সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজ দুদকের নজরদারিতে
কাইয়ুম উল্লাস :: নুর আজিজুর রহমান। টানা ১২ বছরই তিনি সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) প্রকৌশলীর গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। দুর্নীতির অভিযোগে ওয়ান ইলেভেনের সময় তার ওপরের বস প্রধান প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হলেও তিনি থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরপরই সুযোগ পান সেই সাইফুল ইসলামের পদে আসার। শুরু করেন সাইফুল ইসলামের পথে হাঁটা। বর্তমানে টেন্ডার থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজে তিনি কমিশন বাণিজ্য করছেন বলে একাধিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। তার ওপর সিসিকের বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজের দুর্নীতি নিয়ে সিলেট দুদক নজরদারি শুরু করেছে। অনেক তথ-প্রমাণও বের করেছে দুদক সিলেট।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০২ সালে সিলেট পৌরসভা সিলেট সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়। ওই সময়ে জনবল বাড়ানোর দরকার হলে নুর আজিজুর রহমানকে সিসিকের সহকারী প্রকৌশলীর পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন সাইফুল ইসলাম। সাইফুল ইসলাম ও নুর আজিজ মিলে ওই সময়ে সিসিকের কাজে ব্যাপক লুটপাট করেন। ১/১১ এর সময়ে ২০০৭ সালের ১৩ মার্চ নগর ভবন প্রায় এক ঘণ্টা ঘেরাও করে রেখেছিল যৌথ বাহিনী। তৎকালীন মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান সাইফুল ইসলামকে ডেকে তাৎক্ষণিক সাময়িক বরখাস্তের নোটিস ধরিয়ে দেন। বরখাস্তের পরপরই যৌথবাহিনী তাকে আটক করে র্যাব-৯ এর ইসলামপুরস্থ সদর দপ্তরে নিয়ে যায়। র্যাবের কাছে সাইফুল তার অপকর্মের কথা স্বীকার করেন। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের হিসাবও তুলে ধরেন সাইফুল। আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ ২০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন।
২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী আবদুন নুর দুর্নীতির অভিযোগে সহকারী প্রকৌশলী নুর আজিজকে বরিশালে বদলি করেন। সিসিক থেকে কিছু সময়ের জন্য দুর্নীতি থেমেছিল। কিন্তু নুর আজি সিসিকের প্রতি ঝোঁক কমাতে পারেননি। তিনি তড়িঘড়ি করে সিসিকের উচ্চপর্যায়ের একটি সিন্ডিকেট লবি ধরে ফের সিসিকের আসার তৎপরতা শুরু করেন। সফলও হন তিনি। ওই সিন্ডিকেটকে তুষ্ট করায় বরং এবার তিনি সেই কাক্সিক্ষত প্রধান প্রৌকশলীর পদে আসার সুযোগ পান। ২০০৯ সালের ১৯ মে তিনি আবারও সিসিকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। তখন থেকে তিনি এখনও এই ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বের বোঝা টানছেন। দুই মেয়াদে মোট ১২ বছর এই দায়িত্ব পালন করেও তিনি ক্লান্ত নন। সেই সাইফুল পদ্ধতিতেই তিনি কমিশন নিচ্ছেন বলে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। যে কারণে, দুদক কর্মকর্তারাও এবার নুর আজিজের প্রকল্পের কাজগুলো মনিটরিং করছেন।
দুদক সূত্র জানায়, সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ের ট্রাক টার্মিনালের কাজ ঝুলিয়ে সুবিধা নিচ্ছেন নুর আজিজ। তিনি ঠিকাদার হেলালকে কমিশন নিয়ে সহযোগিতা করেছেন মর্মে তথ্য পেয়েছে দুদক। আর হেলাল দ্রুত টাকা তুলে নিচ্ছেন, কিন্তু টার্মিনালের কাজ এগোচ্ছে মন্থরগতিতে। এমনকি, হেলাল সঠিক রড দিয়ে কাজ না করে টার্মিনালে নি¤œমানের রড ব্যবহার করেছেন। কমিশন নিয়ে নুর আজিজ চুপ থেকেছেন।
২০১৫ সালে সর্বনি¤œ দরদাতাকে কাজ না দিয়ে ৬০ লাখ ১৯ হাজার টাকা বেশি দরদাতা সামাদ এন্টারপ্রাইজকে কাজ দেওয়া হয়। এ দরপত্রের অনিয়মের ঘটনায় হক কনস্ট্রাকশন আদালতে রিট পিটিশন (নম্বর -১১৭০১/১৫) করেন সোহেল নামের এক ঠিকাদার। নুর আেিজর ওপর অভিযোগ ওঠেছিল, তিনি কমিশন নিয়ে বেশি দরদাতা সামাদকে নগরীর ভাতালিয়া-মেডিকেল ড্রেন-রাস্তা সংস্কার, কাজিরবাজার মাছের আড়ত পর্যন্ত আরসিসি ঢালাই রাস্তার কাজ দিয়েছিলেন।
দুদক সূত্র আরও জানায়, সিলেটে কোর্ট পয়েন্টে প্রথম ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে দুই কোটি টাকা ব্যয়ে। এই ব্রিজটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক এখনো থামেনি। সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। পথচারীদের এই ব্রিজ ব্যবহার করতে দেখা যায় না। অভিযোগ রয়েছে, প্রয়োজন ছাড়া ব্রিজটি নির্মাণ করে টাকা লোপাট করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, নুর আজিজ শুধু প্রকল্প ঝুলিয়েই সুবিধা নেন তা কিন্তু নয়। তিনি প্রতিটি বিভাগেই কমিশন নেন। ২০১৫ সালে মশার ওষুধ না ছিটিয়েই টাকা লোপাট, নামেমাত্র ময়লা পরিষ্কার করে নগরীর ছড়া খননের টাকা ভাগ, বিল্ডিং কোড অমান্যকারীদের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ, সিসিকের জায়গা দখল ও উদ্ধার নিয়েও ঘুষবাণিজ্য করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। নগরীতে ময়লা ফেলার স্টেশন নির্মাণ প্রকল্পের কাজে নি¤œমানের কাজ করে বড় অঙ্কের ব্যয় ধরা হচ্ছে। নবাবরোডে সিসিকের ড্রেনেজ কাজে মাটি খুঁড়ে পাওয়া প্রায় কোটি টাকার ইট হরিলুট করতে সহযোগিতা করা হয়েছে।
সিসিকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নুর আজিজ সিলেটের জৈন্তাপুরে ৮ শতক জমি, পীরেরবাজারে একটি হাউজিং কোম্পানির কাছ থেকে দুটি প্লট, ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট ও একটি প্লট কিনেছেন।
সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমানের বক্তব্য নিতে তার কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তাকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সিলেটের পরিচালক ড.মো. আবুল হাসান বলেন,‘ আমরা জানতে পেরেছি, সিসিকের অনেক প্রকল্পের কাজে অনিয়ম হচ্ছে। কোনো কাজে সরাসরি , কোনো কাজ ঝুলিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে। সে অনুযায়ী নুর আজিজসহ অনেকেই নজরদারিতে রয়েছেন। সিসিকের প্রকল্পের কাজগুলো সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।