পন্ডিত তুষার দত্তের সুরের মূর্ছনায় ধ্রুপদি সংগীত সন্ধ্যায় মুগ্ধ শ্রোতা
সিলেটের রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তাই সবসময়ই এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সংগীতের প্রতি এখানকার মানুষের রয়েছে নীবিড় সম্পর্ক। সংগীতের বিভিন্ন শাখার মধ্যে অন্যতম একটি ধ্রুপদি সংগীত। সুপ্রাচীন এই সংগীত ধারা সচরাচর পরিবেশিত না হলেও এর প্রতি শ্রদ্ধেয় আকর্ষণের কমতি নেই সংগীতবোদ্ধা ও সংগীত পিপাসু মানুষের।
গতকাল মঙ্গলবার রিকাবীবাজার কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে সেই চিত্রই ফুটে উঠল ধ্রুপদি সংগীত সন্ধ্যা পন্ডিত তুষার দত্তের পরিবেশনায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ধ্রুপদি সংগীত সন্ধ্যার আয়োজনে গীতবিতান বাংলাদেশ। এতে আমন্ত্রিত শিল্পী হিসাবে সংগীত পরিবেশন করেন ভারতের প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী পন্ডিত তুষার দত্ত। তার সাথে তবলায় সঙ্গ দেন সিলেটি বংশদ্যুত যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিশিষ্ট তালযন্ত্র শিল্পী হিমানিষ গোস্বামী ও হারমোনিয়ামের সঙ্গদেন দেশের আরেক গুণী অলক কুমার সেন।
আয়োজক সংগঠন গীতবিতান বাংলাদেশ অনুষ্ঠানের শুরুতেই আমন্ত্রিত শিল্পীর সম্মানী ১০ মিনিট পরিবেশন করে ভীম পলশ্রী রাগে ধ্রুপদ ও নটমল্লার রাগে তারানা। এরপরই শুরু হয় মূল আয়োজন। গীতবিতান বাংলাদেশের পরিচালক অনিমেষ বিজয় চৌধুরী মঞ্চে আমন্ত্রণ জানান, আমন্ত্রিত শিল্পীত্রয়কে। আমন্ত্রিত শিল্পীদের হাতে ফুলের শুভেচ্ছা উত্তরীয় ও সম্মাননার স্মারক তুলে দেন সিলেটের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বিশিষ্ট শিল্পী হিমাংশু গোস্বামী ও সিলেটের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী হিমাংশু বিশ্বাস। এছাড়াও নজরুল সংগীত শিল্পী পরিষদ সিলেট বিভাগ ও জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী পরিষদ আমন্ত্রিত শিল্পীদের ফুলের শুভেচ্ছা জানান। শুভেচ্ছা জানানোর পর নির্ধারিত মঞ্চে সংগীত পরিবেশনের জন্য শিল্পীবৃন্দ আসন গ্রহণ করেন। পন্ডিত তুষার দত্ত সহ শিল্পীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করেন মু. আনোয়ার হোসেন রনি ও দেবারতি দেব ত্বমা।
পন্ডিত তুষার দত্তের জন্ম বাংলাদেশের নাটোর জেলায়। তিনি সংগীতে হাতেকড়ি নেন শ্রী সন্তোষ চৌধুরীর হাতে। পরে দূর্গাপুরের শ্রী বিমর মিত্রের কাছে শিখেন। আই.টি.সি সংগীত রিসার্চ একাডেমীর স্কলার থাকাকালীন তিনি ১৯৮৩ সালে প-িত এ কানন এবং প-িত অরুণ ভাদুড়ির কাছে ‘কিরানা’ গায়কিতে তালিম নেন। কিছুদিন গুরুবোন বিদূষী শুভ্রা গুহের কাছেও শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে পন্ডিত সুনীল বসুর কাছে নিবিড় তালিম নেন।
তিনি ১৯৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যাযে, জাতীয় প্রতিযোগিতা ‘খেয়াল’ এ প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর থেকে তার সংগীত জীবনের ঝুলিতে যুক্ত হয় বিভিন্ন সম্মান ও দেশ-বিদেশের অসংখ্য ভক্তশ্রোতা ও শীর্ষের ভালোবাসা। তার অসংখ্য মিউজিক এ্যালবাম শ্রোতাদের মন জয় করেছে। আমন্ত্রিত তালযন্ত্র শিল্পী হিমানিষ বিশ্বাস, বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী হিমাংশু গোস্বামী ও প্রীতি গোস্বামীর সুযোগ্য সন্তান। তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ৯বছর বয়সে তার তবলা প্রশিক্ষণ শুরু হয়। বর্তমানে তিনি বেনারশ ঘারানার পন্ডিত কুমার বোস এর কাছে তবলায় তালিম নিচ্ছেন। তিনি যুক্তরাজ্য ছাড়াও অন্যান্য দেশে তার পরিবেশনার মধ্য দিয়ে দর্শকের প্রশংসা করান। হিমানিষ মিডল সেক্স ইউনিভার্সিটি থেকে ফিলসপি এন্ড মিডিয়ায় অনার্স ডিগ্রী লাভ করেন। আমন্ত্রিত শিল্পী অলোক কুমার সেন নরাইলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০০৯ সাল থেকে পন্ডিত তুষার দত্তের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে চলছেন। অলোক সেন বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে শাস্ত্রীয় সংগীত সহ বিভিন্ন ধারার গান পরিবেশন করে থাকেন। ২০১৪ সালে তিনি শান্ত মরিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. মিউজিক এ প্রথম স্থান লাভ করে চ্যান্সেলর গোল্ড মেডেল পান।
গতকাল সংগীত সন্ধ্যায় পন্ডিত তুষার দত্ত শুরুতেই ইমন রাগে বিলম্বিত খেয়াল পরিবেশন করেন। একে একে তিনি রাগ ঝিঝিট, মান্দরাগে ঢোল পরিবেশন করেন। উস্তাদ রাশিদ খান এর সুরে রিমঝিম বরষার কেন এলেনা মৌলিক গানের পরিবেশনের মধ্য দিয়ে তিনি হল ভর্তি দর্শকশ্রোতাদের মাতিয়ে রাখেন। তার সর্বশেষ পরিবেশনা শেষ করেন কবি নজরুলের গান দিয়ে। তার চমকপ্রদ পরিবেশনা ধ্রুপদি সংগীত সন্ধ্যাকে প্রাণবন্ত করে তুলে। প্রায় ২ঘন্টা ব্যাপী পরিবেশনা চলাকালীন পুরো হল ভর্তি দর্শক পিনপতন নীরবতায় মুগ্ধ হয়ে ডুবে থাকেন সুরের মূর্ছনায়। প-িত তুষার দত্তের সাথে তবলায় অনন্য সুন্দর পরিবেশনা করেন সিলেটি বংশদ্যুত যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিশিষ্ট তালযন্ত্র শিল্পী হিমানিষ গোস্বামী।
উপস্থিত শ্রোতারা ধ্রুপদি সংগীতের আরো বৃহত্তর আয়োজনের আশা প্রকাশ করে ধ্রুপদি সংগীতের ধারাকে আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কথা ব্যক্ত করেন।