ধর্মনিরপেক্ষতা কোনোভাবেই ইসলামবিরোধী নয়

DSC_0200

 ডেস্ক রিপোর্ট :: ‘ধর্মনিরপেক্ষতা কোনোভাবেই ইসলাবিরোধী নয়। ইসলামে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় অসহষ্ণিুতার কোনো স্থান নেই। ইসলাম একটি মানবিক ও মানুষের প্রকৃতিগত ধর্ম।’ গতকাল রোববার সবুজ সিলেটের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথাগুলো বলেছেন ভারতের খ্যাতিমান আলেম, বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং অল ইন্ডিয়া (এআইইউডিএফ) সভাপতি মাওলানা সিদ্দুকুল্লাহ চৌধুরী ভারতের একজন আলোচিত ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। এক সপ্তাহের সফরে বাংলাদেশে এসে তিনি ঢাকা ও সিলেটে বিভিন্ন ইসলামি মাহফিলে যোগদান করেন। গত ২৬ ও ২৭ কাজিরবাজার জামেয়া মাদানিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক সম্মেলনে তিনি বক্তব্য রাখনে। সিলেট নগরীর নবাব রোডস্থ একটি বাসায় তিনি অবস্থান করেন। গতকাল ওই বাসায় তাঁর একান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়।
মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে টাইটেল পাস করেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার করজগ্রামে তাঁর বাড়ি। তিনি নিজ গ্রামে জামেয়া ইসলামিয়া করজগ্রাম গড়ে তুলেছেন। এই মাদ্রাসায় ছাত্র সংখ্যা প্রায় ছয় শ। ভারতজুড়ে ৯৭৩টি কওমি মাদ্রাসা নিয়ে দারুল উলুম দেওবন্দভিত্তিক একটি শিক্ষাবোর্ড রয়েছে। তিনি ১৯ বছর ধরে এই শিক্ষাবোর্ডের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন।
দেশ বিভাগকালে শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মদনি (রহ.) বলেছিলেন, ভারতে মুসলমানরা বিপদে এবং পাকিস্তানে ইসলাম বিপদে পড়বে। তাঁর এই বক্তব্যের আলোকে বর্তমানে ভারতে মুসলমানরা কোন অবস্থায় আছেন?
এ প্রসঙ্গে মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মাওলানা মদনি (রহ.) যে প্রেক্ষাপটে ওই কথা বলেছিলেন, বর্তমানে ভারতে সে অবস্থা নেই। ভারতে মুসলমানরা নিরাপদে ও ভালোভাবে আছেন। ভারতের অধিকাংশ মানুষ অসাম্প্রদায়িক ও গণতন্ত্রপ্রিয়। তবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) ও শিবসেনার মতো কয়েকটি সংগঠন অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়। কিন্তু তারা সফল হয় না।
পশ্চিমবঙ্গ মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ও আলোচিত একজন রাজনৈতিক নেতা। কিন্তু বাংলাদেশে তাঁর মতো সফল রাজনীতিবিদ কোনো আলেম নেই কেন?
এর উত্তরে তিনি বলেন, সেবার মাধ্যমে মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করতে হয়। মহানবি সা. বলেছেন, ‘খাইরুন্নাসি মাঁইয়্যাউনফান্নাসি।’ অর্থাৎ-মানুষের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ভালো, যিনি মানুষের উপকার করেন। তিনি বলেন, বিগত বন্যার সময় পশ্চিমবঙ্গে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ৭ কোটি ২০ লাখ ভারতীয় রুপির ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ এবং একটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করে। সাহায্যপ্রাপ্তদের মধ্যে ২০ শতাংশ ছিলেন হিন্দু। যে-কোনো দুর্যোগ ও বিপদে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দু জনসেবায় এগিয়ে আসে। বাংলাদেশের বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামেরও এই ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ্ সবসময় ভারতীয় কংগ্রেসকে সমর্থন দেয়। কিন্তু এই সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ শাখা কংগ্রেসের সঙ্গে নেই। মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসকে জমিয়তের সমর্থন দেওয়া প্রসঙ্গে মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেন, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস আর কখনো ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তাই আমরা ডুবন্ত নৌকায় উঠতে চাই না। নন্দীগ্রামের ঘটনার সময় মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়। আমরা একসঙ্গে আন্দোলন করি। পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়ন, তথা দেশ ও জনগণের স্বার্থে আমরা তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করি ও করে যাচ্ছি।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ্ পশ্চিমবঙ্গ শাখার সাধারণ সম্পাদক থাকা সত্ত্বেও তিনি এআইইউডিএফ নামে একটি রাজনৈতিক দল কেন গঠন করলেন? এর উত্তরে মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেন, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ্ একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। অনুন্নত ও অবহেলিত মানুষের সেবা করার জন্য প্রথমে (পিডিসিআই) এবং পরবর্তীকালে এআইইউডিএফ গঠন করেন। তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করবেন বলে কানাঘুষা সম্পর্কে বলেন, মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে এ সম্পর্কে আলোচনা চলছে। তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদানের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ছবি উঠানো ইসলামে হারাম বা নিষিদ্ধ কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছবি উঠানো অবশ্যই হারাম। তবে জরুরি কাজের প্রয়োজনে এবং ছবির মাধ্যমে মানুষের কাছে বক্তব্য পৌঁছানোর স্বার্থে ফটো উঠাতে আমরা বারণ করি না।
জামায়াতে ইসলামী ও এর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদি সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আবুল আলা মওদুদির অনেক বক্তব্য ইসলামের মৌলিক আকিদা-বিশ্বাসের পরিপন্থি। এসব বক্তব্য ইসলামের মূলনীতির পুরোপুরি বিরোধী। তাই উলামায়ে কেরাম ঐক্যবদ্ধভাবে আবুল আলা মওদুদিকে গুমরাহ ও ভ্রষ্ট বলে রায় দিয়েছেন। যারা মওদুদির এসব কথা মানবে ও বিশ্বাস করবে, তারাও গুমরাহ হবে।
শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মদনি (রহ.) ১৯৫৬ সালে ভারেতের সুরাটে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ১৯তম সাধারণ সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতা সমর্থন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হলে বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা কোনোভাবেই ইসলামবিরোধী নয়। মুসলমান হবার জন্য ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করাও অত্যাবশ্যক নয়। তবে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করতে পারলে ভালো। ইসলাম সম্পূর্ণ মানবিক ও মানুষের প্রকৃতিগত ধর্ম; একটি পরিপূর্ণ জীবনপদ্ধতি। ইসলামে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কোনো স্থান নেই। বর্তমান বিশ্বে খাঁটি ইসলামি রাষ্ট্র একটিও নেই; মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র আছে অনেক। তাই বলে সে-সব দেশের মুসলমানরা কি মুসলমান নন? তিনি বলেন, কুরআন-হাদিসে তথা ইসলামে কোথাও ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়নি।
সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রায়ই প্রাণ হারানো সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেন, এমন হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে ভারত ও বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের উদ্যোগ প্রয়োজন। সাধারণত অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার ও গরু পাচারকে কেন্দ্র করে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে। তাই সীমান্ত পারাপার সহজ ও গরু রফতানি আইনসিদ্ধ করা হলে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডও বন্ধ হয়ে যাবে। এতে উভয় দেশের সরকার ও লাভবান হবে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণ ইসলামবিরোধী। নিরীহ লোকজনকে হত্যা করা ও আত্মঘাতী বোমা হামলা তথা আত্মহত্যা করা সম্পূর্ণ হারাম। এ সম্পর্কে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে সুস্পষ্ট ফতওয়া প্রকাশ করা হয়েছে।
সবশেষে তিনি বাংলাদেশের উলামায়ে হক্কানি সম্পর্কে বলেন, মুসলমানরা যাতে ভালো পথ খুঁজে পান, সেজন্যে আলেমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। জমিয়ত বা খেলাফত যে-কোনো নামেই ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন।