীয় আমরা সব কিছুই করবো।