বইমেলা : জাগৃতির দীপন নেই, ছবি আছে!
ডেস্ক রিপোর্টঃ বছর ঘুরে আবারও বইমেলা, বইপ্রেমি বাঙালির মিলনমেলা। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই মাসব্যাপী এ মিলনমেলা চলবে ফেব্রুয়ারির শেষ দিন পর্যন্ত।
বইপ্রেমি বাঙালির এ মিলনমেলা যতখানি উচ্ছ্বাসে শুরু হওয়ার কথা ছিল এবার তা হচ্ছে না অনেকটাই। কারণ গত বছরের বইমেলার ২৬তম দিনে (২৬ ফেব্রুয়ারি) মেলা থেকে ফেরার পথে ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের চাপাতির আঘাতে খুন হন বিজ্ঞান লেখক, ব্লগার, গবেষক ডক্টর অভিজিৎ রায়। এরপর একই বছরের ১২মে সিলেটে খুন হন আরেকজন বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয় দাশ। খুন হন ব্লগার ওয়াশিকুর বাবু, নিলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিল (নিলয় নীল) এবং ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় নিজ প্রতিষ্ঠানে খুন হন অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন। তিনি তার জাগৃতি প্রকাশনী থেকে অভিজিতের জনপ্রিয় বই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ প্রকাশ করেছিলেন। একই দিনে চাপাতির আঘাতে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশিদ টুটুল, লেখক রণদীপম বসু ও তারেক রহিম।
এবার বইমেলা আবারও শুরু হচ্ছে দীপনকে ছাড়া, টুটুলও নেই দেশে। আসছে না অভিজিৎ রায়ের নতুন কোন বই, একই অবস্থা অনন্ত বিজয় দাশেরও। অনন্ত বিজয়েরও নতুন কোন বই আসবে না।
দীপন কিংবা টুটুল না থাকলেও তাদের প্রকাশনা সংস্থাগুলো আছে বইমেলায়, আর আছে কেবল ছবি। জাগৃতি প্রকাশনী ও শুদ্ধস্বর আছে যথাক্রমে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের ১৭৩, ১৭৪ ও ১৭৫ নং এবং ৩৭০, ৩৭১ ও ৩৭২ নং স্টল নিয়ে।
জাগৃতির প্রকাশনীর স্টলের ভেতরে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের হাসিমাখা মুখের আলোকচিত্র। ছবির নিচে জীবনানন্দ দাশের কবিতার দুই লাইন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা…’। ওপরেও সাদা-কালোর আবরণে থাকছে দীপনের ছবি। আর বিদ্রোহের লাল রঙের মাঝে শোকের কালো রঙের ছোঁয়ায় সাজানো হয়েছে টুটুলের শুদ্ধস্বরের স্টল।
বইমেলায় বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে নিহত প্রকাশক দীপনের স্মরণে কিছুই করা হচ্ছে না, কোন উদ্যোগও নেই প্রকাশকদের পক্ষ থেকে।
বইমেলার পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে কি কোন আয়োজন থাকছে নিহত লেখক-প্রকাশকদের উদ্দেশে এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শনিবার (৩০ জানুয়ারি) বলেছেন, ‘আমরা বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে কোনো কিছু করছি না। তাদের প্রকাশনার জন্য স্টল নির্ধারণ করে দিয়েছি। তারা চাইলে সেখানে তাদের ছবি রাখতে পারে।’
মেলার উদ্বোধনের দিন তাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা যায় কি না সাংবাদিকদের এমন প্রস্তাবের জবাবে শামসুজ্জামান খান প্রধানমন্ত্রী আসবেন এ অজুহাত দেখিয়ে বলেন, ‘উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আসবেন। ওইদিনের সব বিষয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী এসএসএফ দেখবে।’
এদিকে, একই দিন সংবাদ সম্মেলনে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অনেকটা হুশিয়ারির সুরে প্রকাশকদের ‘উস্কানিমূলক লেখা’ প্রকাশ না করতে ‘সবক’ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলার সময় লেখকদের মেলার আশেপাশের এলাকায় সাবধানে চলাচলের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি কানকথার ওপর ভিত্তি করে ধর্মের অবমাননা হচ্ছে এমন এক অভিযোগে ‘রোদেলা প্রকাশনীর’ স্টল বন্ধ করে দিয়েছিল বাংলা একাডেমি। তখন বাংলা একাডেমির শামসুজ্জামান খান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন- ওদের (রোদেলা প্রকাশনী) একটা বই নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। আমরা ওদের স্টলটা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। তবে তিনি স্বীকার করেন যে বাংলা একাডেমির কেউ বইটি পড়েননি তবে শুনেছেন মহানবীর ওপর কিছু বিরূপ মন্তব্য রয়েছে বইটিতে।
এবার বইমেলায় একাডেমি প্রাঙ্গণে ৮২টি প্রতিষ্ঠানকে ১১১টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩২০টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৪০টি ইউনিট; মোট ৪০২টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৫১টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ১৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ছয় হাজার বর্গফুট আয়তনের ১৫টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে ৯২টি লিটল ম্যাগাজিনকে বর্ধমান হাউসের দক্ষিণ পাশে লিটল ম্যাগাজিন কর্নারে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বইমেলায় প্রতিবারের মত এবারও কয়েক হাজার বই প্রকাশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফায়সাল আরেফিন দীপনের অনুপস্থিতিতে সে প্রকাশনী থেকে ২০টির মত বই আসার সম্ভাবনা রয়েছে। মেলায় জাগৃতি থেকে ফয়সাল আরেফিন দীপনকে নিয়ে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা হবে। এটি সম্পাদনা করছেন সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা। এ ছাড়া রয়েছে দীপনের বাবা আবুল কাসেম ফজলুল হকের বই ‘রাজনীতিতে ধর্ম মতাদর্শ ও সংস্কৃতি’ নামক বই।
জাগৃতি প্রকাশনী ২০টির মত বই আসার সম্ভাবনা থাকলেও শুদ্ধ্বস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশিদ টুটুলের অনুপস্থিতিতে তারা মাত্র ৪/৫টির মত বই আনতে পারে।