পুলিশ, ইলিশ রাজা : জনগন তার প্রজা
মীর আব্দুল আলীম: পুলিশ নাকি জনগণের বন্ধু। পুলিশ জনগণের জানমালের রক্ষাকর্তা; দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বপ্রাপ্তও তারা। কিন্তু জনগণের রক্ষক যখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন কি আর পুলিশ জনগণের রক্ষক আর বন্ধু হতে পারে? জনগণের রক্ষক এ বাহিনীর অনেক সদস্য আজ জড়িয়ে পড়ছেন বহুবিধ অপরাধকর্মে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। ব্যাপক ক্ষমতা পাওয়ার পর দিনদিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে পুলিশ। অবৈধ উপার্জনের জন্য দেশজুড়েই থানা ও ডিবি পুলিশ নিরপরাধীদের ধরে নিয়ে মাদক ব্যবসায়ী বা বিএনপি-জামায়াত-জঙ্গি সাজানোর হুমকি দিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করছে। অন্যথা হলেই জেলজুলম আর নানা হয়রানীর শিকার হচ্ছে সাধারন মানুষ। মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে খোদ রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও যাত্রাবাড়ীর মীরহাজিরবাগে পুলিশের হামলার শিকার হলেন দুই ব্যক্তি। নির্যাতনের শিকার দু’জনই সরকারি কর্মকর্তা। একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগাযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের সহকারী পরিচালক গোলাম রাব্বী। অন্যজন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাস। শুধু এ দুটি ঘটনা নয়, দেশের কোনো না কোনো এলাকায় প্রতিনিয়তই সাধারণ মানুষ অকারণে একশ্রেণীর অসাধু পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। সাধারণত মানুষ কোনো বিপদে পড়লে প্রথমে পুলিশ বাহিনীর দ্বারস্থ হয়। কিন্তু ক্রমেই সে পথ যেন কঠিন হতে চলেছে। আজকাল ‘মাছের রাজা ইলিশ দেশের রাজা পুলিশ’Ñ এমন উক্তিও করছে পুলিশকর্তারা। যা পুলিশের খারাপ আচরনে আরও প্রভাব ফেলবে। মাছের রাজা এখনও ইলিশ আছে কিন্তু ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ কিছুতেই দেশের রাজা হতে পারে না। দেশের জনগন ফুলি (বোঁকা) বলে, পুলিশী রাষ্ট্রের সুবাদে আজ আমাদের দেশে পুলিশ দেশের রাজা বনে গেছে। এটা কারো কাম্য নয়। পুলিশের দৌরাত্ম্যের লাগাম এখনই টেনে ধরা জরুরি। পুলিশ যে কোনো দেশেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটির গুটিকয়েক সদস্যের অপকর্মের জন্য অপবাদ বয়ে বেড়াচ্ছে গোটা পুলিশ বিভাগ। বিদেশে পুলিশ যেখানে মানুষের আস্থা অর্জক করতে সক্ষম হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে ওই আস্থার জায়গা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে যাওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রায় প্রতিদিনই দৈনিক পত্রিকায় দেখা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাজনীতিক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঘরানার ব্যক্তিদের দুর্নীতির খবর জানতে তলব করেন। তারা যদি একবারের জন্য দেশের বিতর্কিত পুলিশদের সম্পত্তির হিসাব তলব করেন তাহলে হয়তো অনেকেরই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। কেবল রাজধানী ঢাকায় বাড়ি-গাড়ির হিসাব কসলে অনেক পুলিশ কর্মকর্তার অপকর্মেও গোমড় ফাঁস হয়ে যাবে। আমরা চাই, পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধ সংশ্লিষ্টতার যেসব অভিযোগ উঠছে তার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করে অভিযুক্ত সব পুলিশ সদস্যের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।
‘একবছরে ১০ হাজার পুলিশের শাস্তি’। পুলিশ সদর দফতরের প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড ডিসিপ্লিন (পিএসডি) শাখার তথ্যের ভিক্তিতে অতিত নিকটে একটি জাতীয় দৈনিকে এমন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৫ সালে পুলিশের বিরুদ্ধে প্রায় ৩০ হাজার অভিযোগ জমা পড়ে পিএসডি শাখায়। তবে এর প্রকৃত সংখ্য অনেক বেশি। কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছেই আশ্রয় খুঁজেছে। আর দীর্ঘদিন থেকেই পুলিশ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে। অপরাধ দমন করাই পুলিশের কাজ। আর সে পুলিশই যদি অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? একের পর এক অপরাধ কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ। কিন্তু পুলিশের অপরাধ তদন্ত করতে গিয়ে ‘অপরাধ’ খুঁজে পায় না পুলিশ। কথিত ইমেজ রক্ষার নামে আড়াল করা হচ্ছে পুলিশের অপরাধ কর্মকা-। অথচ গুটি কয়েকজনের জন্য পুরো বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা অপরাধী পুলিশ সদস্যকে শাস্তি নয়, বাঁচানোর জন্যই নানা চেষ্টা-তদবির করেন। ফলে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে পুলিশ কর্মকর্তারা। তদন্তের নামে চলে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ করা হয়। একপর্যায়ে ভুক্তভোগীরাও হতাশ হয়ে পিছুটান দেয়। আবার ভুক্তভোগীদের ভয়-ভীতি দেখানোও তো হরহামেশাই ঘটছে।
বিশ্বব্যাপী যে কোনো দেশে পুলিশের কাজ অপরাধ দমন। অপরাধ করা নয়। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোয় পুলিশের অপরাধ করার প্রবণতা সাধারণত অপরাধীদের গ্রেপ্তারের পর নির্যাতনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মিথ্যা অজুহাতে এনকাউন্টারের মাধ্যমে কোনো নিরীহ ব্যক্তি বা অপরাধীকে হত্যা করার ঘটনাও বিরল নয়। নারীর শ্লীলতাহানিও এর মধ্যে রয়েছে। ভারতের কয়েকটি রাজ্যে এমন ঘটনার কথা প্রকাশিত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীদের সাজাও হয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় দুই দশক আগে ইয়াসমীন নামে এক কিশোরীকে ধর্ষণ এবং পরে হত্যা ও বিচারের ফলাফল কম-বেশি সবারই জানা আছে। এরপর এক তরুণ যুবককে হত্যার জন্য কয়েক পুলিশকেও আদালত সাজা দিয়েছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় কিছু পুলিশ সদস্যের ভূমিকা ও এসব ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে ঐতিহ্যবাহী এ বাহিনীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশ একটি আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে। একের পর এক অপরাধ কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ।
অতীত নিকটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের মধ্যে অপরাধ, বিশেষ করে অর্থের লোভে অপরাধ সংঘটনের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। অপরাধ দমনে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ, র্যাব, ডিবি পুলিশ নিজেরাই নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত অপর এক তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার ২৫০ জন পুলিশ সদস্য অপরাধে জড়িয়েছে। তবে অপরাধে জড়াচ্ছে এমন পুলিশের প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েক গুণ বেশি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু পুলিশ সদস্য একের পর এক অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ায় পুলিশের অন্য সদস্যদের মধ্যেও অপরাধপ্রবণতা দেখা দিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগেরচেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান বলেছেন, বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য পুলিশবাহিনীর আমূল পরিবর্তন দরকার। এ বাহিনীতে বর্তমানে কমিটমেন্ট ও রিসোর্সের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আসে। কিন্তু সব অভিযোগই যে সত্য এটা সঠিক নয়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে অর্ধলক্ষাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের সিকিউরিটি সেল ও ডিসিপ্লিন বিভাগে। অভিযুক্তদের মধ্যে কম সংখ্যক পুলিশেরই শাস্তি হয়। আর শাস্তি না হওয়ায় পুলিশের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে।
অপরাধী যেই হোক, তার শাস্তি নিশ্চিত করাই হলো অপরাধ দমনের প্রথম পদক্ষেপ। আর অপরাধ দমনের দায়িত্বে নিয়োজিতদের মধ্যে যারা নিজেরাই অপরাধে লিপ্ত হবে, তাদের শাস্তি অধিকতর কঠোর হওয়া দরকার। তাদের শাস্তি হতে হবে দুইভাবেই। প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায়। দুর্ভাগ্যজনক, দেশে কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধ করলে তার শাস্তি হয় কদাচিৎ। কখনো কখনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে কোনো কোনো পুলিশ সদস্যকে কোজ করা হয়। এ কোজ করার অর্থ জেল, জরিমানা বা চাকরি থেকে বরখাস্তের মতো কিছু নয়। এর অর্থ হলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাউকে সাসপেন্ড করা। সাসপেনশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাকে আবার চাকরিতে বহাল করা হয়। চাকরিতে বহাল হওয়ার পর শাস্তিপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য আবার নতুন উদ্যমে আগের মতোই তার অপরাধমূলক কাজ চালিয়ে যায়। বর্তমানে এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। অপরাধ জগতের দুর্বৃত্তদের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও একে একে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে থাকলে একপর্যায়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধপ্রবণ সদস্যদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
পুলিশ ঘুষখোর, পুলিশ দুর্নীতিগ্রস্ত, এ বাহিনীর সদস্যরা নানা অপরাধে জড়াচ্ছেন এটা নতুন কিছু নয়। এ দেশের মানুষ তা জানে। কিন্তু পুলিশ কেন ঘুষ খায়? কেন এ বাহিনীর এত দুর্নাম। কেনই বা পুলিশকে এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না। দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাই বা নেয়া হচ্ছে না কেন? এমন হাজারো প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাওয়াটাই স্বাভাবিক। আমরা কি কখনো তালিয়ে দেখেছি পুলিশ কেন ঘুষ খায়? এর অনেক কারণ আছে। যদি বলি পুলিশ ঘুষ খায় না, খাওয়ানো হয় হয়তো তা বললেও মোটেও অত্যুক্তি হবে না। আমাদের দেশের পুলিশকে দিয়ে কাজ করানো হয় বেশি আর বেতন দেয়া হয় কম। এ দেশে প্রতি ১ হাজার ৪০০ জনের জন্য যেখানে ১ জন পুলিশ নিয়োজিত সেখানে পাশের দেশ ভারতে মাত্র ৪০০ জনের জন্য ১ জন, পাকিস্তানে ৩০০ জনের জন্য ১ জন পুলিশ রয়েছে। এ ছাড়া আমাদের দেশের পুলিশকে পর্যাপ্ত পরিবহন না দিয়েই কাজ করতে বলা হয়। অন্যের গাড়ি রিকুইজিশন কিংবা চাঁদের হাটের গাড়ি ফাও নিয়ে কাজ করতে হয় পুলিশকে। লাশ বহনের টাকা ঠিকমতো দেয়া হয় না, টিএ-ডিএও অপ্রতুল। পুলিশকে হামেশাই রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয় এ দেশে। ফলে পুলিশ অপরাধীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে কারণে-অকারণে। বলা যায় অনেকটা বাধ্য হয়।
আমি এও বলছি, পুলিশ অস্বাধীন। আমরা প্রায়ই পুলিশের কাছ থেকে যা শুনি তা হলো ’উপরের নির্দেশ আছে’। পুলিশ যদি কথিত ’উপরের নির্দেশে’ কোনো নিরাপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারে তাহলে সে একই ’উপরের নির্দেশে’ একজন অপরাধীকে ছেড়েও দিতে পারে। পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা এভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ থাকে আইজিপির প্রতি, আইজিপির নির্দেশ ডিআইজির প্রতি, ডিআইজির নির্দেশ থাকে এসপির প্রতি, এসপির নির্দেশ ওসির প্রতি। আর এরপর সরকারদলীয় নেতা, এমপি, মন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রীর অফিসের বরাত দিলে তো আর কোনো কিছু করার নেই। উপরে যা বলেছি তা যে শুধু আওয়ামী লীগ জোট সরকারের আমলেই হচ্ছে তা কিন্তু নয়। আগের সরকারের সময়ও তা-ই হয়েছে। আইন প্রয়োগের ব্যাপারে পুলিশের মুখে যদি ’উপরের নির্দেশ’কে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করার কথা শুনতে হয় তাহলে জনগণ আইনের সঠিক প্রয়োগ সম্পর্কে তাদের কিভাবে বিশ্বাস করবে? পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য এর চেয়ে অবমাননাকর আর কিছু হতে পারে না। পুলিশের প্রতি ’উপরের নির্দেশ’ যে থাকতে পারে না তা কেউই বলবেন না। পুলিশ প্রশাসনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তো থাকবেনই। কিন্তু দায়িত্ব পালনে তিনি যে আইনের সঠিক প্রয়োগ করছেন সেই বিচারবোধ ও স্বাধীনতা তো তার থাকতে হবে। ’উপরের নির্দেশ’ তো কোনো আইন হতে পারে না। ’উপরের নির্দেশে’র নামে অনেক নির্দেশহীন নির্দেশও পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার হতে সাহায্য করছে। প্রয়োগ তো করা হবে আইনের। কালো টাকার নির্দেশও যে ’উপরের নির্দেশ’ হিসেবে আসছে এমনও তো হতে পারে। আমাদের দেশের বাস্তবতায় কালো টাকার শক্তি তো কম নয়।
আমাদের দেশে পুলিশকে কোনো ঘটনাস্থলে দেখলেই সাধারণভাবে প্রশ্ন ওঠে, তারা কারো নির্দেশে বা কারো পক্ষে কাজ করতে এসেছে। উপরে যা বলেছি তা যে শুধু আওয়ামী লীগ জোট সরকারের আমলেই হচ্ছে তা কিন্তু নয়। বলতে গেলে ছোট-বড় সব দলই বেকার যুবকদের সন্ত্রাসী হিসেবে আশ্রয় দেয়। তাদের ভাড়াটিয়া হিসেবে ব্যবহার করে। সন্ত্রাসীদের জন্য তাই সব দলেরই পুলিশের সহযোগিতা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য বর্তমান সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহারের সহজ সুযোগ যাতে কোনো দলের জন্যই না থাকে। তারা তো সহজ সময়ের সহজ সরকার নয়। কোনো সরকারের আমলেই পুলিশের চেইন অব কমান্ড বা শৃঙ্খলা ক্ষমতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। দলীয় রাজনীতি আর দলীয়করণের চাপ পুলিশকেই সবচেয়ে বেশি বহন করতে হয়েছে। ফলে দলীয় সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশেও দলীয় বিবেচনায় ব্যাপক রদবদল ও বদলি হতে দেখা গেছে। এক আমলে যারা চাকরি হারিয়েছে আরেক আমলে তাদেরই চাকরিতে পুনর্নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কোর্টের কাছে সুবিচার প্রার্থনা করে যারা চাকরি ফিরে পেয়েছেন তাদের কথা আলাদা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলা হয়, রাজনৈতিক কারণে তখন তাদের ভিকটিমাইজ করা হয়েছে। অথচ দলীয় রাজনীতির বিবেচনায় পুলিশে যদি নিয়োগ, বদলি, প্রমোশন ও পুনর্নিয়োগ সম্ভব হয় তাহলে পুলিশ প্রশাসনে শৃঙ্খলা বলতে যে কী থাকতে পারে, তা সহজেই বোধগম্য। সরকার পরিবর্তনের পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাই সঙ্গত কারণেই নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে অনিশ্চিত হয়ে পড়েন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে পুলিশের গুরুত্ব এত বেশি যে, সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশই সরকার। সরকার যতই জনসাধারণ দ্বারা নির্বাচিত হোক না কেন, সাধারণ মানুষ পুলিশকেই নিকটবন্ধু হিসেবে দেখতে চায়। গণতান্ত্রিক সরকারের কর্তব্য পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবে গড়ে তোলা। সবাই স্বীকার করেন যে, পুলিশ জনগণের নির্ভরযোগ্য বন্ধু হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারলেই সাধারণ মানুষের তথা তৃণমূল পর্যায়ে অনেক ব্যাপারে সুবিচার পাওয়া সহজ হয়। আমরা সবাই বলি জনগণের সহযোগিতা ভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সহজ নয়। কিন্তু জনগণ যদি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে যে, পুলিশ আইনের সঠিক প্রয়োগ বিষয়ে বাইরের কারো অন্যায় হস্তক্ষেপ দ্বারা প্রভাবিত হবে না এবং পুলিশের নিজস্ব বিশ্বস্ততাই সবকিছু নির্ধারণ করবেন কেবল সে ক্ষেত্রেই স্থানীয় অপরাধীদের ধরতে স্থানীয় জনগণ এগিয়ে আসতে সাহস পাবে।
পুলিশ দলীয় হলে সরকারের লাভ হয় না, লাভ হয় নিচের দিকের কিছু অবাঞ্ছিত দলীয় লোকজনের। তবুও পুলিশকে দলীয় করা হয়। সব সরকারের সময়ই তা হয়। পুলিশ দলীয় হলে সরকারের লাভ হয় না এই অর্থে যে, দেশে অপরাধ দমন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের দক্ষতা হ্রাস পায়। বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের তা অজানা থাকার কথা নয়। তদবিরের চাপে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ তো পদত্যাগ করাকেই শ্রেয় মনে করলেন। এত অল্প বয়সে তার পক্ষে ক্ষমতার আকর্ষণ ত্যাগ করা সহজ হয়েছে নিজের মর্যাদাবোধের কারণে। পুলিশকে স্বাধীনতা দেয়ার অর্থ এই নয় যে, তাদের সরকারের কাছে জবাবদিহি থাকবে না। তাদের জবাবদিহি অধিকতর কঠিন ও নিশ্চিত হবে। কারণ, স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য কথিত ’উপরের নির্দেশ’ বা ’মন্ত্রীর অফিসের ফোনের’ কোন খোঁড়া অজুহাত দেখানোর সুযোগ তাদের কারো থাকবে না। বাইরের চাপের মুখে কোনো মামলায় মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করার ব্যাপারেও তাদের উৎসাহ থাকবে না। দলীয় রাজনীতির কারণে মিথ্যা মামলা দেয়া বা মামলা উঠিয়ে নেয়া কোনোটারই প্রয়োজন হবে না। বিষয়টি সমর্থনযোগ্যও হতে পারে না। মামলা সত্য কি মিথ্যা, আইনের আলোকে তা কোর্ট দেখবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি চাইলে সবার আগে পুলিশ প্রশাসনের স্বাধীনতা ও শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি বর্তমান সরকারকে যথাযথ গুরত্বসহকারে দেখতে হবে। পুলিশের কিছু লোকের ’দলীয় আনুগত্যের’ ওপর নির্ভর করতে গিয়ে যে সমগ্র পুলিশবাহিনীর মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে তাও তো কম বিবেচ্য বিষয় নয়। পুলিশ প্রশাসনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে তারা নিজেরাই নিজেদের দোষত্রুটি কাটিয়ে উঠতে পারবে। দিনরাত অপরিসীম পরিশ্রমকারী সাধারণ পুলিশ কর্মীদের মানবিক সুবিধা-অসুবিধা সহানুভূতির সঙ্গে দেখা হলে পুলিশের সেবার মানও উন্নত হবে। দেশ ও জাতির জন্য একটি সম্মানজনক ও নির্ভরযোগ্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে একটি সুশৃঙ্খল পুলিশবাহিনী গড়ে উঠবে।
(লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিষ্ট। [email protected])