সিলেট উইমেন্স হাসপাতালের বিরুদ্ধে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা
ডেস্ক রিপোর্টঃ চিকিৎসা অবহেলায় অঙ্গহানির অভিযোগে সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিরুদ্ধে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে বাংলাভিশনের সিলেট অফিসের স্টাফ ক্যামেরাপার্সন বদরুর রহমান বাবর সিলেটের যুগ্ম জেলা জজ দ্বিতীয় আদালতে এ মামলাটি দায়ের করেন।
মামলায় তাঁর শিশুপুত্রে সাফির চিকিৎসায় অবহেলা করে আঙ্গুলে ‘গ্যাংরিন’ হওয়ায় মৃত্যু আশঙ্কা সৃষ্টি করার জন্য ২৫ লাখ টাকা, গ্যাংরিন হওয়ায় আঙ্গুল কেটে ফেলার ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৫ লাখ টাকাসহ দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসাসহ আনুষঙ্গিক খরচসহ ৫০ লাখ টাকার হিসেব দাখিল করা হয়। চিকিৎসা চলমান থাকায় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ পরবর্তীতে আরো বাড়তে পারে বলে মামলার আবেদনে উল্লেখ করা হয়।
মামলায় আসামী করা হয়েছে হলি সিলেট হোল্ডিংস লিমিটেড (সিলেট উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল) এর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ড. ওয়ালী তছর উদ্দিন, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. মজম্মিল আলী (সানু), পরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. মোজাম্মেল, সিলেট উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থপেডিক্স ও সার্জারি বিভাগের রেজিস্টার ডা. জাবের আহমদ, অর্থপেডিক্স সার্জারি বিভাগের এমও ডা. তানভীর আহমদ চৌধুরী, ইন্টার্ন শাফিনাজ মোস্তফা, অর্থপেডিক্স ও সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. কাজী মো. সেলিম, অর্থপেডিক্স ও সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মাহমুদ হাসান, ব্রাদার তারেক।
মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ১৮ জানুয়ারি বাসার দরজার হেজবল্টে চাপ লেগে আঘাতপ্রাপ্ত হয় সাংবাদিক বাবরের ছেলে সাফি। ডানহাতের তর্জনীতে রক্তক্ষরণ শুরু হলে বাসার পার্শ্ববর্তী সিলেট উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় জরুরী বিভাগের দায়িত্বরত ব্রাদার তারেক সাফির আঙ্গুলের গোঁড়ায় একটি রাবার ব্যান্ড বেধে আঘাতপ্রাপ্ত স্থান পরিষ্কার করেন। পরবর্তীতে ডা. সৈয়দ মাহমুদ হাসানের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালের ৫ তলায় অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালের অর্থপেডিক্স ও সার্জারি বিভাগের রেজিস্টার ডা. জাবের আহমদের উপস্থিতিতে ডা. শাফিনাজ ও ডা. তানভীর শিশু সাফির আঙ্গুলে সেলাই ও ব্যান্ডেজ করেন। এ সময় সাফির মা পারুল বেগম রাবার ব্যান্ড না খুলে ব্যান্ডেজ করার কারণ জানতে চাইলে রেজিস্টার ডা. জাবের আহমদ তার সাথে দুর্ব্যবহার করে বলেন, ‘ডাক্তার আমরা, না আপনি?’
অপারেশন চলাকালে ডা. শাফিনাজ ও ডা. তানভীর মনোযোগী ছিলেন না। তারা একে অপরের সাথে ঠাট্টা মশকরা করছিলেন। এবং মোবাইল ফোনে ভিডিও দেখছিলেন। অপারেশনের পর সাফিকে হাসপাতালের ৫০৫ নং কেবিনে সাফিকে নেওয়ার পর ডা. জাবের বাসা কাছে থাকায় সাফিকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। হাসপাতালের সমূদয় বিল পরিশোধ করে সাফিকে সন্ধ্যায় বাসায় নিয়ে যান সাংবাদিক বাবর।
হাসপাতালের ছাড়পত্রে ৩ দিন পর ড্রেসিংয়ের জন্য অর্থোপেডিক্স বহির্বিভাগে দেখানোর জন্য বলা হয়। কিন্তু বাসায় যাওয়ার পর সাফির হাতের ব্যথা না কমায় দু’দিন পর (২০ জানুয়ারি) হাসপাতালের বহির্বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডা. মহসিন সাফিকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এ সময় হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় নিজাম ব্যান্ডেজ খুলে আঙ্গুলে রাবার ব্যান্ড দেখে আবারো ডা. মহসিনের কাছে নিয়ে যান। পরবর্তীতে ডা. মহসিন হাসপাতালের ৫ম তলায় ডা. কাজী সেলিমের কাছে নিয়ে যান সাফিকে। সাফিকে দেখে ডা. কাজী সেলিম হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স ও সার্জারি বিভাগের রেজিস্টার ডা. জাবের আহমদকে ডেকে এনে সাফির হাতের অবস্থা দেখান। এতে হতভম্ব ডা. জাবের অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান সাফিকে। সেখানে আঙ্গুলের রাবার ব্যান্ড কেটে পরদিন আবারো ড্রেসিং করানোর অনুরোধ জানান ডা. জাবের। ভুল চিকিৎসায় সাফির আঙ্গুল নষ্ট করা হয়েছে বলে সাংবাদিক বদরুর রহমান বাবর উত্তেজিত হয়ে উঠলে চিকিৎসায় অবহেলার কথা স্বীকার করেন ডা. জাবের। সাফির পরবর্তী সকল ড্রেসিং নিজে করবেন বলেও জানান ডা. জাবের। এবং এতে কোনো সমস্যা হবে না বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
পরবর্তীতে ডাক্তারের কথা অনুযায়ী কয়েকবার উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ড্রেসিং করা হয় সাফির ক্ষতস্থান। এক পর্যায়ে ক্ষতস্থানে পুঁজ জমলে উইমেন্স হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতালের অর্থপেডিক্স ও সার্জারি বিভাগের রেজিস্টার ডা. জাবের আহমদ হাসপাতালের প্যাডে মেডিএইড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্লাস্টিক সার্জন ডা. আবদুল মান্নানের কাছে রেফার্ড করেন। ওই দিনই ডা. মান্নানের কাছে সাফিকে নিয়ে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ক্ষতস্থানে গ্যাংরিন হওয়ায় ডানহাতের তর্জনী আঙ্গুল কেটে ফেলার জন্য বলেন। এদিকে সাফির আঙ্গুল যাতে রক্ষা করা যায় তার জন্য সাফির পিতামাতা তাকে নিয়ে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে গেলে সেখানেও হাতের আঙ্গুল কেটে ফেরার জন্য বলা হয়।
এতে নিরাশ হয়ে সিলেট ফিরে সাফিকে ডা. আবদুল মান্নানের তত্ত্বাবধানে মাউন্ট এ্যাডোরা হাসপাতালে ভর্তি করে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি অপারেশনের মাধ্যমে ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়। এ ঘটনায় সাংবাদিক বাবর সিলেটের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতে মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক নুরুল আলমের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ২০১৫ সালের ২৮ জুলাই প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠনের তারিখ ধার্য করেছেন।
মামলার বাদী বাংলাভিশনের সিলেট অফিসের স্টাফ ক্যামেরাপার্সন বদরুর রহমান বাবরের আইনজীবী এডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সিলেট উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিশু সাফির চিকিৎসাকালে সংশ্লিষ্টরা চরম অবহেলার পরিচয় দিয়েছেন। ছাড়পত্র লেখার সময় শিশু সাফির পিতার নামের স্থলে তানভীরের নাম লেখা হয়। এছাড়া নিজেদের অপরাধ ঢাকতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন আকারে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করে। শিশু সাফির চিকিৎসা চলমান। ক্ষতিপূরণের দাবি আরো বাড়তে পারে।
এ ব্যাপারে মামলার বাদী বাংলাভিশনের সিলেট অফিসের স্টাফ ক্যামেরাপার্সন বদরুর রহমান বাবর জানান, চিকিৎসকদের অবহেলার কারণে আমার ছেলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে না। সে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করতে পারবে না। হাসপাতালে অবহেলাপূর্ণ চিকিৎসাই এর জন্য দায়ি।
মামলার বাদীপক্ষে আদালতে উপস্থিত ছিলেন এডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী, এডভোকেট মুহাম্মদ তাজ উদ্দিন, এডভোকেট মো. আবুল হাসান, এডভোকেট সজল কুমার রায়, এডভোকেট সরওয়ার হোসেন খসরু, এডভোকেট মো. সাইফুল ইসলাম, এডভোকেট শহিদুল হক লাহিন, এডভোকেট মুজিবুল হক জাবেদ প্রমুখ আইনজীবী।