ডেস্ক রিপোর্টঃ সুনামগঞ্জ জেলা সম্মেলনকে ঘিরে আগে থেকেই উত্তেজনা ঘনীভূত হচ্ছিল। কমিটি ঘোষণার পর সেই উত্তেজনা ফেটে পড়লো। হৈ চৈ হট্টগোল, চেয়ার ছোড়াছুড়ি, ভাঙচুরে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঢাকা থেকে যাওয়া কেন্দ্রীয় নেতারা অবশেষে পুলিশ পাহারায় নিরাপদে সরে আসেন। এলাকায় এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই চলছিল প্রস্তুতি। শহরের পুরাতন বাসস্টেশন থেকে উকিলপাড়া এলাকা পর্যন্ত যান চলাচলে ছিল পুলিশের নিষেধাজ্ঞা। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে মোতায়েন ছিল অতিরিক্ত পুলিশ। নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকে সরকারি জুবীলি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। দীর্ঘ ১৮ বছর পর আয়োজন করা হয়েছে জেলা সম্মেলন।
সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দুই বলয় যেমন প্রচারণায় ছিল ব্যস্ত তেমনি ছিল চাপা উত্তেজনা। আওয়ামী লীগ সভাপতি মতিউর রহমান, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা মুকুট ও মেয়র আয়ূব বখ্ত জগলুলসহ অন্যরা এবং অন্য বলয়ে ছিলেন কেন্দ্রীয় আ.লীগের উপদেষ্টা ও সুনামগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, অর্থ-পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ও সুনামগঞ্জ ৩ আসনের সাংসদ এমএ মান্নান, সুনামগঞ্জ ৫ আসনের সাংসদ মুহিবুর রহমান মানিক, সুনামগঞ্জ ১ আসনের সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সুনামগঞ্জ-মৌলভাবাজার আসনের সাংসদ শামছুন নাহার বেগম(শাহানা রব্বানী) ও জেলা পরিষদ প্রশাসক ব্যরিস্টার এম এনামুল কবির ইমন।
সকাল গড়িয়ে ঘড়িতে সময় দুপুর ১টা। নুষের ঢল। তিন স্তরের নিরাপত্তা। ছিল পুলিশের সিসি ক্যামেরারও।
প্রথমে মাঠে অবস্থান নেয় মতিউর-মুকুট বলয়ের নেতাকর্মীরা। ছাত্র নেতা রঞ্জিত চৌধুরী রাজন উপস্থাপনা শুরু করেন। ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্য দেন। কিন্তু পৌনে ২টায় মাঠের নিয়ন্ত্রণ নেয় প্রতিদ্বন্দ্বী এমএ মান্নান ও মুহিবুর রহমান মানিকসহ ব্যারিস্টার ইমনের লোকজন। এসময় বিচ্ছিন্নভাবে দুই বলয়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। মঞ্চে উঠা নিয়েও হয় ধাক্কাধাক্কি। তখন নেতারাও মঞ্চে।
পরে বেলা সোয়া ২টায় উপস্থিত হন জেলা আওয়ামী লীগ সাংসদের নেতৃত্বাধীন অপর বলয়ের নেতারা।
মাঠে পৌঁছাতেই তাদের সাথে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে মুকুট বলয়ের কর্মী-সমর্থকরা। এতে আহত হন সুনামগঞ্জ ৫ আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক। পরে তারা পুলিশের সহায়তায় মঞ্চে ওঠেন। কিন্তু তাদেরকে চেয়ার দিতে নারাজ মতিউর বলয়। এসময় ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
এর কিছুক্ষণ পরেই মঞ্চের সামনে জেলা আওয়ামী লীগের দুই বলয়ের কর্মী-সমর্থকদের মাঝে উত্তেজনা দেখা দিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এসময় আহত হন সদর উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক গৌতম বনিক।
বেলা আড়াইটার দিকে উপস্থিত হন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাসান মাহমুদ, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ড. বদিউজ্জামান ভ‚ইয়া বাবুল, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ।
পরে জেলা সভাপতি মতিউর রহমানের সভাপতিত্বে ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা মুকুটের উপস্থাপনায় শুরু হয় সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা।
এর আগে সম্মেলন বানচাল করার চেষ্টায় সুনামগঞ্জ সিলেট সড়কে কেন্দ্রীয় নেতাদের গাড়ি আটকানোর সিদ্ধান্ত নেয় একটি পক্ষের কর্মী-সমর্থকরা। এ খবর পেয়ে সিলেট বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে করে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করেন সৈয়দ আশরাফসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সুনামগঞ্জ পুলিশ লাইনে পৌঁছান। সেখান থেকে সার্কিট হাউজে গিয়ে দুপুরের খাবার খান।
দুপুর আড়াইটায় সম্মেলনে যোগ দেয়ার পর ‘মুকুট ভাই, মুকুট ভাই’ স্লোগানের জন্য বক্তব্য দিতে বাধাগ্রস্ত হয়ে মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, ‘জীবনে অনেক সম্মেলনে যোগ দিয়েছি কিন্তু আজকের মতো এতো বিশৃঙ্খলা আমি আর অন্য কোথাও দেখিনি। তিনি স্লোগান বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করে বলেন, ‘স্লোগান দিয়ে কখনো নেতা বানানো যায় না।‘
এরপর প্রধান অতিথির বক্তব্যে সৈয়দ আশরাফ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ওয়ার্ড থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজ রাখেন। আওয়ামী লীগের কার কী যোগ্যতা আছে তার খবর শেখ হাসিনা রাখেন। যারা যোগ্য তাদের হাতেই দলীয় সভানেত্রী ইউনিটের নেতৃত্ব তুলে দেন। তার মনোনীত ব্যক্তি মেনে নিয়েই সংগঠন শক্তিশালী ও গতিশালী করতে হবে। নতুনদেরকে জায়গা করে দিতে হলে জেলা পর্যায়ে যথা সময়ে সম্মেলন করতে হবে।’ তিনি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ১৮ বছর ধরে না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেন।
পরে তিনি বলেন, ‘আমাকে নেত্রী দুইজন লোকের নাম পছন্দ করে দিয়েছেন, তার পক্ষ থেকে আমি তাদের নাম ঘোষণা করছি, আশা করি আপনারা দলের সভানেত্রী মনোনীত ব্যক্তিদের হাতেই আওয়ামী লীগের সুনামগঞ্জ জেলা শাখা পরিচালনার দায়িত্বভার তোলে দিতে সমর্থন দেবেন।‘
এ কথা বলে তিনি নতুন কমিটির সভাপতি হিসেবে মতিউর রহমানের নাম ঘোষণা করেন। দলের সাধারণ সম্পাদক পদে তিনি আগের কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নুরুলহুদা মুকুটকে বাদ দিয়ে ব্যরিস্টার এম এনামুল কবির ইমনের নাম ঘোষণা করেন।
এরপরেই সম্মেলন প্রাঙ্গণে শুরু হয় তাণ্ডব। মুকুট লাঠিসোটা নিয়ে এলোপাথারিভাবে লোকজনকে পেটাতে থাকে। চেয়ার ভাঙচুর ও ফেস্টুন ছিঁড়তে থাকে। ‘নতুন কমিটি মানি না- মানি না’ বলে চিৎকার করতে থাকে।
এসময় পুলিশি পাহারায় মঞ্চ থেকে নামানো হয় মন্ত্রী ও এমপিদের। ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমনকেও নিয়ে আসা হয় পুলিশি বেষ্টনির মধ্য দিয়ে। সামনের সড়কে লাঠি হাতে অবস্থান নেয় মুকুট সমর্থকরা। তারা লাঠি নিয়ে সড়কের আশে পাশে টানানো ফেস্টুন ভাঙচুর করতে করতে শহরের আলফাত স্কায়ারের দিকে এগুতে থাকে।
মুকুট সমর্থকদের অন্য একটি দল মাঠের সামনে লাঠি নিয়ে অবস্থান নেয়। অবস্থা বিবেচনায় মন্ত্রী ও এমপিদেরকে পুলিশি বেষ্টনির মধ্য দিয়ে সম্মেলনের মাঠে থাকা পুলিশের সাব সেন্টারে নিয়ে আসা হয়।
পরে কঠোর নিরাপত্তায় তাদেরকে সম্মেলনের মাঠ থেকে আলফাত স্কয়ার হয়ে পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। বেলা ৫টার দিকে সুনামগঞ্জ ত্যাগ করেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
এদিকে, নুরুল হুদা মুকুটকে সাধারণ সম্পাদক না করায় শহরের রমিজ বিপনীস্থ জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান নেয় কিছু নেতাকর্মীরা। বর্তমানে শহরে থমথমে ভাব বিরাজ করছে।
সম্মেলনের ব্যাপারে নতুন কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়া ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন বলেন‘ ‘আমার এবং আমার লোকজনের সাথে ইচ্ছেকরে মুকুট সমর্থিতরা বারবার ঝামেলা করতে চেয়েছে, তারা সম্মেলনটাকে পণ্ড করার অনেক চেষ্টা করেছে, কিছু ছেলেরা আওয়ামী লীগের নাম ভাঙ্গিয়ে শহরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়, তাদেরকে মঞ্চের সিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে যেনো তাদের লোকজন ছাড়া কেউ মঞ্চে উঠতে না পারে, আমরা সুন্দরভাবে কাউন্সিল সম্পন্ন করতে পেরেছি, তবে কিছু ছেলেরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে মেনে না নিয়ে সাধারণ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করেছে, তারা লাঠিসোটা নিয়ে ভাঙচুর চালিয়েছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের পথরোধ করার চেষ্টা করেছে, আমাদেরকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেকভাবে সহযোগিতা করেছে, তাদের সহযোগিতায় আমরা দীর্ঘ ১৮ বছর পর জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল আয়োজন ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি, আমি জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ, আমি সকল নেতাকমীদের কাছে কৃতজ্ঞ।’