নানা সঙ্কটে ওসমানী হাসপাতাল : দালাল, টাউট-বাটপারদের দৌড়াত্ম বৃদ্ধি
ডেস্ক রিপোর্ট :: রোগীর চাপ সামলাতে হিমশি খাচ্ছে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ৯শ শয্যার এই হাসপাতালটি এখন অতিরিক্ত রোগীর যাতাকালে। সঙ্গে আছে রোগীর একাধিক সহায়তাকারী, হাজার হাজার দর্শনার্থী। আছে দালাল, টাউট-বাটপারদের দৌড়াত্ম। নিত্য সঙ্গি লোকবল আর ঔষধ সংকট। ফলে তিলধারণের ঠাই নেই হাসপাতালে।এমন নানা সঙ্কটে সিলেট বিভাগের নাগরিকদের চিকিৎসা সেবার প্রধান এই ভরসাস্থল।
৯শ শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছেন দুই হাজারেরও অধিক রোগী। ওয়ার্ডের ভেতরকার শয্যা ছাড়াও মেজে, বরান্দা সব স্থানেই রোগী। ২৬টি ওর্য়াডে ৫শ’ শয্যার চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফ দিয়ে চলছে ৯শ শয্যার বিপরীতে দুই হাজার রোগীর সেবা। সবকিছু শামাল দিতে মারাত্মক হীমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। কয়েকগুন বেশি রোগীর চাপই এই হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার প্রধান অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে।
এ অবস্থায় কেউ চিকিৎসা পাচ্ছেন কেউ পড়ে আছেন দিনের পর দিন। এমন পরিস্থিতির জন্য ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী, দর্শনার্থী ও চিকিৎসক সংকটসহ বিভিন্ন দূর্বলতাকে দায়ি করেছেন ভূক্তভোগীরা। রোগী ও দর্শনার্থী প্রসঙ্গে ‘ওসমানী হাসপাতাল ইজ অভার লোডেড’ বলে মন্তব্য করেন এক কর্মকর্তা। অনেকেই বলেছেন, অতিরিক্ত লোক ও রোগীর কারণে হাসপাতাল একটি আশ্রয় কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। পরিস্কার পরিচ্ছনতা রাখা ও সঠিক চিকিৎসা দেওয়া এখন দু:সাধ্য। একজন চিকিৎসককে ১ থেকে ২শ’ রোগী দেখতে হয়। ঠিক একজন সেবিকা বা সেবককেও। অতিরিক্ত রোগী ও দর্শনাথীকে কেন্দ্র করে সেখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরণের সিন্ডিকেট। কেউ ওষুধ পাচারে, কেউ দালালীতে ও কেউবা গেট বানিজ্যে ব্যস্ত। নানা সমস্যা ও সংকটের মধ্যে অভিযোগ পিছু ছাড়েনা ডাক্তারসহ স্টাফদের বিরুদ্ধে। তাদের ব্যবহার, আচার-আচরণ, কথাবর্তায় ক্ষুব্দ ও নাখোশ রোগী এবং তাদের স্বজনরা। এছাড়া তুচ্ছ ঘটনায় প্রায়ই ধর্মঘটের ডাক দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। সর্বশেষে বুধবার রাতে রোগীর গর্ভে শিশুর মৃত্যু নিয়ে স্বজনের সঙ্গে ইন্টার্নি চিকিৎসকদের ঝামেলার পর ধর্মঘটের ডাক দেন চিকিৎসকরা।
১৯৯৮ সালের ১৭ জুন ৫০০ শয্যার ওসমানী হাসপাতালকে ৯০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। তবে সে অনুযায়ী বাড়ানো হয়নি অবকাঠামো-সুবিধা। শুধু ৯শ শয্যার পথ্য সরকরাহ করা হচ্ছে। লোকবল রয়ে গেছে ৫শ শয্যার। ১ হাজার ৯৮২ জন লোকজলের বিপরীতে আছেন ৯৩৬ জন। প্রতিদিন আন্ত:বিভাগ ও বর্হিবিভাগ মিলিয়ে ৪ হাজার রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন ১৭৭ জন চিকিসক। ১১১ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী দফায় দফায় কাজ করেন। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত রোগী ও দর্শনার্থীর কারণে মুহুর্তের মধ্যে অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে সংকটে আছে আইসিইউ ইউনিট। পর্যাপ্ত লাইফ সাপোর্ট মেশিন না থাকায় সেবা সম্ভব হচ্ছেনা। আশার কথা হচ্ছে আইসিইউতে ৫টি ভেন্টিলেটর বরাদ্ধ হয়েছে। মেশিন আসলে লাইফ সাপোর্ট সেবা আরও বাড়বে।
সূত্রমতে, একজন রোগী ইমার্জেন্সিতে আসার পর শুরুতে তাকে ভর্তি বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ইমার্জেন্সিতে দায়িত্বরত চিকিৎসক মুমুর্ষূ রোগী এলেও যেনো গায়ে মাখেন না। কোনো মতে দেখতে পারলেই যেনো বাঁেচন। এর পর র্ভর্তির জন্য পড়তে হয় লাইনে। এখানে দালালও কম নয়। ভর্তি রেজিস্ট্রার মেইনটেইনকারীরা ভর্তি ফিও নেন অতিরিক্ত। ১৫ টাকার স্থরে ভাংতি নেই অজুহাতে প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে ২-১০ টাকা বেশি রাখেন। রোগীর সঙ্গে গেট পাস থাকার পর গেটম্যান বাধা দেয়। শুধু রোগী ও তার স্বজনরা নয়। দর্শনাথীকে ওয়ার্ডে প্রবেশ করতে হলে ৫-২০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়। বেসরকারি সংস্থার লোকদিয়ে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকারী এসব কম বেতনের কর্মীরা হাসপাতালে বানিজ্যে মেতে উঠে। ওয়ার্ডে সিট ও ডাক্তার দেখানোর নাম করে আরেক শেণীর দালাল সুবিধা আদায় করে আসছে। ওয়ার্ডে শয্যা নেই। তারপরও দালাল ও এমএলএসসহ ওয়ার্ড বয়দের সহায়তায় ২-৫ শ টাকার বিনিময়ে বেড পাওয়া যায়। গত এক বছরে এমন অভিযোগে কয়েকজন কর্মচারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে হাসপাতালের উপপরিচালক আবদুস ছালাম অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সেবা দিতে আমাদের আন্তরিকতার কোনো ত্রুটি নেই।
সবচেয়ে বড় সমস্যা বিভিন্ন ফার্মেসির নিয়োগ করা দালালরা। ২৫-৩০ জন দালাল প্রতিদিন লেভার ওয়ার্ডের সামনসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিদ্যমান থাকে। এরা সুযোগ পেলেই রোগীর স্বজনকে কম দামে, বাকিতে ঔষধ কেনার কথা বলে ভাগিয়ে নেয়। গত জানুয়ারিতে ছাতকের নোয়ারাই থেকে আসা ডেলিভারী রোগীর আত্মীয় জাহেদ জানান, ৭ টাকার ওষুধ ১৯ শ টাকা রাখে হাসপাতালের সামনে সিদ্দিকিয়া নামের ফার্মেসি। এক দালালের মাধ্যমে ওই ঔষধ কেনা হয়েছিল। তিনি দাবি করেন ডাক্তার কর্তৃক ঔষধের স্লিপ পরিবর্তন করে বেশি ঔষধ ধরিয়ে দেয় তারা। একজন ডেলিভারি রোগীকে অপারেশনের জন্য একাধিকবার ঔষধ কেনানো হয়। অপহৃত ঔষধ ফেরত দেওয়া হয় না।
শুধু জাহেদ নয়, এমন অভিযোগ অধিকাংশ ডেলিভারী রোগীর। তারা জানান, ঔষধ চুরির সঙ্গে স্টাফরা জড়িত। চুরি হওয়া ঔষধ আবার ফার্মেসিতে বিক্রি হয়। বালাগঞ্জ থেকে আসা গৃহ বধু আসমার ভাই রফিক জানান, ডেলিভারীর আগে ৩ বার ঔষধ কেনানো হয়। এরমধ্যে ছেচাট বড় স্যালাইন ৫ টা। কিন্তু আধঘন্টার মধ্যে কি করে ৫ টা স্যালাইন ব্যবহার হলো।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাইরের ফার্মেসীর সাথে চুক্তি করে দালালরা রোগীর স্বজনদের ঔষধ কেনায়। এতে তারা ৩০ ভাগ কমিশন পায়। ফার্মেসির দালাল ছাড়াও ব্লাড ব্যাংকের সামনে ৩-৪ জন দালাল নিয়োজিত থাকে। তারা ২ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা করে ব্যাগ কিনে দেয়। হাসপাতালের পুলিশ পুলিশ ফাড়ির সদস্যরা অপরাধ প্রতিরোধের চেয়ে দান্ধা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ওয়ার্ডে কর্তব্যরতদের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। ডাক্তারদের সব সময় মিলেনা। নার্স, ব্রাদার্স ও ওয়ার্ড বয়দেরও একই অবস্থা।
সুনামগঞ্জ থেকে আসা আবুল কালাম জানান, তিনি ৩ সপ্তাহ ধরে ১৫ নং ওয়ার্ডে তার ভাইকে নিয়ে আছেন। স্টাফদের ভাব দেখলে মনে হয় তারা সবাই ডাক্তার। কাউকে প্রয়োজনে ডাকলে মিলেনা। অবশ্য তিনি রোগী বেশির কারণে সঠিক চিকিৎসা মিলেনা বলে মন্তব্য করেন। সরজমিন হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, রোগীদের দুরাবস্থা। কোথাও যেনো ঠাই নেই। যত্রতত্র রোগী। বাথরুম গুলো অপরিচ্ছন্ন। ফলে রোগী চিকিৎসা নিতে এসে আরও রোগী হচ্ছে।
ওসমানী হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার আব্দুস সবুর মিঞা জানান, হাসপাতালে কোথাও কোনো অনিয়ম হচ্ছেনা। সঠিক সেবা দিতে সবাই চেষ্ঠা করছেন। অনিয়ম হলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। দালাল প্রসঙ্গে তিনি জানান, এখন আর কেউ নেই। নিয়মিত অভিযান হয়। তুচ্ছ ঘটনায় ইন্টার্ণ চিকিৎসকদের ধর্মঘট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেউ কেউ ইস্যু তৈরী করে হাসপাতালের সেবা বিঘিœত করতে চায়। বাহির থেকে এসে ঝামেলা সৃষ্টি করে।