এটিএম কার্ড জালিয়াতির মূল হোতা সিলেটের নাবির-বিদেশি জালিয়াতরা আসত পীরমহল্লার বাসায়

11

 ডেস্ক রিপোর্ট :: আন্তর্জাতিক ব্যাংক জালিয়াত চক্রের সদস্য ফরিদ নাবির । তার বাসা সিলেটের পীরমহল্লা প্রভাতি-৩৬। প্রতিবেশীরা দেখেছেন, এই বাসায় নিয়মিত বেড়াতে আসতেন বিদেশি কিছু আগন্তুক। এরাই নাবিরের বিদেশি ব্যাংক জালিয়াত চক্রের সদস্য। সম্প্রতি রাজধানীর বনানী ও মিরপুর থেকে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলেছে ওরা। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সিলেটি যুবক নাবিরের হাত ধরেই বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাংকের টাকা তুলতে বাংলাদেশে এসেছিল এই জালিয়াত চক্র। জালিয়াতির ৫০ হাজার মার্কিন ডলার নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন দুজন। নাবির বিদেশে থেকেও টাকার ভাগ পেতেন বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত শুক্রবার রাত ১ টার দিকে ঢাকা থেকে সিলেটে নাবিরের খোঁজে এসেছিল একটি গোয়েন্দা দল। তারা নাবিরের বাসাটি শনাক্ত করে যান। নাবির ঢাকায় এলে বিভিন্ন স্থানে সিলেটের ভুল ঠিকানা দিতেন। তিনি পীরমহল্লার প্রভাতি-৩১ নম্বর বাসার ঠিকানা ব্যবহার করতেন। কিন্তু ৩১ নম্বর বাসায় একটি নিরাপত্তা কোম্পানির কর্মকর্তা থাকেন। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে,ওই গোয়েন্দা দল নাবিরের প্রভাতি-৩৬ নম্বর বাসাটি শনাক্ত করে যান।
ওই বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, এটি তিন তলা বিলাসবহুল একটি বাসা। বাসার সামনের অংশে নতুন টাইলস বসানো হয়েছে। এই বাসাটির বর্তমান নাম ‘নাবির ভিলা’। এখানে নাবিরের ওই ভাগ্নে রিপন থাকেন। রিপনের বাড়ি ছাতকের জাউয়া। তিনি এই বাসায় থেকে পড়েন বলে জানিয়েছেন। বাসাটিতে কয়েকটি কক্ষ খালি থাকলেও নিচের ও উপরের কয়েকটি রুম ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাসাটি পরিচালনা করে আসছেন কেয়ারটেকার দিলওয়ার। তার বাড়ি দক্ষিণ সুনামগঞ্জের দরগাপাশা ইউপির আম্্িরয়া গ্রামে। দিলওয়ার একজন ট্রাভেলস ব্যবসায়ী। নগরীর আম্বরখানায় তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তিনি এই বাসার ভাড়া তুলেন। ফরিদ নাবির টেলিফোনে বিদেশ থেকেই কেয়ারটেকার হিসেবে তাকে পরিচালনা করতেন। ফরিদ নাবিরের কথামতো বাসার ভাড়ার টাকা বিভিন্ন ব্যক্তিকে দেওয়া হয়।
বাসার কেয়ারটেকার দিলওয়ার জানান, ফরিদ নাবিরের গ্রামের বাড়ি ওসমানীনগরের বড় ধিরারাই গ্রামে। তিনি প্রায় ৫ বছর ধরে বাসাটি দেখাশোনা করে আসছেন। তার নিজের পরিবারও এখানে থাকেন। তিনি নাবিরের ঘটনাটি পত্রিকায় পড়েছেন। এর বাইরে কিছু জানেন না। তবে, কেয়ারটেকার হিসেবে নাবিরের কথামতোই ভাড়ার টাকা বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল দিয়ে নিকটতম লোকজনের হাতে দিতেন।
বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ওই বাসায় নাবিরের পরিবারের কেউ থাকেন না। বাসায় গোয়েন্দা পুলিশ এসে নাবিরকে খোঁজে যাওয়ায় ভাড়াটিয়ারাও ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনাটি জেনে গেছেন। তাই বাসার ভাড়াটিয়ারা এক ধরনের অস্বস্তিতে আছেন।
স্থানীয় বেশ কয়েকজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নাবির ভিলা বাসাটি টুকেরবাজারের ছালিয়া এলাকার এক লন্ডন প্রবাসীর ছিল। তিনি নাবিরের বোনজামাই বলে এলাকার সবাই জানতেন। প্রায় দশ বছর আগে ওই ব্যক্তি এখানে বাসাটি ২য় তলা পর্যন্ত বানিয়েছিলেন। নাবির ওই লোককে এখান থেকে বিদায় করে দিয়েছে। বাসাটিকে ৩য় তলা পর্যন্ত করেছে। টাইলস বসিয়ে নাম দিয়েছেন, নাবির ভিলা। এরপর থেকেই কেয়ারটেকার দিয়ে বাসাটি নাবিরই পরিচালনা করিয়ে আসছেন। স্থানীয়রা জানান, ওই বাসায় নিয়মিত কিছু লোক আসতেন মাইক্রোবাসে চেপে।
প্রভাতি এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই মাসখানেক আগেও একটি হাইএস মাইক্রোবাসে করে চালকসহ চারজনকে ওই বাসার সামনে আসতে দেখেছেন। দিলওয়ার তাদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছেন। তাদের মধ্যে একজন বিদেশি লোক বলে মনে হয়েছে। তারা গাড়িতে বসেই আলাপ করে চলে যান। তখন রাত ছিল ১ টা ।
খোঁজ নিতে গেলে নাবিরের গ্রামের লোকজন জানান, নাবির এখন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। সবকিছুই তার লন্ডন, ঢাকা ও পীরমহল্লার বাসাকে ঘিরে চলছে। গ্রামের বাড়িতে চাচাতো ভাইরা আছেন। তারা গ্রামের বাড়ির স্বজনদের দেখভাল করে থাকেন। নাবির কেয়ারটেকার দিলওয়ারকে দিয়ে স্বজনদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন।
ঢাকার গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পিটার ও তার চক্রকে জালিয়াতি করতে সব ধরনের সহায়তা করে ফরিদ নাবির। ফরিদ গুলশানের হলিডে প্ল¬ানেট হোটেলে ওঠার সময় সিলেটের যে ঠিকানা দিয়েছিলেন তা ভুয়া। ফরিদের লন্ডনের ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছে পুলিশ। ফরিদ নাবির মূলত ব্যবসার আড়ালে জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে কাজ করে থাকেন। লন্ডনে তার নাবির ফাউন্ডেশন, লেট ব্রিটেইন ইন্টারন্যাশনাল, লক্ষ্য বে হোটেল, স্যাফরন লিমিটেড, অ্যালিয়েন্স গ্রুপ, অ্যালিয়েন্স হোমস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৯৮০ সালের অক্টোবরে জন্ম নেয়া ফরিদ নাবিরের আদি বাড়ি সিলেটে। সেই হিসেবে  তিনি মাঝে মধ্যে বাংলাদেশে আসতেন। নাবির ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে  তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন। নাবির ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে এসব অর্থ বাংলাদেশি পথশিশু, গরিব পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে। গত বছর ফরিদ নাবির উদ্যোক্তা হিসেবে লন্ডনের বার্মিংহামে দেশ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ বাংলাদেশি বিজনেস অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করে। সে অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও উপস্থিত ছিলেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ইতিমধ্যে ফরিদ নাবিরের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছেন। খুব শিগগিরই তাকে গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলে নোটিশ  জারি করবেন। ফরিদ নাবির মূলত নানারকম ব্যবসার আড়ালে জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। বাংলাদেশ ছাড়াও পিটার ও তার সহযোগীদের সঙ্গে সে বিভিন্ন দেশে জালিয়াতি করেছে।
সিসিকের ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরহাদ চৌধুরী শামিম জানান, এটিএম কার্ড ব্যবহার করতে আমরা এখন ভয় পাচ্ছি। নাবির সম্পর্কে আমি তেমন জানি না। তবে, সে যদি অপরাধী হয়, তাকে ধরে বুথ জালিয়াতির ঘটনায় শাস্তি দেওয়া উচিত। এই ওয়ার্ডে তদন্তে পুলিশকে সব ধরনের সাহায্য করব আমরা।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলাম জানান, তিনি ঢাকার জালিয়াতি ঘটনাটি জানেন। তবে, সিলেটে পীরমহল্লায় নাবিরের বাসা তা জানতেন না। আর ঢাকা থেকে গোয়েন্দা দল এলেও গোপনীয়তার জন্য ওই দলটি তাদের জানানোর দরকার মনে করেনি। তারপরও ওই বাসার ওপর নজরদারি রাখবে এসএমপি-ডিবি।
উল্লেখ্য, গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনানী ও মিরপুর এলাকার বিভিন্ন বুথ থেকে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের টাকা তুলে নেয় দেশি-বিদেশি জালিয়াত চক্র। ফরিদ নাবিরকে এই চক্রের অন্যতম হোতা বলে মনে করছে পুলিশের গোয়েন্দা দল। তিনিই বিদেশি জালিয়াতদের বাংলাদেশে নিয়ে আসেন।